somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুইশ’ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দয়ারামপুর ঈদগাহ

০৮ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঐতিহাসিক শেরশাহ সড়কের পাশে প্রায় দুইশ’ বছরের ঐতিহ্য যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দয়ারামপুর ঈদগাহ।
এই ঈদগাহের বিস্তৃত জায়গা জুড়ে রয়েছে সারি সারি গাছ; তাই ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে হাজার বিশেক মুসল্লি একসঙ্গে আদায় করতে পারেন ঈদের নামাজ।
বাঘারপাড়া সদর থেকে প্রায় ৭ কিমি আর নারিকেলবাড়ীয়া বাজার থেকে প্রায় এক কিমি দূরে অবস্থান এই শতাব্দী প্রাচীন ঈদগাহের। প্রায় তিন বিঘা (১০০ শতক) জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে ঈদগাহটি। এর উত্তরপাশে দয়ারামপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, পূর্বপাশে একটি মসজিদ আর পশ্চিমপাশ ঘেঁষে চলে গেছে শেরশাহ সড়ক*।
স্থানীয়রা জানান, নারিকেলবাড়ীয়া লাগোয়া মাগুরার শালিখা উপজেলার কাদিরপাড়া, গোবরা, হরিশপুর, দেয়াভাঙ্গা, হাজরাহাটি, ঝুনোরি, শতখালী, বাঘারপাড়ার ধলগ্রাম, বন্দবিলা ও নারকেলবাড়ীয়া ইউনিয়ন এবং নড়াইলের প্রায় ৩০ গ্রামের ২০ সহ¯্রাধিক মানুষ এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন।
ঈদগাহ লাগোয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আশরাফউদ্দিন জানান, ১৮১০ সালের দিকে তার দাদা পীরসাহেব ইউসুফ (রা.) এই ঈদগাহটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে অদ্যাবধি ব্যাপক আয়োজনে ঈদের জামাত হয়ে আসছে।
তার দাদা প্রথমদিকে ঈদের নামাজে ইমামতি করতেন। তার মৃত্যুর (১৯৪০ সালে) পর বড়ছেলে পীরজাদা আব্দুর রহিম ইমামতি করেছেন। উনার ইন্তেকালের (১৯৬৫ সাল) পর ইমামতির দায়িত্ব পান তার ছেলে মওলানা শামসুদ্দিন। প্রায় ২৮ বছর আগে মওলানা শামসুদ্দিন ইন্তেকাল করেন। উনার পর ছোটভাই মুফতি মওলানা ইমাদউদ্দিন দায়িত্ব পান। তিনি এখনও ইমামতি করছেন।
স্থানীয়রা জানান, এখানকার পীরবাড়ির অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। তারা বেশ কামেল ব্যক্তি ছিলেন।
পীরবাড়ির সদস্যদের নিয়ে মানুষের মুখে মুখে বেশকিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা্রচলিত রয়েছে। এখনও মানুষ সেইসব ঘটনা বিবৃত করেন।
দয়ারামপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ মো. ইয়াহিয়া আলী বলেন, এখানকার পীররা ছিলেন খুবই আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের নিজেদের জীবনেও তাদের মোজেজা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমার আম্মার একসময় বুক বেঁকে গেছিল। তখন আব্বা পীরসাহেবের (পীরজাদা আব্দুর রহিম) কাছে গিয়েছিলেন। তো পীরসাহেব আব্বাকে বলেন- বাজার থেকে একটা লাউ আর কিছু জিয়েল মাছ আনতে। অসময়ে কোথায় লাউ পাবেন- জিজ্ঞেস করতেই পীরসাহেব বলেন, হাটে যাও। আব্বা হাটে গিয়ে একটা সুন্দর লাউ পান, কিছু জিয়েল মাছও কিনে পীরসাহেবের কাছে নিয়ে যান। পীরসাহেব লাউ ‘পড়ে’ দেন, বাড়ি এসে রান্না করে আপম্মাকে খাওয়ালে তার মুখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
নারিকেলবাড়ীয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহা বলেন, এই এলাকায় পীরসাহেবের বেশ নাম ডাক ছিল। এই ঈদগাহ নির্মাণে তাদের অনেক অবদান রয়েছে। প্রতিবছর এই ঈদগাহে হাজার হাজার মানুষ জামাতে নামাজ আদায় করেন। একসময় এই ঈদগাহে শবে বরাতের সময় ওয়াজ মাহফিল হতো। সেখানে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হতো। সকালে আমরা স্কুলে গিয়ে ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করতাম।
