রাজনীতিকে সুস্থ শালীন করতে হবে
‘নাকে খত দিয়ে থুতু চেটে খেয়ে নির্বাচনে আসতে হচ্ছে, এ ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই’-এটা যদি একজন রাজনৈতিক নেতার ভাষা হয় তবে ভদ্রলোক কাকে বলে আমাদের জানা নেই। এই ভাষা উচ্চারিত হয়েছে একটি আলোচনা সভায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে। বক্তার প্রতিপক্ষ দলটি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারাই যখন আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে তখন বক্তার দল থেকে এ রকম খোঁচাখুঁচি, উপহাস, ঠাট্টামস্করা করে বিভিন্ন উক্তি ও বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তা করছেন দায়িত্বশীল, উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতারাও। এটা যে একতরফা হচ্ছে তা নয়। কম আর বেশি, উভয় পক্ষ থেকে দেশবাসী এ রকম ভাষা ব্যবহারের নমুনা পাচ্ছে। এমনকি শীর্ষস্তরেও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হচ্ছে। সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী ৩৭ মিনিটের ফোনালাপ তো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। গত অক্টোবর মাসে তা হয়েছিল নির্বাচন নিয়ে উদ্ভূত তীব্র রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের চেষ্টায় সর্বশীর্ষ দুই নেত্রীর মধ্যে যোগাযোগকে কেন্দ্র করে। সংলাপে বসার আমন্ত্রণ ও তা প্রত্যাখ্যান। একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব অপরপক্ষ প্রত্যাখ্যান করতেই পারে। এর রাজনৈতিক শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার ভিন্ন। কিন্তু ওই প্রত্যাখ্যানের ভাষা জনগণের কাছে শ্রুতিমধুর ছিল না। আর ওই কর্কশ ভাষার পরিণামে সাম্প্রতিক রাজনীতিতে অনেক রক্তপাত ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছে। হয়তো দেশের সংঘাতময় রাজনীতির যে চরিত্র তারই প্রতিফলন ঘটছে ভাষায়। তাই আমরা ‘গোপালি’ ও ‘গোলাপি’ দুই শব্দই উপহার পেয়েছি।
রাজনৈতিক মতবিরোধ ও তর্ক-বিতর্কে তির্যক, রসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহার নতুনও নয়, অনভিপ্রেতও নয়। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতির আবহে তা অনেক সময় জনগণের কাছে উপভোগ্যও হয়ে ওঠে। আমাদের ইতিহাসে অনতিদূর অতীতে লিজেন্ডারি নেতারা এমন দৃষ্টান্ত রেখেছেনও। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আছে এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমাদের বর্তমানে যা ঘটছে তা রসাত্মক নয়, বরং অশালীন ও শত্রুভাবাপন্ন। এবং তা রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে কোনো অবদান তো রাখেই না, উল্টো ঘনীভূত করে।
বিগত সংসদের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলটি গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে বর্জন করেছে তা যেকোনো বিচারে গুরুতর বিষয়। বিতর্কিত পরিস্থিতিতে একটি একতরফা নির্বাচন যে হয়ে গেছে তাতে যে পক্ষ তা অনুষ্ঠিত করতে পেরেছে ও বিজয়ী হয়েছে তাদের আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চিত হয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর অবস্থা আছে বলেও আমরা মনে করি না। অবশ্যই নতুন সরকারের এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হচ্ছে দেশে স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, সন্ত্রাসী শক্তিগুলোকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা, ধর্ম-সম্প্রদায়গত সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করা, ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা ইত্যাদি। এসব কাজের জন্য দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে যাতে শান্ত স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে সেটাই কাম্য। এসব কাজ সমাধা করার জন্য সরকারের শত্রু না বাড়িয়ে বরং নির্বাচন বর্জনকারী শক্তিগুলোরও সহযোগিতা কীভাবে পাওয়া যায় সে চেষ্টা হওয়া উচিত। তাই ক্ষতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেরামত করে ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সে-মতো আচরণ ও কাজ করা উচিত। খোঁচাখুঁচি, বিদ্রূপ, শত্রুতা পরিত্যাগ করে যাতে নির্বাচনকালীন সর্বজনগ্রাহ্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা স্থায়ী করার জন্য সংলাপে বসা যায় সে-পথেই সরকারি দলের হাঁটা উচিত। আমরা মনে করি ‘পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবই’ দম্ভোক্তি ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজানো এবং ‘দ্রুততম সময়ে আরেকটি নির্বাচন’ ছাড়া আর কিছুই চোখের সামনে নেই-এই দুই অবস্থানই ভুল। - See more at: Click This Link