আমির খান, বলিউডের সবচেয়ে সফল অভিনেতা, যার রয়েছে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। আপনি হয়তো তাঁকে চেনেন থ্রি ইডিয়টস, পিকে কিংবা দাঙ্গাল ছবির মাধ্যমে। আপনার কাছে হয়তো তিনি এক অদম্য সাহসী মানুষ, এক বীরপুরুষ। কিন্তু আপনি কি জানেন, বিশ্বখ্যাত এই মহান অভিনেতার মোটেও ইচ্ছে ছিলো না অভিনেতা হওয়ার, তিনি অভিনয় জগতে এসেছিলেন কেবল এক বাঙ্গালি ছেলের কারণেই। জানেন স্কুলের গন্ডি পার হতে না হতেই তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে দিয়েছিলেন!
ছেলেবেলায় তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতোটাই করূণ ছিলো যে তাঁর স্কুলের ফী দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও ছিলো না তাঁর বাবার! প্রায়ই তাঁকে ও তাঁর ভাইবোনদের ক্লাসে দাড় করিয়ে রাখা হতো এজন্য। স্কুল ছেড়ে যে ছেলেটি অভিনয় জগতে এসেছিলো, সেই ছেলেটিই একটা সময় শুটিং শেষে প্রতিদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরতো!
আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে প্রতিটি ছবির জন্য আমির খান পারিশ্রমিক নেন ৫০ থেকে ৬০ কোটি রূপি। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা কি জানেন, কোন মুভির জন্যই তিনি একটি পয়সাও নেন না। আপনি হয়তো বলতে পারেন পয়সা ছাড়া আবার কেউ অভিনয় করে নাকি? না, আসলে তিনি পয়সা নেন, তবে তাঁর পারিশ্রমিক নেওয়ার ধরণটা একেবারেই আলাদা। যেই ছেলেটির জন্য এখন লক্ষ লক্ষ মেয়ে পাগল সেই ছেলেটিকে ছোটবেলায় মেয়েরা পাত্তাই দিতো না। যে ছবিটির জন্য তাঁর নাম অস্কারের পাতায় লেখা হয়েছিলো, সেই ছবিটির কারণেই তাঁর সাজানো সংসার ভেঙ্গে গিয়েছিলো।
আপনি কি জানেন এগুলো? না জেনে থাকলে চলুন মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খানের বর্ণময় জীবনের অতল গহীনে চলে যাই আর জেনে নেই তাঁর জীবন কাহিনী।
আমির খান, পূর্ণ নাম মোহাম্মদ আমির হোসাইন খান, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে একজন, যিনি তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য গোটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে প্রিয় একটি মুখ। তাঁর জন্ম হয় ১৯৬৫ সালের ১৪ই মার্চ, মুম্বাই শহরের বান্দ্রা এলাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন সেটি ছিলো এক রক্ষনশীল মুসলিম পরিবার, যাদের পূর্বপুরুষেরা আফগানিস্থান ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলো। তাঁর উচ্চতা হলো পাঁচ ফুট পাঁচ, ছয় কিংবা সাত ইঞ্চি। তাঁর রয়েছে দুই বোন ও এক ভাই। তাঁর বাবা হলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক তাহির হোসাইন আর মা জীনাত হোসাইন হলেন গৃহিনী। খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালক নাসির হোসাইন হলেন তাঁর চাচা। তাঁর পরদাদা হলেন ভারতের ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। আর বিজেপির প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমা হেপতুল্লাহ হলেন আমির খানের সেকেন্ড কাজিন। তাছাড়া তিনি হলেন ভারতের ৩য় রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হুসেইনের বংশধর। ৫৪ বছর বয়সী এই অভিনেতা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মুম্বাইয়ের বান্দ্রা অঞ্চলের বিলাসবহুল এক অট্টালিকায়।
