
তিয়াত্তর দিন পর বাবার চিঠি পেলেন সোলেমান খন্দকার।
তিন মাসের তাবলীগ সফরে বেড়িয়ে সোলেমান খন্দকারের বাবা শাহাদাৎ খন্দকারের এটাই প্রথম চিঠি,
চিঠিতে পরিবারের কুশলাদি জানতে চেয়ে নিজের আর্থিক সংকট ও বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করেছেন তিনি।
বর্তমানে আছেন টাঙ্গাইলের কোন এক মসজিদে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ আছে আগামী মাসের অমুক তারিখে তাদের তাবলীগ দল কাকরাইল মসজিদে পৌঁছাবেন ছেলে সোলেমানকে সেখানে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন।
এবং যত দ্রুত সম্ভব সোলেমান যেন খরচের টাকা পাঠান।
শাহাদাৎ খন্দকার (সোলেমানের বাবা) গাজীপুর জেলার বাঙ্গুরা গ্রামের সচ্ছল ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন।
বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, এখনও শক্তসমর্থ চেহারার।
সারাজীবন সংসারে পরিশ্রম করে, শেষ বয়সে সন্তানদের হাতে সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে এখন শান্তির খোঁজে তাবলীগ সফরে বেড়িয়েছেন।
তাবলীগের সফর সঙ্গী ছিল মোট ১১ জন, এদের মধ্যে শাহাদাৎ খন্দকারের চাচাতো ভাই ছাড়া বাকি নয়জন ছিল বিভিন্ন জেলার অচেনা-অজানা অপরিচিত মানুষ।
লেখাপড়া না জানায় শাহাদাৎ খন্দকার চিঠি লেখার জন্য উনার চাচাতো ভাই নবিয়ার রহমানের সহযোগিতা নিতেন।
(নবিয়ার রহমান ছিল লেখাপড়া জানা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)
একদিকে সমবয়সী চাচাতো ভাই, অন্যদিকে দলের সবচেয়ে কাছের মানুষ; সেজন্য সবসময় ভরসা করতেন।
উক্ত চিঠিতে নবিয়ার রহমান শাহাদাৎ খন্দকারের মতই তার জন্য ছেলেদের টাকা পাঠাতে বলেছেন।
পাড়া-পড়শী হওয়ায় সোলেমান খন্দকার মারফত নবিয়ার রহমানের ছেলেরাও পিতার আর্থিক সংকটের কথা জানতে পারলেন।
একই সাথে একই মসজিদে আছেন শাহাদাৎ খন্দকার ও নবিয়ার রহমান,
তাই আলাদা আলাদা চিঠি না লিখে যত দ্রুত সম্ভব
সোলেমান খন্দকার ও নবিয়ার রহমানের বড় ছেলে একটা চিঠিতেই টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরিবারের ভাল খবরাদী জানিয়ে, টাকার অংকে লিখে দিলেন 'শাহাদাৎ খন্দকারের পুত্র সোলেমান খন্দকার পাঠিয়েছে দেড় হাজার টাকা ও নবিয়ার রহমানের বড় ছেলে শমসের পাঠিয়েছে আট শত টাকা'
মোট তেইশ শত টাকার মধ্যে নিজেদের ভাগ যেন ভাগাভাগি করতে অসুবিধা না হয় তাই সহজ সমাধান।
চিঠি পৌঁছে গেল টাঙ্গাইলের পোস্ট অফিসে, চিঠিতে নবিয়ার রহমানের নাম লেখা থাকায় চিঠি পেলেন নবিয়ার রহমান।
চিঠি দেখতে পেয়ে শাহাদাৎ খন্দকার নবিয়ার রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন তার ছেলে টাকা পাঠিয়েছেন কিনা? বাড়ীর কি খবর?
জবাবে, নবিয়ার রহমান বাড়ীর খবর জানালো বটে কিন্তু সোলেমান খন্দকারের দেড় হাজার টাকা পাঠানোর বিষয়টি গোপন রেখে হতাশ গলায় জানালো তার ছেলে কোন টাকা পাঠায়নি!
