কনকনে শীতের রাতে চাটগাঁ থেকে ছেড়ে আসা রাতের শেষ ট্রেন চিটাগাং মেইল ধরে রাতের ঘন কুয়াশা ভেদ করে ভোর সকালে ঢাকায় যিনি পৌছেছেন তার পোশাক-আশাক তেমন কোনো সুসজ্জিত নয়। তবে দীর্ঘদেহী সেগুন কাঁঠ রঙা আগন্তুক চোখে পড়ার মতোই একজন মানুষ বটে।
ঢাকাস্থ একটি বিদেশী দূতাবাস অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ভিসা অফিসারের সামনের চেয়ারে বসে আছেন আগন্তুক। ভিসা অফিসার নিরব, আগন্তুকও নিরব। ভিসা অফিসার জুলিয়ার বয়স ৫৫-৫৭ হবে। তিনি ঢাকা পোস্টিংয়ের পূর্বে দিল্লি পোস্টিং ছিলেন। তিনি উপমহাদেশের মানুষ বেশ ভালোভাবেই চেনেন। তিনি মানুষ দেখে অনেক কিছুই বুঝতে পারেন। জুলিয়া এক মনে পাসপোর্ট ও ডকুমেন্টস দেখছেন। আগন্তুকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জুলিয়া জানালেন অফিসে ইন্টারকম চালু আছে। জুলিয়া ও আগন্তুক যা যা কথা বলবেন ফার্স্ট সেক্রেটারি তা শুনতে পাবেন। আগন্তুক জুলিয়ার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে আগন্তুক বিষয়টি জানেন। জুলিয়া জানালেন তাঁর কি কোনো দোভাষীর প্রয়োজন আছে? আগন্তুকের ছোট্ট উত্তর - না, আমার কথা আমি নিজে বলতে চাই। সময় - ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৭২।
- পড়ালেখা করার মতো কি তোমার পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা পয়সা আছে?
- না, আমি কৃষকের ছেলে, আমার তেমন টাকা পয়সা নেই।
- তাহলে পড়ালেখার খরচ বহন করবে কিভাবে?
- আমি পড়ালেখার পাশাপাশি একটি কাজ যোগার করে নিবো।
- কি ধরনের কাজ তুমি করতে পারবে?
- আমি কৃষিকাজ পারি, আমি দক্ষ একজন কৃষক।
- এছাড়া আর কোনো কাজ জানা আছে, যদি এগ্রিকালচারে কাজ না পাও তাহলে কি করবে?
- এছাড়া আর কোনো কাজ জানি না, আমি এগ্রিকালচারে কাজ পেয়ে যাবো।
- এগ্রিকালচারে কাজ না পেলে পড়ালেখার জন্য টাকা পয়সা কিভাবে উপার্জন করবে?
- আমি দেশে চলে আসবো।
জুলিয়া আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেন - তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি এগ্রিকালচারে কাজ না পেলে দেশে চলে আসবে?
আগন্তুকের ছোট্ট কিন্তু পরিস্কার উত্তর - তুমি সঠিক শুনতে পেয়েছো, “আমি দেশে চলে আসবো”।
জুলিয়া সাধারণত ভিসা আবেদনকারীদের সাথে হেসে কথা বলেন না। জুলিয়া হেসে আগন্তুককে জানান তুমি বসো, আমি আসছি। জুলিয়া ভেতরের রুমে চলে যান। তিন মিনিট পর ভিসা অফিসার জুলিয়া ফিরে এসে আগন্তুকের হাতে একটি স্লিপ দিয়ে জানালেন আগামী পরশু ডিসেম্বর ১৪, ১৯৭২। বিকাল চারটায় তোমার পাসপোর্ট দেওয়া হবে।
১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭২। বৃহস্পতিবার। বিকাল চারটা বেজে দশ মিনিট। জুলিয়া আগন্তুকের হাতে পাসপোর্ট দিয়ে জানালেন তোমার জন্য শুভেচ্ছা, তোমাকে ভিসা দেওয়া হয়েছে। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি জানো, তুমি দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের মতো? জর্জ হ্যারিসন তোমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য গান করেছেন। আগন্তুক এই প্রথম জুলিয়ার দিকে চোখে চোখ রেখে জানালেন - আমাদের এলাকায় টেলিভিশন নেই, আর আমি পত্রিকা পড়তে পারি না। আমার চোখে কিছু সমস্যা আছে, মনে হয়।
পরিশিষ্ট: মহান শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের সাথে আগন্তুকের কখনো সামনা সামনি দেখা হয়েছে নাকি হয়নি, পরিচয় আছে নাকি নেই তা গল্পে অপ্রকাশ্যই থাকুক। গল্পের আগন্তুককে আমরা চিনি। আগন্তুক আমাদের পূর্ব পরিচিত, তাঁর সাথে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে লেখালেখি করছি, তিনিই উক্ত গল্পের একজন গাজী - আমাদের “গাজী সাহেব”। এটি নিতান্ত একটি গল্প মাত্র। গল্পের সাথে সাধারণত বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না। আর মিল থাকলেও কিছু করার নেই। গল্প অর্থ গল্প।
ছবি: George Harrison The Concert For Bangladesh
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ২:২৬