somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তবুও ঋণ শেষ হয় না ফজিলার

০৩ রা মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফজিলা বেগমের বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। ঘুম থেকে উঠেই শুরু করেন পিঁয়াজু, বেগুনি ইত্যাদি ভাজার কাজ। তার ছোট্ট ঘরটি-লাগোয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
রাস্তার উল্টো পাশে রয়েছে উত্তর ভাড়াশিমলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটু এগিয়ে গেলে ইউনিয়ন পরিষদের ভবন; তার পাশেই আরো কয়েকটি দোকান।
ফজিলা বেগম সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভাড়াশিমলা গ্রামের বাসিন্দা। বাড়িঘর থাকলেও সেখানে থাকতে পারেন না। স্কুলের পাশে এক টুকরো জমিতে বাঁশের চটা-কঞ্চি, পুরনো পলিথিনের বেড়া আর উপরে গোলপাতার ছাউনি দিয়ে একচালা ঘর! এখানেই বসত, এখানেই ব্যবসা।
জীর্ণ বেড়ার গায়ে ঝুলছে লজেন্স, বিস্কুট, পাউরুটি আর সস্তা কেকের ঠোঙা। ভেতরে খাজাঞ্চিতে আছে বিড়ি, সিগারেট আর পান। ঘরে ঢুকতেই মাটির একখানা চুলা, পাশে স্ত‚প করে রাখা কুড়িয়ে আনা পাতা, পুরনো কাগজ। এগুলো হচ্ছে জ্বালানি!
বেলা ১১টার দিকে তার ছাউনির সামনে গেলে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী চাই?’
‘কিছুই চাই না, শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম’- বলি মুরুব্বিকে।
ঘরের সামনে কাঠের দুটো বেঞ্চ পাতা। সেখানে বসতে গেলে নিষেধ করেন, ‘একটু দাঁড়াও বাবা, পরিষ্কার করে দিই, তারপর ভেতরে এসে বসো!’
একটু সময় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়।
ঘরের ভেতরটা বেশ অগোছালোই। সেখানে একটি রঙিন টিভি চালু রয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি টিভিতে পুরনো দিনের একটি বাংলা সিনেমা দেখছিলেন। সিনেমার নায়িকার রোল চলছে; বন থেকে তাকে একজন কাঠুরে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। কাঠুরের স্ত্রী এতে নাখোশ। কিন্তু অসহায় নায়িকা কাঠুরের স্ত্রীকে ‘দিদি’ বলে ডাকায় খুব শিগগির মন নরম হয়ে যায়, আর তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন!
‘আমার জীবনটা খুবই কষ্টের বাবা! আল্লাহ কেন এতো পরীক্ষা যে নিচ্ছে বুঝি না।’- দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ফজিলার কণ্ঠ থেকে।
বছর পঁয়ত্রিশ আগে তার বিয়ে হয় একই গ্রামের বাবুর আলীর সঙ্গে। সংসারে এক মেয়ে আর তিন ছেলে। বিয়ের পর থেকেই ‘অলস’ স্বামীকে নিজেই রোজগার করে খাইয়েছেন। সংগ্রামী এই নারীর জীবনে মাঠে শ্রম দেওয়া থেকে শুরু হয় কর্মজীবন। এরপর পরের বাসায় কাজ, দোকানে দোকানে পানি দেওয়া, এমনকী ভারত থেকে কাপড়ও চোরাচালানের মাধ্যমে এনে সেগুলো বিক্রি করেছেন।
১৮ বছর আগে একমাত্র মেয়েটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার চিকিৎসায় তিনি বিভিন্ন এনজিও আর ব্যক্তির কাছ থেকে সুদে টাকা নেন প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। মেয়ের চিকিৎসায় সাধ্যমতো খরচ করলে শেষতক তাকে বাঁচাতে পারেননি। সেই টাকা সুদেমূলে পরে অনেক হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ টাকা শোধ করেছি; কিন্তু এখনো দেনা এক লাখ ২০ হাজার।’