এদিকে তাবলীগে এসে আর্থিক সংকটে কঠিন সময় পার করছেন শাহাদাৎ খন্দকার,
সোলেমান মার্জিত ভদ্র ও পিতার অনুগত সন্তান;
উচ্চ শিক্ষিত চাকুরী করে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে।
তার তো টাকা না পাঠানোর কথা নয়।
তবুও একান্ত যদি গোয়ার্তমি করে টাকা না পাঠিয়েই থাকেন তাহলে তাবলীগ থেকে ফিরে
ছেলেকে কঠিন শাস্তি দিবেন মনে মনে তাও প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি।
টাকার অভাবে কাপড় কাঁচার সাবান এমনকি গোঁফ পর্যন্ত ছোট করতে পারলেন না।
তাবলীগের খাবার তহবিলে তিনমাসের
খাবার টাকা আগেই দিয়ে রেখেছেন বলে লজ্জায় পড়তে হয়নি তবে টুকটাক খরচের জন্য তিনি ভিতরে ভিতরে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।
আত্মসম্মানের চিন্তা করে তিনি সঙ্গীদের কারো কাছে টাকাও ধার করলেন না,
ভাবনা ছিল ছেলে সোলেমান যদি ঠিক তারিখে টাকা নিয়ে কাকরাইল আসতে না পারে তাহলে ধার শোধ করবেন কিভাবে?
আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়েছেন, আছেন আল্লাহর ঘরে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর উপরেই ভরসা করে রইলেন তিনি।
অপরদিকে নবিয়ার রহমান চিঠি পাওয়ার পর থেকে শাহাদাৎ খন্দকারকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছেন,
তাবলীগ সঙ্গীদের কানাকানি থেকে জানতে পারলেন নবিয়ার রহমান রাজার হালে টাকা খরচের পাশাপাশি সঙ্গীদের অনেককেই টাকা ধার দিয়েছেন!
অথচ চাচাতো ভাই শাহাদাৎ খন্দকার আর্থিক সংকটে আছেন জেনেও তাকে সহযোগিতার কথা ভাবেননি কেন? তার কোন সন্তুষ্ট জবাব তিনি আন্দাজ করতে পারেননি।
খটকা লাগল তার মনে-
তাবলীগ তো সবাইকে সবার কষ্ট ভাগাভাগি করে চলতে বলে,
তবে কি তা মৌখিক? তাবলীগ সঙ্গীদের বেলায় হয়ত নিয়মের ভিন্নতা আছে।
এগুলো ভেবে ভেবে কাকরাইল মসজিদে যাওয়ার দিন এসে গেল, কেটে গেছে ১৭ দিন।
শাহাদাৎ খন্দকার আর্থিক সংকটে আছেন সেই কথাটা একজন তাবলীগ সঙ্গী জেনে গোপনে টাঙ্গাইল হতে কাকরাইল যাওয়ার পরিবহন ভাড়া তিনিই শাহাদাৎ খন্দকারকে দিয়েছিলেন নিঃশর্তে।
অথচ কাছের মানুষ চাচাতো ভাই নবিয়ার রহমান একটি বারও ভুল করে জিজ্ঞেস করল না- কিভাবে যাবেন, কি বিষয়াদী কোন কিছুই না।
অথচ চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ছিল সেই পরিচিত চাচাতো ভাই, চিঠি পাওয়ার পর আচরণ বদলে হয়েছেন কোন মহারাজ-
শূন্য পকেটের প্রজার সাথে কথা বলতে নারাজ।
তপ্লা-তাপ্লি নিয়ে তাদের তাবলীগ দল যখন কাকরাইল মসজিদে পৌঁছালেন শাহাদাৎ খন্দকার দেখলেন তার ছেলে সোলেমান খন্দকার তার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
পিতাকে দেখে আঁতকে উঠলেন সোলেমান খন্দকার,
চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে তার;
বাবাকে চেনা যায় না!
