মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ, একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে, থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি, তোমারি আশ্বাসে।
গানটি শুনতে শুনতে বের হলাম অফিসের উদ্দেশে। পথে হালকা দুয়েক ফোটা বৃষ্টি গায়ে পড়েছিলো। তাতে খারাপ কিছু মনে হয়নি, বরং ভালই লেগেছিলো। মন উচাটনে কতই না ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরাফেরা করছে। কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী চিন্তা নয়। লং টার্মের চিন্তা করাই যেন মুশকিল হয়ে পড়েছে। তবুও ক্ষণস্থায়ী জীবনে দীর্ঘস্থায়ী চিন্তা করতেই হয়। জ্যাম ছাড়া অফিস যেতে যতটুকু সময় লাগে ওই অল্প সময়ে যা যা চিন্তা করা যায় আর কি, ততটুকুই চিন্তা করলাম! চিন্তার বিষয়- অফিস, পড়াশুনা আর নিজে (নিজের বয়স, ফ্যামিলি, আয়-ব্যয়-জমা ইত্যাদি নানান কিসিমের চিন্তা যার শুরু বা শেষ নাই)।
অফিস গিয়ে রেগুলার কাজ করার পর ফুটবল বিশ্বকাপের যেসব ম্যাচ দেখা হয়নি সেইসব ম্যাচ দেখা এখন রেগুলার রুটিনে পরিণত হয়েছে। আর খেলা পুনঃরায় দেখার জন্য প্রায় হাফ ডজন দেশি ও বিদেশি চ্যানেল আমাকে সাহায্য করছে। আমার সময় ও তাদের সময় যদি কখনও না মিলে তাহলে ইউটিউবতো আছেই।
অফিস শেষে সন্ধ্যায় থাকে এমবিএ-এর ক্লাস। কয়েকদিন ভালোভাবে যেতে না যেতেই মিডটার্ম হাজির। তার আগে সেমিস্টারের প্রতিটি বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার চাপ। এগুলো নিয়ে চিন্তা করিনা, কিন্তু টেনশনতো একটু একটু হয়েই থাকে তাইনা! ক্লাসমেটের সাথে ভাগাভাগি করে গ্রুপ করে অ্যাসাইনমেন্ট ইতিমধ্যে করে ফেলেছি, স্যারদের কাছে এখন শুধু জমা দেয়ার বাকি।
এক স্যার আছেন, অসাধারণ জ্ঞানী, অনেক কিছু জানেন, ওনার বিষয়টাও বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু ওনার ক্লাসে সবাই কেন যেন চুপচাপ হয়ে যান। কি যে কারিশমা, সেই স্যারেই জানেন কিংবা যারা চুপচাপ থাকেন তারা জানেন! দয়া করে সেই স্যার বা সেই সাবজেক্টের নাম জিজ্ঞেস করবেন না। আর যদি কারো জানা থাকে তাহলে উল্লেখ করবেন না। প্লিজ। কারণ এখানে আমার স্যারের ও আমার উভয়ের মানসম্মান জড়িত।
ক্লাস ব্রেকে বের হয়ে কি খাবো তা ঠিক করার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। দোকানে লুকিয়ে নিজেকে পুরোপুরি রক্ষা করা যাবে না তাই দৌড় দিয়ে আবারো ক্লাসে ফিরে যেতে হলো। এতে প্রিয় পুরুষ বা মহিলা ক্লাসমেটদের সাথে আড্ডা দিয়ে স্নাক্স খাওয়া হলোনা। ক্লাসে ঢুকে আবারো সেই হাঁসফাঁস!
ক্লাস শেষে যখন বের হলাম বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছিলো। জটলা করে দাঁড়িয়ে আছি অনেকেই, শুধু তাঁরাই সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো যাদের প্রাইভেট গাড়ি বা প্রাইভেট/লোকাল গার্জিয়ান আসছিলো। মহিলাদের গার্জিয়ানরা অতিশয় ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছিলো, কারণ হুট তোলা রিক্সায় প্রথমে মহিলা জন, পরে পুরুষ জন উঠে পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঢাকা দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আর এই টুকু কাজে কেউ কাউকে দোষারোপ করছিলেন না, কত সুন্দরভাবে চলে যাচ্ছিলেন। তাই পুরুষদের ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছিলো। অভদ্র হলে নিশ্চয়ই ভুলের অন্ত থাকতো না।
দাড়িয়ে থেকে দেখতে থাকলাম নানান রঙ ও রুপের পুরুষ ও মহিলাদের। এমন করে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আর এর ওর পাশে তাকাতে ও তাদের গল্প বা কথাবার্তা শুনতে ভালই লাগছিলো। এরই মধ্যে এক জনের কাঁধ দেখে মনে হলো বডি লোশান বা বিউটি স্যোপের এ্যাড যদি এনাকে দিয়ে করানো হয় দারুণ হবে, জয়া আহসানের চেয়ে ভালো লাগবে। উচ্চতা বেশ ভাল, দেখতে শুনতেও ভালো, সেই জটলায় এমন পুরুষ মহিলার অভাব নেই। কিন্তু তাঁদের দিয়ে কাকে কোন ক্যারেক্টার করাবো, কিই বা বানানো এই ভাবনাও বেশিক্ষণ ভাবতে পারলাম না।
বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে পড়লাম আমার টাট্টু ঘোড়া নিয়ে। মনে পড়লো চার্লি চ্যাপলিনের সেই বাণী, আই ওলোয়েস লাইক ওয়াকিং ইন দ্যা রেইন, সো নো ওয়ান ক্যান সি মি ক্রাইং। সঙ্গিনীর সাথে রিক্সায় না উঠতে পারার দুঃখে নয়, সুন্দরী মহিলার কাঁধ দেখেও নয়, তবুও মনটি কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলো। সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম, বৃষ্টিও হচ্ছিলো, চাকা দিয়ে পানি উঠে আমার পিঠ ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। জানি পানি নয়, যা উঠছে সেসব কাদা। তবুও ভালো, চোখ দিয়ে কাঁদার চেয়ে, চাকা দিয়ে কাদা ওঠা অনেক ভালো। পুরো রাস্তা গুণগুণ করতে করতে বাসা ফিরলাম, কেন এই গানটি গাইছিলাম, কার উদ্দেশে গাইছিলাম তাও জানিনা!
ভালবেসে চলে যেও না, ভালবেসে চলে যেতে নেই
পথ ছেড়ে যেতে পার দূরে, অভিমানে দেবে পারি পুরোটা সাগর
ঢেউয়ে ঢেউয়ে গোধূলিতে সেও ফিরে ফিরে
জ্যোৎস্নার দীপালীতে ব্যাথা গুলো... মুছে গেছে আর যেন নেই নেই
মুছে গেছে আর যেন ব্যাথা নেই।
(ছবি সংগ্রহীত)