ভাড়াশিমলায় এই ব্যবসার শুরুর আগে কিছুদিন ঢাকায় এবং বছর চারেক যশোরে ছিলেন। সেইসময় তার সঙ্গী ছিল এক এতিম ছেলে, নাম রানা। মেয়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরে তিনি একই গ্রামের সদ্যোজাত রানাকে নিজের কাছে নেন এবং তাকে সন্তানের মতো মানুষ করেন। তার মাও ছিলেন ফজিলার সঙ্গে। রানার বাবা-চাচারা বেশ পয়সাওয়ালা হলেও তাদের দেখাশুনা করতো না।
ফজিলা বলেন, ‘তিন ছেলেকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছি। এখন তারা সব বিয়ে-শাদি করে আলাদা হয়ে গেছে। মায়ের কোনো খবর নেয় না।’
স্বামী থাকেন তার এক নাতির সংসারে। মাঝেমধ্যে তার এই ঘরে এসে থাকেন, খাওয়া-দাওয়া করেন না। কোনো টাকা-পয়সাও দেন না অথবা তার কাছ থেকেও কিছু নেন না।
আট ভাইবোনের মধ্যে ছোট ফজিলার মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বাবা-মায়ের ৭-৮ বিঘা জমি থাকলেও কিছুই পাননি তিনি। প্রায় ১৫ বছর রয়েছেন একাকী। ভাইবোন, স্বামী-সন্তান কেউই খোঁজ নেন না তার। যে এতিম ছেলেটিকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেন, বছর দুই আগে বিয়ে করে সেও চলে গেছে। আগে মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নিতো। মাস আটেক হলো- তারও দেখা মেলে না।
যশোরে থাকা অবস্থায় কিস্তিতে একটি রঙিন টিভি আর ছোট একটি ফ্যান কেনেন। ভাড়াশিমলায় এই দোকান দেওয়ার পর কিস্তিতে ৪১ হাজার টাকা দামের একটি ফ্রিজ কিনতে হয়।
তিনি বলেন, ‘বাবা- শুধু বেগুনি, পিঁয়াজু, পান, বিস্কুট বিক্রি করে জীবন চলে না। আইসক্রিমের খদ্দের আসে, কোল্ড ড্রিংকসও রাখি ফ্রিজে। এসব বিক্রি করেই চলতে হয়।’
প্রতিদিন কেমন বিক্রি হয় জানতে চাইলে বলেন, ‘ওসব হিসেব রাখি না। একবেলা রান্ধি- দুইদিন তিনদিনও খাই! কখনো কখনো শুধু পান আর পানি খেয়েই কাটিয়ে দিই দিন।’
তিনি জানান, পাঁচটি সমিতি (এনজিও) থেকে ঋণ নেওয়া আছে; ফ্রিজের কিস্তি দিতে হয় মাসে এক হাজার টাকা। ঘরভাড়া মাসে ৪০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা, সমিতির কিস্তি- সবমিলিয়ে ৬-৭ হাজার টাকা মাসে খরচ।
তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারি না। হাফ লেগে যায়! পেটের ভেতর সবসময় জ্বলতে থাকে, কোমরে ব্যথা, ঘাড় কষে আসে... প্রতিদিন কিছু খাই বা না খাই ৭০-৮০ টাকার ওষুধ লাগে।’
একটু পরেই জ্বলবে উনুন। বেগুন ফালি ফালি করে কাটতে থাকেন ফজিলা, আগেই পাতলা ও সরু করে কেটে রেখেছিলেন পিঁয়াজ- এখন গোলাতে হবে বেসন। চুলোটা ঠিক করেন, কুড়িয়ে আনা পাতা আর পুরনো কাগজ দিয়ে তেল গরম করে তাতে ভাজা হবে বেগুনি-পিঁয়াজু!
জিজ্ঞাসা করি, ঈদে আত্মীয়-স্বজন মানে ছেলে, ছেলেবৌ বা নাতি-পুতিরা কেউ আসে না?
কণ্ঠটা বেশ ভারি হয়ে ওঠে তার, ‘ঈদ বলে কোনো আলাদা দিন আমার জীবনে নেই বাবা! কেউ আসে না, কথা বলে না। মাঝেমধ্যে ভাবি- বেঁচে আছি কেন? কার জন্যে এই বেঁচে থাকা...’
নিজে নিজে বিড়বিড় করেন, ‘এখানে স্কুলের বাচ্চারা দাদি বলে ডাকে, তাদের দেখি কথা বলি। মনটা ভালো হয়ে যায়। আর দিন গুনি- কবে আসবে মরণ!’

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:২৮
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×