সময় খুব সম্ভব ১৯৬৯ -১৯৭০ সন হবে। আমরা তখন মিরপুর পল্লবি থাকি। স্কুল শেষে বাসায় ফিরে গোসল করে ভাত খাওয়ার পর আর কোনো কাজ নেই। দুপুরে আমাদের ঘুমোতে হতো - এটি কঠিন নিয়মের আওতায় ছিলো। ক্লান্ত দুপুর শেষে আমাদের সাধারণত খুব মিষ্টি টুন টুন শব্দে ঘুম ভাঙ্গতো। এক অন্ধ বিহারি লোক তার ১২-১৪ বছরের অপরূপ সুন্দরী দুই কন্যা সন্তান নিয়ে একটি কাঠের তৈরি দোতলা ঠেলাগাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসতেন। দোতলায় হাওয়াই মিঠাই বানানোর সরঞ্জাম আর নিচ তলায় এক পকেটে কেরোসিনের কুপি আর তার নিচে গম ও চালের বস্তা। কুপির আগুনে গরম হতো চাকতি আর তাতে তৈরি হতো অত্যন্ত মজাদার হাওয়াই মিঠাই। ইনি গম ও চালের বিনিময়ে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করতেন। সে এক দেখার মতো গাড়ি ছিলো - সুন্দর লতাপাতা ও ফুলে আঁকা রঙ্গিন কাঠের ঠেলাগাড়ি, আর এক পাশে ঝুলে থাকতো পিতলের টুন টুন ঘন্টি। কেউ কেউ এক আনা দুই আনা দিয়েও মিঠাই কিনতেন। টাকা পয়শার তখন অনেক দাম। কেরোসিনের দাম ছিলো ৬ আনা ৭ আনা করে সের (এক সের বর্তমানের এক লিটার সমমান) আর ৬ আনা - ৭ আনা হচ্ছে বর্তমানের প্রায় চল্লিশ পয়শার সমমান।
অন্ধ বিহারি হাওয়াই মিঠাই তৈরি করতেন আর তার দুই অপরূপ কন্যা আমাদের থেকে গম, চাল নিয়ে তাদের রঙিন চুরি পরা সোনালি হাতে হাওয়াই মিঠাই দিতেন। তারা দুই বোন আমাদের ভাইয়ু বলে ডাকতেন। সত্যি বলতে কি এতো মজাদার হাওয়াই মিঠাই আমি আমার জীবনে খাইনি। না, সেই অপরূপ সুন্দরী বোনদের জন্য নয়! আসলেই সেই অন্ধ বিহারি খুবই মজাদার হাওয়াই মিঠাই বানাতেন, মুখে দিলে সাথে সাথে মিশে যেতো কিন্তু স্বাদ থেকে যেতো সারা বিকাল।
অন্ধ বিহারি আর তার দুই কন্যা ঠেলাগাড়ি ঠেলে ঠেলে উর্দূ বাংলা মিশ্রিত একটি গান গুনগুন করে গাইতেন। আমার সেই গানটি পুরোপুরি মনে নেই তবে বাংলা কথামালা গুলো আমি সাজিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।
তুমি দেখাও তাই আমি দেখি
তুমি চালাও তাই আমি চলি
তুমি খাওয়াও তাই আমি খাই
ইয়া আল্লাহ ইয়া পাক পরোয়ার দিগার
তুমি রিজিকদাতা তুমি জীবনদাতা
উপসংহার: ১৯৭১ এর যুদ্ধে হাওয়াই মিঠাই অনেক দুরের কথা মানুষের ঠিক ঠিকানার চিহ্ন ছিলো না! সেই চিহ্ন না থাকার মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন অন্ধ বিহারি ও রঙিন কাঁচের চুরি হাতের অপরূপ সুন্দরী তার দুই কন্যা। এক সময় দেশ স্বাধীন হয়েছে মানুষ যার যার নীড়ে ফিরেছেন, কিন্তু আমার সেই দুই বোনকে আর কোনোদিন দেখিনি। আর কোনোদিন ক্লান্ত দুপুর শেষে ঘুম ভাঙ্গেনি মিষ্টি টুন টুন শব্দে। আর কোনোদিন অন্ধ বিহারিকে তার দুই পাশে অপরুপ দুই কন্যা নিয়ে গুনগুন করে গান গেয়ে পথ ধরে হেটে যেতে দেখিনি। আজো তার গানের কথা মনে পরে, মনে পরে তার হাতে তৈরি আমার জীবনে খাওয়া শ্রেষ্ট হাওয়াই মিঠাই। আর মনে পরে আমার সেই অপরূপ দুই বোনকে যারা আমাদের পরম মমতায় ভাইয়ু বলে ডাকতেন।
উৎসর্গ: আমার আজকের স্মৃতি “হাওয়াই মিঠাই” লেখাটি উৎসর্গ করছি প্রিয় ব্লগার খায়রুল আহসান ভাইকে। যার যৌথ প্রয়াস (অনুবাদ কবিতা) পড়ে আমার আজকের এই স্মৃতিচারণ ও আজকের পোস্ট।
ছবি: গুগল সার্চ ইঞ্জিন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহোয়্যারইন ব্লগ। নির্বাচিত পোষ্টে “উক্ত লেখাটি” স্থান দেওয়াতে সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:৫২