ধুলোয় যেন গড়াগড়ি দিয়েছেন, উসকো খুশকো চুল গোঁফে উপরের ঠোঁট ঢেকে গেছে প্রায়।
যেন পথের পাগল এই মাত্র স্মৃতি শক্তি ফিরে পেয়ে রাস্তা থেকে উঠে এল।
মনের ভাব গোপন রেখে শাহাদাৎ খন্দকার কাছে আসতেই সালাম জানিয়ে সোলেমান খন্দকার পিতাকে প্রথম যে কথাটি জিজ্ঞেস করল তা হল:
আব্বা আপনার এমন অবস্থা ক্যাঁ?
ধূলায় ভরা লোকাল বাস হইয়া আইলেন, আপনের কাছে একটা সাবান কেনারও পয়সা আছিল না?
ছেলেকে দেখতে পেয়ে শাহাদাৎ খন্দকার ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড খুশি হয়েছেন!
ভুলে গেলেন অতীতের কঠিন শাস্তির প্রতিজ্ঞাবাক্য।
কন্ঠে দরদ মেখে বললেন: বাবারে টাকা নাই, কি করমু তুমি টাকা পাঠাইছিলা?
এবার চোখে অশ্রু টলটল করে উঠলো সোলেমানের:
কি কন আব্বা নবিয়ার কাকা চিঠি পায় নাই?
কৌতূহলে জবাব দিলেন শাহাদাৎ খন্দকার:
হ, পাইছিলো। হ্যার পোলায় তো টাকা পাঠায়ছিল তুমি বলে পাঠাও নাই?
টাকা পাঠাই নাই? যেন আকাশ থেকে পড়লেন সোলেমান খন্দকার।
অথচ, সে নিজে চিঠি লিখে নবিয়ারের আটশো আর তার পিতার জন্য দেড় হাজার টাকা নিজ হাতে পাঠিয়েছে।
নবিয়ার রহমান যদি চিঠির টাকা পায় তাহলে তার পিতারও পাওয়ার কথা।
সোলেমান খন্দকার বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই কোন গোলমাল হয়েছে।
ঠিক তখনি তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন নবিয়ার রহমান।
নবিয়ারকে দেখেই শরীর রাগে কাঁপতে লাগলো সোলেমান খন্দকারের নিজেকে সংযত করে নবিয়ার রহমানেকে জিজ্ঞেস করলেন:
কাকা আপনের পোলায় যে চিঠিতে আপনের জন্য টাকা পাঠাইছিল অইডা আছে না?
হাঁ সূচক মাথা দোলাল তিনি অর্থাৎ চিঠিটা নবিয়ার রহমানের কাছে আছে।
ওইডা বাইর কইরা পড়েন বলল: সোলেমান খন্দকার।
ইতস্তত করে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন নবিয়ার রহমান, তিনি ধরা পরে গেছেন; খুব তাড়াতাড়ি উন্মোচন হবে তার মিথ্যা।
তাদের উষ্ণ কথাবার্তায় তাদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছে তাবলীগের বাকি সফর সঙ্গীগণ, সন্দিহান চোখে সবাই তাকাচ্ছে নবিয়ার রহমানের দিকে।
এবার তাড়া লাগালেন শাহাদাৎ খন্দকার: কি অইলো ও নবিয়ার পড়না চিঠিডা...
উপায় নেই বুঝে চিঠিটা পড়তে লাগলেন নবিয়ার রহমান।
চিঠির উপরের অংশ পড়ে 'শাহাদাৎ খন্দকারের পুত্র সোলেমান খন্দকার পাঠিয়েছে দেড় হাজার টাকা ও নবিয়ার রহমানের বড় ছেলে শমসের পাঠিয়েছে আট শত টাকা' এই লাইনটা যখন শেষ করতে যাবে তখন নবিয়ার রহমানকে থামিয়ে দিলেন সোলেমান খন্দকার।
কাকা আবার পড়েন, আবার পড়লো নবিয়ার রহমান।
এবার চিৎকার করে উঠলো সোলেমান খন্দকার:
আপনের পোলা আটশো টাকা পাঠাইলো ওইডা পাইলেন, শাহাদাৎ খন্দকারের পোলা সোলেমান খন্দকার এক চিঠিতেই দেড় হাজার টাকা পাঠাইলো ওইডা শাহাদাৎ খন্দকার পাইলো না ক্যাঁ?