ভারতীয় সিনেমা জগতের ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাবসা সফল ছবির তালিকায় আমির খানের দাঙ্গাল ছবিটি রয়েছে সবার প্রথমে। এই তালিকার সেরা ২০ টি ছবির মধ্যে পাঁচটিই হলো আমির খানের। বলা হয়, বলিউডের রেকর্ড গড়ার জাদুকর কেবল একজনই, আমির খান। তাঁর একেকটা ছবি মানেই বক্স অফিসের রেকর্ড ভাঙা গড়ার খেলা। তাঁর সম্পদের পরিমাণ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন রুপি, রয়েছে একাধিক বিদেশি গাড়ি। বিশালদেহী ছয়জন বডিগার্ড রয়েছে তাঁর সার্বক্ষনিক পাহাড়ায়, যেখানেই তিনি যান, সঙ্গে যান তাঁরা।
আটবছর বয়সেই আমির খানকে দেখা যায় তাঁর চাচা নাসির হোসাইনের ইয়াদো কি বারাত ছবির একটি গানের দৃশ্যে। এটিই ছিলো সিনেমার পর্দায় তাঁর প্রথম অভিষেক। পরের বছরও তিনি বাবা তাহির হোসাইনের মাধোশ ছবির সামান্য দৃশ্যে অভিনয় করেন। কিন্তু এরপর দশবছর পর্যন্ত তাঁকে আর সিনেমার পর্দায় দেখা যায়নি। এই সময়টায় তিনি মন দিয়েছিলেন পড়াশুনায়। আমির খান মূলত পড়াশুনা করেছিলেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। তাঁর শিক্ষাজীবন অতিক্রান্ত হয়েছিলো চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জেবি পেটিট স্কুল, সেইন্ট অ্যান’স উচ্চ বিদ্যালয়, বোম্বে স্কটিশ স্কুল এবং নার্সি মঞ্জি কলেজ। ১ম টি তে পড়েছিলেন নার্সারিতে, ২য় টিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, আর ৩য় টি থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন আর সবশেষে নার্সি মঞ্জি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই শিক্ষাজীবনে ইতি টানেন তিনি।
তরুণ আমির খানের কাছে পড়াশুনার চেয়ে খেলাধুলা ই ছিলো অধিক পছন্দের। টেনিস ছিলো আমির খানের প্রিয় খেলা, একবার তিনি টেনিস খেলায় মহারাষ্ট্র রাজ্য থেকে স্টেইট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কিন্তু খেলায় মজে থেকে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মতো বিলাসিতার সুযোগ ছিলো না তাঁর। নিদারুণ আর্থিক কষ্টের মধ্যেই কেটেছে আমির খানের বাল্যকাল। বাবা তাহির হোসাইনের ছবিগুলো একের পর এক ফ্লপ করছিলো আর সংসারের আর্থিক অবস্থা দিন দিন কেবল শোচনীয় পর্যায়ে যাচ্ছিলো। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমির খান বলেন, তখন আমাদের বাড়িতে ঘন্টায় ঘন্টায় পাওনাদারদের ফোন আসতো, আমি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম কখন জানি আমাকে আর আমার ভাইবোনদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। কারণ তখন আমাদের অবস্থা এতোটাই করুণ ছিলো যে আমাদের স্কুলের বেতন দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও ছিলো না আমার বাবার।
চোঁখের সামনে বাবার সীমাহীন ব্যার্থতা দেখে আমির হয়ে পড়েছিলো খুবই বিমর্ষ ও দ্বিধাগ্রস্থ, জীবনে কি করবেন বুঝতেই পারছিলেন না তিনি। কিন্তু একটি ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, আর যাই করবেন না কেন ভুল করেও চলচ্চিত্র জগতের দিকে পা বাড়াবেন না তিনি। তাছাড়া তাঁর পরিবারের লোকেরাও চাচ্ছিলো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় না ঢুকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক আমির খান। কিন্তু আমির খান তো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হলেন না, হলেন অভিনেতা। কিন্তু কিভাবে?
