তখন আমার বয়স কতইবা। প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ফোরের ছাত্র। গ্রামের স্কুলে একলা একা যাই একাই ফিরি। স্পষ্ট মনে পড়ে। কাঁধে ব্যাগ। হাতে একটা শুকনো লাঠি। রাস্তার দুই পাশে ইউনিয়ন পরিষদের রোপণ করা বাবলা গাছগুলোকে আঘাত করতে করতে স্কুলে যাচ্ছি। হঠাৎ কেউ একজন আমায় ডাক দিলেন। পেছন ফিরে দেখি দূর সম্পর্কীয় এক ফুফু। ঘনশ্বাস নিতে নিতে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা হলুদ খাম। বুঝতে বাকি রইলো না একটা চিঠি। আমার কাজ হবে স্কুলের পাশে অবস্থিত পোস্ট অফিসে চিঠিটা পোস্ট করা। এরপর প্রায়ই একই ঘটনা। স্কুলে যাবার সময় হাতে এসে পড়তো হলুদ খাম। আমিও খুব ভালো লাগার সহিত কাজটি সম্পন্ন করতাম। লাল একটা স্টিলের বাক্স। গায়ে সাদা রঙ লেখা ‘চিঠির বাক্স’। মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে যেন। মনে হতো ওটা অনাহারিত আর চিঠি মুখে পড়লেই আহার জোটে। শুধু পোস্ট করাই কাজ শেষ নয়। মাঝে মাঝে অফিসে খবর নিয়ে চিঠি ফুফুর হাতে পৌঁছে দেয়াও আমার কাজ ছিল। কেউ জিগ্যেস করলে আমাকে মিথ্যে বলতে হতো ‘মামা আমার মাকে চিঠি পাঠায়’ এবং এটা ফুফুর শেখানো মিথ্যে বুলি। পোস্ট করার পূর্বে দু একটা চিঠি আমি পড়েছিলামও বটে। একটা চিঠির শেষ দুটো লাইন, তোমার ফোলা ফোলা গালে আমার একরাশ চুমু রইলো। ইতি............। আমি খেয়াল করে দেখতাম ফুফুর হাস্যজ্জল মুখ। চিঠি বুকে চেপে ধরা, চিঠির গায়ে চুমু খাওয়া। আর আমাকেও আদর করতে ভুলতেন না।
এরপর বহুদিন বাদের কথা। আমাদের গ্রামে বাৎসরিক মাহফিল। দূরগ্রাম থেকে হুজুররা আসেন। সুর করে করে গ্রামের মানুষদের কুরআন হাদিসের কথা বলেন। একদিন ফুফু আমাকে ডেকে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা চিরকুট আর পঞ্চাশটা টাকা। আমার কাজ হবে চিঠিটা মাহফিলের হুজুরকে পৌঁছে দেয়া। একটা কাগজের টুকরো। খাম নেই, ঘাম নেই, স্টাপেল করা নেই। আমি সহজেই চিঠিটা খুলে পড়লাম। লেখা আছে, হুজুর সালাম জানবেন। আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসতাম কিন্তু আমাদের প্রেমটা হচ্ছে না। আমি চাই ছেলেটি আমাকে ভুলে যাক। আর ও যেন আমাকে ভুলে যেতে পারে সেজন্য কিছু তদবির দিবেন’। হুজুর আমাকে ধরিয়ে দিলেন একটা তাবিজ। নিয়ম বলে দিলেন। তাবিজটা যেন ফুফু সিথানের তলে রাখেন।
এরপর খেয়াল করে দেখেছি তার চোখের নীচের কালিমা, শুষ্ক মুখ। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। যেমন হাতুড়ি দিয়ে পেরেকে আঘাত করলে হাতুড়ি আর পেরেক সমান আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফুফুর ভুলতে চাওয়াটাও বোধহয় সেরকমই ছিল।
জানি না ছেলেটি ফুফুকে তাবিযে ভুলে গেছে কিনা। নাকি এখনো তার দেয়া চিঠিগুলো আঁকড়ে ধরে আছেন। আর এও হতে পারে সে এখন বৌ বাচ্চা নিয়ে সুখেই দিন কাটান।