আপনে এক্ষণ এই মুহুর্তে এই জায়গা হইতে দেড় হাজার টাকা আমার বাপরে দিবেন....
আমার বাপে মূর্খ মানুষ চিঠি পড়তে পারে না, আপনে সরকারি চাকরি করছেন পড়তে-লিখতে জানেন বইল্যা আমার মূর্খ বাপরে টাকা না দিয়া এই রহম ছংবং মানতাম না কাকা, কই রাখছেন টাকা? এহনেই আমার বাপরে তাত্তাড়ি দেন!
আপনে তেল চুকচুকে অইয়া ঘুরতাছেন, আমার বাপের এই অবস্থা কেন?
রাগে কাঁপতে কাঁপতে একনিশ্বাসে নবিয়ার রহমানের উদ্দেশ্য কথাগুলো বলল সোলেমান খন্দকার।
লজ্জা ভয়ে চুপসে গেছে চতুর নবিয়ার রহমান, কত জঘন্য অপরাধ করেছেন মনে মনে হয়ত তারেই হিসাব কষছেন এই মুহুর্তে।
থাম বাবা! থাম! ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে বলল: শাহাদাৎ খন্দকার।
অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলল সোলেমান খন্দকার:
আপনে মইরা যানগা আপনের মত বাপ আমার দরকার নাই...
লেখা-পড়া নাই বইল্যা মানুষ আপনারে ঠকাইলেও বুঝতে পারেন না, চোখ থাইক্কাও অন্ধের মতন।
সহজ-সরল বাপ দিয়া আমি কি করমু।
তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তাবলীগ সফর সঙ্গীদের ভিড়ে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠলো,
এবার তাদের উদ্দেশ্যে ধমক লাগালেন সোলেমান খন্দকার: ওই মিঞারা আপনেরা কিয়ের তাবলীগ করেন? আপনাগো ভিত্তে কোন সহানুভূতি নাই!
আপনাগো লগের একজন তাবলীগ মুসাফির টাকার অভাবে কাপড় ছোপড় ময়লা নিয়া ঘুরে, গোঁফ-চুল ছোট করতে পারেনা আপনাগোনটাই টাকা থাহার পরও সহায়তা করেন না এইডা কিয়ের তাবলীগ?
এইডা কোন রাসুলের (সাঃ) আদর্শ?
রাসুল (সাঃ) কি এইডা শিখাইছে? একজনের কাছে টাকা নাই তার ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য আছে বুঝলে ধার দেন, হ্যার শোধ করার সামর্থ্য নাই বুঝলে সাহায্য করেন।
তা-না আপনেরা তার পোলার পাঠানো টাকাটাই গায়েব কইরা লান.....
ততক্ষণে টানতে টানতে সোলেমান খন্দকারকে ভিড়ের বাইরে টেনে এনেছেন তার বাবা শাহাদাৎ খন্দকার।
রিকশায় চড়ে বাড়ি যাওয়ার বাস ধরতে বাসস্ট্যান্ডে যেতে যেতে ছেলেকে বলল শাহাদাৎ খন্দকার:
আমার চাচাত ভাই আমারে সহযোগিতা করে নাই মাইন্ষের কি দায় পড়ছে বাপ আমারে সাহায্য করার!?
হ্যারা বুঝে তাবলীগ ঔ তাবলীগেই, যাগো মইধ্যে একতা নাই ভাতৃত্ববোধ নাই সহানুভূতি নাই তাগো তাবলীগে আওয়াটাই আমার ভুল অইছে।
বাকি জীবন ঘরে বইয়া খাঁটি মনে আল্লাহ-ইল্লাহ করমু আল্লাহ যা করে করবো আর জীবনে আইতাম না তাবলীগে।
ভ্রু কুচকে পিতাকে প্রশ্ন করল সোলেমান খন্দকার:
নবিয়ার কাকা যে দেড় হাজার টাকা গিল্লা খাইয়া আপনারে কষ্ট দিল তার কি করবেন?
মৃদু হেসে শাহাদাৎ খন্দকার বললেন: আমি ওরে মাফ করলাম, আল্লাহ-ও তারে মাফ করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২১ দুপুর ১২:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