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন আমির খান। বাবার ব্যার্থতার কারণে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতি ছিলো তাঁর প্রবল অনীহা। সেজন্য তিনি কখনোই অভিনয় জগতে আসতে চাননি। কিন্তু এক বাঙ্গালি ছেলের পাল্লায় পড়ে শেষমেষ যুক্ত হলেন অভিনয়ের সঙ্গে। এই বাঙ্গালি ছেলেটি ছিলো আমির খানের বাল্যবন্ধু আদিত্য ভট্টাচার্য। আদিত্যের নানা ছিলো কালজয়ী পরিচালক বিমল রায় যিনি জন্মেছিলেন পুরাণ ঢাকায়। নানাকে দেখার সুযোগ হয়নি আদিত্যের। কারণ তাঁর জন্মের কয়েক মাস পরেই মারা গিয়েছিলেন বিমল রায়। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বিমল রায়ের গল্প শুনতে শুনতেই বড় হয়েছিলো আদিত্য।
কিভাবে তাঁর নানা ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন আর পরে কলকাতা থেকে অচেনা শহর বোম্বেতে এসে বোম্বের নামকরা চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেন সেই কাহিনী শুনতে শুনতে আদিত্য এতোটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে স্কুলের গন্ডী পার না হতেই তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন বাপ ঠাকুরদার মতো নিজেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। সেজন্য আদিত্য তাঁর বন্ধু চকলেট বয় আমিরকে বললেন তাঁর ছবিতে অভিনয় করার জন্য। কিন্তু আমিরের মোটেও ইচ্ছে ছিলো না অভিনয় জগতের সাথে যোগ দেয়ার। কিন্তু আদিত্য ছিলেন নাছোড়বান্দা, সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েছেন, ছবি তিনি বানিয়ে ছাড়বেন ই। সেজন্য তিনি তখন আমির কে ক্রমাগত বোঝাতে লাগলেন আর একসময় বাল্যবন্ধুর কথায় রাজি হয়ে যান আমির খান।
কিন্তু আমিরের বাবা মায়ের আপত্তির কারণে ছবিটির শুটিং হলো গোপনে। মুক্তি পেলো ছবিটি, দেখলেন শাবানা আজমি, তিনি বুঝালেন আমিরের বাবা মাকে। রাজি হলেন আমিরের বাবা মা। এই ছবিটির নাম প্যারানয়া, ৪০ মিনিটের এক নির্বাক ছবি, যার সাহায্যে প্রকাশ্যে অভিনয় জগতে এলেন আমির খান।
এই ছবিতে অভিনয়ের পর যে সাহস আর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তা থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন অভিনেতা হবেন, সেজন্য তিনি যোগ দিলেন থিয়েটারে। মঞ্চের আড়ালে ছোটখাটো কাজ করেন এক বছর। এরপর তাঁর সুযোগ এলো মঞ্চে অভিনয় করার। গুটিকয়েক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন তিনি। আর ওদিকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলেন আর পড়াশুনা নয়, এবার নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করবেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতে। সেজন্য পড়াশোনা ছেড়ে যোগ দিলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। কাজ করা শুরু করলেন চাচা নাসির হোসাইনের সহকারি হিসেবে।
এখন হয়তো এই ছেলেটির জন্য পাগল বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মেয়ে। অথচ যেই মেয়েটিকে তাঁর প্রথম ভালো লেগেছিলো, সেই মেয়েটিকে তিনি কখনো বলতেই পারেননি তাঁর ভালো লাগার কথা। প্রথম যেই মেয়েটিকে তিনি প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই মেয়েটি তাঁকে অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলো আরো দুটো মেয়ে। চারবারের মাথায় রক্ত দিয়ে প্রেমপত্র লিখে ঘায়েল করেছিলেন প্রতিবেশী এক হিন্দু মেয়ে রীনা দত্ত কে, যাকে তিনি একুশ বছর বয়সে গোপনে বিয়ে করেন। অথচ মেয়েটিকে নিয়ে যে আলাদা সংসার পাতবেন সেই সামর্থ্যটুকুও ছিলো না তাঁর। চাচার সহকারি হিসেবে কাজ করার সময় কিছু ডকুমেন্টারিতে অভিনয় করেন আমির। পরিচালক কেতন মেহতা দেখেছিলেন সেই ডকুমেন্টারি। ভালো লেগে যায় ছেলেটিকে। নিজের হলি ছবির সামান্য এক দৃশ্যে অভিনয়ের সুযোগ দেন ছেলেটিকে। কিন্তু বড় কোন দৃশ্যে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের প্রথম সুযোগ তাঁকে দিয়েছিলো আদিত্য, যে ছেলেটি আমির খানকে নিয়ে এসেছিলো অভিনয় জগতে। আদিত্য ভট্টাচার্যের রাখ ছবির মাধ্যমেই নায়ক হিসেবে আমির খানের যাত্রা শুরু হয়।