পীরদের অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি, তিনি ভারতের ফুরফুরা শরীফের ছিলছিলার লোক ছিলেন। তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। একবার ফুরফুরা শরীফে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে অসুস্থতার কারণে পীরসাহেব ইউসুফ (রা.) সেবার যেতে পারেননি। ফুরফুরা শরীফের পীরসাহেব তার ওয়াজ শেষে যখন নামাজের ওয়াক্ত, তখন সবাইকে কাতার সোজা করে দাঁড়াতে বললেন। একইসাথে ঘোষণা দিলেন, আপনারা সবাই কাতারে দাঁড়ান, পূর্বপাকিস্তান থেকে ইউসুফ আসছেন- উনি আপনাদের ইমামতি করবেন। যারা জানতেন অসুস্থতার কারণে পীরসাহেব এবার মাহফিলে যেতে পারেননি, তারা বেশ আশ্চর্য হলেন। কিন্তু সবাইকে আরও বেশি আশ্চর্য হতে হয়েছিল, সেই নামাজে ইমামতি করেছিলেন পীরসাহেব ইউসুফ (রা.)।
ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহা বলেন, পীরসাহেবদের জমি লাগোয়া আমার বাবারও কিছু জমি ছিল। পীরবাড়ির লোকজনের আরও একটি কারিশমা হচ্ছে, রাতের বেলা তারা বাড়ি ‘বন্ধ’ রাখতেন, যাতে চুরি না হয়। তো একদিন তেমনই মন্ত্র পড়ে বাড়ি ‘বন্ধ’ করা হয়। সেইসময় বাড়িতে বেশ বড় বড় মিষ্টি কুমড়ো হয়েছিল। রাতে এক চোর এসে কুমড়ো পেড়ে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করলেও সে যেতে পারেনি। খুব সকালে পীরসাহেব উঠে দেখেন, কুমড়ো হাতে এক লোক দাঁড়িয়ে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়- কুমড়ো চুরি করে নিয়ে যেতে পারেনি, কারণ সে যেদিক থেকে বের হতে যাচ্ছে, সেদিকেই বড় বড় পুকুর দেখতে পাচ্ছে!
স্থানীয়দের মুখে মুখে আরেকটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, সেটি হচ্ছে- একবার পীরজাদা আব্দুর রহিমের কাছে কয়েকজন মুরিদ আসেন ‘দাওয়া’ নিতে। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে খাঁটি মধুর। কিন্তু মুরিদরা মধু পাচ্ছিলেন না। সেসময় তিনি মুরিদদের উদ্দেশ করে বলেন একটি বাটি নিয়ে অদূরে থাকা একটি গাছের নিচে দাঁড়াতে। কিছু সময় পর ওইগাছে থাকা একটি মৌচাক থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে মধু!
বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নামাজ আদায় করে আসছেন এই এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমার বাপ-দাদাও এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। দয়ারামপুরের এই ঈদগাহ এলাকায় আগে খুব আমগাছ ছিল। স্থানীয়রা সবাই ‘আমপোল’ হিসেবে চেনে। আর এখানকার পীরের নাম-ডাকও ছিল বেশ।
পার্শ্ববর্তী জয়পুরের বাসিন্দা ইমদাদ হোসেন জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এখানে নামাজ আদায় করেন। তার কাছে মনে হয়, যেন কুমিল্লার শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে নামাজ আদায় করছেন।
নারিকেলবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আদম আলী বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ১৪টি গ্রাম। এই গ্রামগুলোর মুসল্লিরা তো আছেনই; বাইরের মাগুরা জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকেও বহু মানুষ আসেন ঈদের জামাতে।
কত বছর আগে এই ঈদগাহের প্রতিষ্ঠা- তা বলতে পারেন না স্থানীয়রা। তবে, বাপ-দাদাদের কাছে শুনে তাদের যে ধারণা, সেটি হচ্ছে-দেড় থেকে দুইশ’ বছরের পুরনো তো হবেই।
স্থানীয় ও পীরবাড়ি সূত্রে জানা যায়, ঈদগাহের জন্যে জমি বরাদ্দ দেন সেই সময়কার বিশিষ্ট সমাজসেবী রাজেন্দ্রনাথ সাহা। তার দেওয়া জমির পরিমাণ ৩৩ শতক। স্থানীয় আরেক সমাজসেবী রহিম বক্স দেন ২৪ শতক এবং পীরসাহেব ইউসুফ (রা.) দান করেন ৪৩ শতক জমি।
(*শেরশাহ সড়ক : ১৫৪১ থেকে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২৫শ’ কিমি রাস্তা তৈরি করেন তৎকালীন দিল্লির অধিপতি শেরশাহ। সেইসময়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে যশোরের উপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্য দিয়ে এ রাস্তাটি সুদূর কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এ সড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার করলেও বাংলাদেশের অনেক স্থানে এর কোনও চিহ্ন নেই। অস্তিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র যশোরের বাঘারপাড়ায়।)

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:২৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×