‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন
কাণ্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
কবির এই কবিতা লেখার পর কেটে গেল অনেক বছর। জীবনের শেষপ্রান্তে বাকরুদ্ধ কবি কাজী নজরুল ইলাম তাঁর এই স্বপ্নকে বাস্তবে দেখে যেতে পারেননি। তিনি দেখে গেছেন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, দেখেছেন দাঙ্গা। আমরাও দেখেছি বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে একই ভাষাভাষি দুটি স¤প্রদায়ের মানুষের আলাদা হয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে কোথাও যেন মিলনের সুর লুকিয়ে আছে, যা চন্ডীদাসের কথায়, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই।
শহর কলকাতা কখনও মিছিল নগরী, কখনও বা মুমুর্ষু নগরী, অনেক নামেই অভিহিত হয়েছে বারবার। তবে এই শহরেই সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির মহামিলনের সুর লুকিয়ে আছে তা একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। শারদীয়া দুর্গাপুজোয় যখন থিম নিয়ে মাতামাতি চলছে, তখন তার বাইরে বেরিয়ে, খোদ কলকাতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গেল এমন একটি পুজো, যে পুজোর খবর অনেকের কাছে অজানা।
দণি কলকাতার নিষিদ্ধপল্লীর এক কোণে নিভৃতেই ১৯৮৩ সাল থেকে এই বারোয়ারি পুজোটি হয়ে আসছে। আর পাঁচটা বারোয়ারি পুজোর মতো আলাদা করে বলার কিছু নেই। তাহলে কেন এত ভমিকা? কারণ এই পুজোটি করেন মুসলমানরা। শুধু তাই নয়, এই পুজোর প্রধান পুরোহিত একজন মুসলিম। তবে প্রথম থেকেই এই রীতি ছিলো না।
মুন্সিগঞ্জ ফাইভ স্টার কাব ঈদের পাশাপাশি দুর্গাপুজো ও সরস্বতী পুজোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে করে থাকে। কোনও এক সময় এই অঞ্চলে বেশ কয়েক ঘর হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল। কালের প্রভাবে তারা আজ নেই। তাই বলে কি পুজো বন্ধ হবে? না তা হয়নি। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা ও পুরোহিত শেখ জাহাঙ্গির বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসা আনন্দ উৎসবে আমরা সামিল হতে পারব না। তাই আমাদের এই পুজো। ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি এই পুজোর কাজ পরিচালনা করেন যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে। জাহাঙ্গির বলেন, আমাদের কাবে যিনি প্রথমে পুজো করতেন সেই হিন্দু পুরোহিত বয়সের ভারে দশ বছর আগে পুজো করা বন্ধ করে দেন। তখন থেকেই আমার কাকা শাহিদ আলি এই পুজোর ভার নেন। পুজোর প্রতিটি খুঁটিনাটি উপাচার তিনি সংগ্রহ করতেন। পেশায় ব্যবসায়ী আমার কাকা অবসর সময়ে পন্ডিত ব্রাহ্মণদের কাছে গিয়ে পুজোর নিয়ম ও শুদ্ধ উচ্চারণে মন্ত্রপাঠ শিখতেন। তিন বছর পুজো করার পর উনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে আমি তাকে সঙ্গ দিতাম। তার কাছ থেকেই সবকিছু শিখে নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে আমি এই দায়িত্ব নিয়েছি।
কোনও আপত্তি আসেনি-প্রশেÐর জবাবে দৃঢ়ভাবে জাহাঙ্গির বললেন, না। কেউ তো কখনও কোন আপত্তি করেননি। আমাদের বাড়িতে মহালয়ার দিন থেকে কোনও আমিষ খাবার রান্না হয় না। পুজোর চারটি দিন কাকার মতো আমিও উপবাস করে পুজোর কাজ সমাধা করি। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের বিভিন্ন ভাতের হোটেলগুলিতেও এই সময় কোনও আমিষ খাবার রান্না হয় না। আমরা তাদের জোর করিনি। তবে তারা নিজেরাই এই নিয়ম তৈরি করে ফেলেছেন। কাবের পাশেই একমাত্র হিন্দু পরিবার কুমোর রাম পালের বাড়ি। তিনি এই পুজোয় প্রতিমা তৈরি করে আসছেন বরাবর। রাম পাল বলেন, রমজান মাসে ৩০টি রোজা রেখে এবং নিয়মিত নামাজ পড়েও জাহাঙ্গিরের কাকা শাহিদ নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর কাজ করতেন। এখন জাহাঙ্গির করে। সবাই তো আমরা ঈশ্বর-আল্লাকে কাছে পেতে চাই। রাস্তা হয়তো ভিন্ন, কিন্তু দুই রাস্তাতেই যদি কেউ হাঁটেন তাহলে আপত্তি কোথায়। এটা বুঝেই বোধহয় কোনও আপত্তি আসেনি আজও। স্থানীয় মসজিদ থেকেও ইমাম সাহেবরা কোনও আপত্তি করেননি। বরঞ্চ তাঁরাও পুজোর দিনগুলিতে এসে উপস্থিত হন। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের মুসলিম মহিলারাও নতুন শাড়ি পরে পবিত্রতার সঙ্গে পুজোর কাজে হাত লাগান। শান্তি বেগম জানালেন, মা আসছেন। সবাই তো মায়ের সন্তান। তাই আমরাও মায়ের পুজোর আনন্দে মেতে উঠি এই কটা দিন। তিনি বললেন, শাহিদ একবার পুজোর সময় পঞ্চশস্য ঠিকমতো না পেয়ে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আরও একবার মায়ের খড়্গ বাম হাতে পরানো হয়েছিল বলে রেগে গিয়ে বলেছিল, তোমরা কিছুই জানো না, মায়ের বাম হাতে নয়, খড়্গ ডান হাতে থাকে। প্রথম প্রথম একটু লজ্জা লাগলেও এখন মনে হয়, পাড়ার এই পুজোটা না থাকলে পুজোর দিনগুলো কিরকম অন্ধকার হয়ে যাবে আমাদের কাছে। তাই আমাদের কাছে বছরে তিনবার উৎসব আসে দুটো ঈদ আর দুর্গাপুজো। এই নিয়েই আমরা খুশি।
গোটা উপমহাদেশ জুড়ে যখন ধর্মীয় হানাহানিতে রক্তাক্ত আমরা, ঠিক তখনই কলকাতার মধ্যে কিছু মানুষ অদ্ভুত এক সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষের কথায়, ‘এই কলকাতার মধ্যেই আছে আর একটা কলকাতা/ হেঁটে দেখতে শেখো।’