এদিকে খ্যাতনামা স্ক্রিপ্টরাইটার ও গীতিকার জাভেদ আখতার যখন প্রথমবারের মতো আমির খানকে নাসির হোসাইনের পাশে দেখেছিলেন, তখনই তিনি আমিরের চাচা নাসির হোসাইনকে বললেন, এই ছেলেটাকে অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর বানিয়ে রেখেছেন কেন? ওকে ঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে ও তো একদিন বড় স্টার হতে পারবে, ওকে তো নায়ক বানানো উচিৎ। জাভেদ আখতারের কথায় মুগ্ধ হয়ে নাসির হোসাইন ভাবলেন, পরের ছবির মধ্যদিয়েই তাঁর ভাঁতিজা আমির খান ও ছেলে মনসুর খান দুজনকেই সিনেমা জগতে নিয়ে আসবেন।
সেজন্য তিনি ছেলে মনসুর খানকে দিলেন চলচ্চিত্র পরিচালনার দায়িত্ব আর ভাঁতিজা আমির খানকে বানালেন নায়ক। ছবিটি হলো কেয়ামত সে কেয়ামত তাক, যেখানে আমির খান ও জুহি চাওলা ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। আমির ও জুহির চমৎকার অভিনয় আর পাপা কেহতে হে বাড়া নাম কারেগা গানের মধ্যদিয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিলেন আমির খান। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন আমির ও মনসুর, মুক্তির পর পরই ছবিটি হয়ে গেলো সুপারহিট।
বিভিন্ন পরিচালকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো তাকে নেওয়ার জন্য, তাড়াহুড়ো করে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যান নয়টি ছবির সাথে। রোজগার ভালো হওয়ায় বৌ কে নিয়ে একসাথে থাকতে শুরু করলেন তিনি। আর দুজনের পরিবারও মেনে নিলো তাদের বিয়ে। আর একসময় তাঁদের ঘর আলো করে এলো দুই সন্তান, ছেলে জুনায়েদ খান আর মেয়ে আইরা খান।
ওদিকে শুটিং শেষে তিনি প্রতিদিন কাঁদতে কাঁদতে ফিরতেন বাড়িতে। ভয় হতো, না জানি বাবার মতো ব্যার্থ হন তিনি আর তাঁর নয়টি ছবিই না আবার ফ্লপ করে বসে। নয়টির মধ্যে যখন পাঁচটি মুক্তি পায়, তখন চারটি ছবিই ফ্লপ করে, কেবল একটি ছবি হিট হয়, দিল। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক তিনি অভিনয় করেন বহু ছবিতে যার বেশিরভাগই ব্যাবসা সফল হয়। ।দিল হ্যায় ক্যা মানতা নেহি, জো জিতা ওহি সিকান্দার, হাম হ্যায় রাহি প্যায়ার কে, আন্দাজ আপনা আপনা, রঙ্গীলা, রাজা হিন্দুস্তানি এই ছবিগুলোর মাধ্যমে আমির খান বনে যান বলিউডের জনপ্রিয় সুপারস্টার। এই ছবিগুলোতে আমির খানের অভিনয় সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। তাঁর অভিনয়, সংলাপ বলার ধরণ সাধারণ মানুষকে এতোটাই অভিভূত করে রাখে যে তিনি যে ছবিতে অভিনয় করতেন সেটিই হিট। আমির খানের দুষ্টুমি, পাগলামি, শয়তানি আর রোমান্স দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে রাখে কয়েক দশক ধরে।
কিন্তু এই হিট ছবিগুলোর আড়ালেও এমনকিছু ফ্লপ ছবি ছিলো যা আমির খানের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো। ৯৫ সালে আমির খান অভিনয় করেছিলেন আতংক হি আতংক ছবিতে, যেটি ছিলো জনপ্রিয় ইংরেজি ছবি দ্যা গডফাদার এর দেশি ভার্সন। এই ছবিতে আমির খান অভিনয় করেছিলেন মাইকেল কর্লিওনির ভূমিকায়। ছবিটি মুক্তির পর আমির খান হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নিজের ব্যর্থতা চোঁখে আঙ্গুল দিয়ে তাকে দেখিয়ে দিচ্ছিলো কি ছাইপাশ করেছিলেন তিনি। তাঁর ভাবতেই অবাক লাগছিলো কিভাবে তিনি এ ধরণের অভিনয় করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার মনে হলো এই সিনেমাটি করার চিন্তাটাই আমার একটা মস্তবড় ভুল ছিলো। ছবিটি তৈরি করার সময় আমরা ভারতীয় দর্শকদের কথা মাথায় রাখিনি, এদেশের দর্শকদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তাছাড়া আমরা ভারতের প্রেক্ষাপটে ছবিটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। এই গরমে কেউ সারাক্ষন কোট পড়ে থাকে? আমি তখন এতোটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে তিন থেকে চার সপ্তাহ ঘুমাতে পারিনি। আমি শুধু ভাবতাম যে আমার সাধারণ বোধশক্তি কোথায় চলে গেছে!”
এই ঘটনার পরেই আমির খানের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শুরু হয়, এই অনুধাবন থেকেই ঘুড়ে যায় তাঁর জীবনের মোড়। এরপর থেকে তিনি কোন ছবিতে কাজ করার আগে ভালো করে ভেবেচিন্তে তারপর ছবি বাছাই করেন। আর এজন্যই তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোকে এতটা বাস্তব আর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
৯৮ সালে আমির খান অভিনয় করেন দীপা মেহতা পরিচালিত ৪৭ এর দেশভাগের প্লট নিয়ে নির্মিত এমন এক ছবিতে যা তাঁকে প্রথমবারের মতো ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছে দেয়। এই ছবিটির আগে আমির খান যত ছবিতে অভিনয় করেছেন সবগুলোই ছিলো মূলত অতি নাটকীয়তায় ভরা বিনোদন ভিত্তিক ছবি, যেগুলোর মূল লক্ষ্য ছিলো সাধারণ মানুষকে বিনোদিত করা। কিন্তু এই ছবিটিই হলো আমির খানের জীবনের প্রথম ছবি… আসলে দ্বিতীয় ছবি, যেখানে তিনি এমন এক চরিত্রে অভিনয় করেছেন যা কেবল সস্তা বিনোদন দেওয়ার জন্যে বানানো হয়নি, বানানো হয়েছে একটি গল্প বলার জন্য যেখানে গল্পের চরিত্রগুলো প্রাণ পাবে। প্রথম ছবিটি ছিলো আমির খানের জীবনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, রাখ, যেটি বানিয়েছিলো অভিমানী সেই বাঙ্গালি ছেলেটি, আদিত্য ভট্টাচার্য, যে দেশ ছেড়ে ইতালি চলে গিয়েছিলো ওয়েইটারের কাজ করতে। আর দ্বিতীয় ছবিটি বানিয়েছিলেন দীপা মেহতা, ছবিটির নাম আর্থ। এই ছবিতে আমির খানকে দেখা যায় এক মুসলমান আইসক্রিম বিক্রেতার চরিত্রে যিনি এক সুন্দরী হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু দেশভাগ সব ওলট পালট করে দেয়। আর মেয়েটিও বেছে নেয় আরেক মুসলিম ছেলেকে। এই ছবিটিকে ভারতের পক্ষ থেকে অস্কারেও পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু অস্কারের দৌড়ে এটি হেরে গেলেও জিতে নিয়েছিলো এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এর বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড।
এরপর আমির খান আরো কয়েকটি ছবি করেন যেগুলো ছিলো মূলত আগের মতোই, সস্তা বিনোদন কেন্দ্রিক, অতি নাটকীয়তায় ভরা প্রেম কাহিনীভিত্তিক ছবি। কিন্তু ২০০১ সালে তিনি যে ছবিটি করেন সেটি তাঁর জীবনকে একেবারেই বদলে দেয়। আশুতোষ গোয়ারিকর নামের এক ব্যার্থ পরিচালক একদিন আমির খানের কাছে নিয়ে এলো একটি স্ক্রিপ্ট, যেই স্ক্রিপ্ট টি পড়ে শোনানোর পর আমির খানের চোঁখ জলে ভিজে গিয়েছিলো। আমির খান বুঝতে পেরেছিলেন এটি মোটেই কোন সাধারণ স্ক্রিপ্ট নয়, কিন্তু এমন ছবিতে অভিনয় করার সাহস ছিলো না আমির খানের। আশুতোষকে আমির বললেন অন্যদের কাছে যেতে, শাহরুখের কাছে যেতে। আমিরের কথায় আশুতোষ স্ক্রিপ্ট নিয়ে গিয়েছিলেন প্রত্যেকের দ্বারে দ্বারে, কিন্তু কেউ রাজী হলো না। শেষমেষ আমির নিজেই রাজী হলেন ছবিটি করার জন্য।
অথচ আমির খান কিন্তু জানতেন যে আশুতোষ তখন পর্যন্ত মাত্র দুটো ছবি পরিচালনা করেছে আর দুটো ছবিই ফ্লপ করেছে, যার একটিতে ছিলো আমির নিজে। এটা জানার পরেও তিনি কিভাবে রাজি হলেন আশুতোষের ছবিতে অভিনয় করতে? কারণটা হলো আমির খান জানতেন যে আশুতোষ পারবে, আশুতোষের উপর আমির খানের পূর্ণ আস্থা ছিলো, যেমনটা ছিলো আমির খানের উপর আদিত্যের। শুধু অভিনয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই বসে থাকেন নি আমির খান, আশুতোষ যখন কোন প্রযোজক পাচ্ছিলো না তখন আমির খান নিজেই এগিয়ে এলেন ছবিটি প্রযোজনা করার জন্য। কিন্তু কে জানতো যে এই ছবিটির কারণেই একদিন আমির খানের সংসার ভাঙ্গবে। শুধু তাই নয় এই ছবিটি আমির খানের গোটা জীবনকেই একেবারে পাল্টে দিয়েছে।
এই ছবিটির নাম হলো লাগান। ভারতীয় সিনেমা জগতের ১০০ বছরের ইতিহাসে কেবল তিনটি ভারতীয় ছবি অস্কার এর সেরা পাঁচটি বিদেশি মুভির তালিকায় মনোনীত হয়েছিলো। লাগান হলো এই তিনটির মধ্যে একটি, বাকি দুটো হলো মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া এবং মীরা নায়ার এর সালাম বোম্বে। ভারত ছাড়াও লাগান ছবিটি পৃথিবীর বহু দেশে প্রচারিত হয়েছিলো আর জিতেছিলো বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এই ছবিটিই ছিলো তখনো পর্যন্ত আমির খানের শ্রেষ্ঠ ছবি যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের নাম মাথা উঁচু করে সগৌরবে পৌঁছে দিয়েছিলো বিশ্বের দরবারে।
আবার এই ছবিটির ফলেই আমির খানের জীবন থমকে যায়, ভেঙ্গে যায় তাঁর ১৬ বছরের সংসার। লাগান ছবির যখন শুটিং চলছিলো তখন পরিচালক আশুতোষ এর সহকারি হিসেবে কাজ করছিলো এক রূপবতী মেয়ে। শুটিং চলাকালীন সময়েই মেয়েটির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়ে যায় আমির খানের। দূর থেকে সবকিছুই দেখতেন আমির খানের স্ত্রী রীনা দত্ত। তিনি এটি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। এই ছবিটি ছিলো আমির খান প্রযোজিত প্রথম ছবি। আর সেজন্যই রীনা সবসময় উপস্থিত থাকতেন ছবিটির শুটিংয়ে।
এই একটি ছবিতেই তিনি আমির খানের কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, আর এই ছবিটি থেকেই তিনি আমির খানের জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এই ছবিটির শুটিং চলাকালীন সময় থেকেই আমির ও রিনার সম্পর্কে ফাটল ধরে, ধীরে ধীরে এই ফাটল বাড়তে বাড়তে একসময় বন্ধন ছিড়ে যায় আর শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটে ২০০২ সালে। যে মেয়েটির জন্য একদিন আমির খান নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন সেই মেয়েটিই তাকে ছেড়ে চলে যায় আর সাথে নিয়ে যায় তাদের ৯ বছরের ছেলে জুনায়েদ আর ৪ বছরের মেয়ে আইরা কে।
বৌ ছেলে মেয়ে হারিয়ে নি:স্ব আমির খানের তখন প্রতিদিনের সঙ্গী ছিলো মদ, দেড় বছর ধরে প্রতিদিন তিনি এক বোতল করে মদ খেতেন। দু বছর তিনি কোন ছবিতে কাজ করেন নি। এরপর নিঃসঙ্গ আমিরের জীবনে সঙ্গ দিতে আসেন সেই রূপবতী মেয়েটি, কিরণ রাও, যার জন্য তাঁর সংসার ভেঙ্গেছিলো। কিরণ রাও এর সাথে বছরখানেক একসাথে থাকার পর আবারো বিয়ে করেন আমির খান। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কিরণ ছিলো গর্ভধারণে অক্ষম। তাই অন্য এক নারীর সহায়তায় তাদের ঘরে আসে এক পুত্র সন্তান, আজাদ রাও খান।
এরপর দুবছর বাদে আবারো অভিনয় শুরু করেন আমির খান। তবে এবারে তিনি আগের চেয়ে অনেক পরিণত, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা থেকে তিনি দুনিয়াকে দেখতে শিখেছেন নতুন রূপে, যাতনা থেকে পূর্ণতা পেয়েছে তাঁর ভেতরের শিল্পী সত্তা টি। এই সময়টায় তিনি যে ছবিগুলো করেছেন সেগুলোই হলো মূলত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। মঙ্গল পান্ডে, ফানা, রঙ দে বাসন্তী, থ্রি ইডিয়টস, পিকে আর দাঙ্গাল, একেকটি ছবি যেন সমাজের একেকটি দর্পন বা আয়না। অভিনয়ের পাশাপাশি আমির খানের পরিচালনায় প্রথম ছবি হলো তারে জমিন পার, যা বলিউড দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। ডিসলেক্সিয়া রোগে আক্রান্ত এক স্কুল পড়ুয়া শিশু আর তাঁর চারপাশের পরিবেশ নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই ছবিটি।
২০০৮ সালে তিনি জানে তু ইয়া জানে না ছবির মধ্যদিয়ে ভাগ্নে ইমরান খানকে নিয়ে আসেন বলিউড জগতে আর ছেলে জুনায়েদ কে লাগিয়ে দেন পিকে ছবির সহকারি পরিচালক হিসেবে। বৌ কে নিয়ে ২০১০ সালে নির্মাণ করেন ভিন্নধারার ছবি ধোবি ঘাট। একই বছরে তিনি প্রযোজনা করেন মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র পিপলি লাইভ। গুঞ্জন চলছে তাঁর পরের ছবিটি হবে দুনিয়া আলোড়িত ইংরেজি ছবি ফরেস্ট গাম্প এর দেশি ভার্শন।
আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে প্রতিটি ছবির জন্য আমির খান পারিশ্রমিক নেন ৫০,৫৫ কিংবা ৬০ কোটি রূপি। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা কি জানেন, কোন মুভির জন্যই তিনি একটি পয়সাও নেন না, একেবারে বিনে পয়সায় তিনি প্রতিটি মুভিতে অভিনয় করেন। কিন্তু ছবিটি মুক্তির পর যখন সব খরচ চুকিয়ে মূলধন ফিরে আসে প্রযোজকের হাতে, তখনই তিনি ছবির লভ্যাংশের একটি বড় পার্সেন্টেজ নেন। আর যদি কোন ছবি তাঁর মূলধন উঠাতে ব্যার্থ হয় তাহলে কোন পয়সাই নেন না আমির খান।
মিডিয়া জগতের বাইরেও আমির খান সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। ২০১৩ সালে তিনি মাকে নিয়ে মক্কায় যান হজ্ব করতে। আর ২০১৫ সাল থেকে তিনি মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সবজী খাওয়া শুরু করেন। শিশুদের পুষ্টিহীনতা রোধের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য তাঁকে ইউনিসেফের এর দূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। চায়নার প্রতিটি ঘরেই আমির খান হলেন এক পরিচিত মুখ। গৌতম বুদ্ধের পর আমির খানই হলেন চায়নার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় ব্যক্তি। চাইনিজ গণমাধ্যমে তাঁকে প্রায়ই ডাকা হয় ভারতের জাতীয় সম্পদ কিংবা ভারতের বিবেক নামে। আর ভারতে তিনি পরিচিত মিস্টার পারফেকশনিস্ট নামে।
২০১৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে দেখা যায় তাঁর মুখ, বিশ্বখ্যাত এই ম্যাগাজিনে আমির খানকে রাখা হয় বিশ্বের সেরা ১০০ ব্যক্তির তালিকায়। প্রচারবিমুখ এই অভিনেতার ঝুড়িতে বহু পুরস্কার থাকলেও কখনো কোনো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যান না তিনি। বিশ্লেষকদের মতে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে আমির খানের মতো অভিনেতা এখনো পর্যন্ত আসেনি। অভিনেতা তো কতোই থাকে, কিন্তু অভিনয়ের ভেতর দিয়ে কোটি কোটি মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে সেখানে স্থায়ী আসন গড়তে পারে ঠিক কজন অভিনেতা?