মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের একাধিক শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৮ সালেও ‘অবৈধ নাগরিকদের’ বের করে দিয়েছিল মিয়ানমার। ওই সময় বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন ১১ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাস। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মহলকে এক প্রকার উপেক্ষা করে মিয়ানমার সরকার এবং বাংলাদেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্সন চুক্তি হয়।
তবে ফিরিয়ে নেওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া কিংবা তাদের নিরাপত্তারও কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরতে পারবে নাকি সেখানে তাদের ক্যাম্প বন্দী করে রাখা হবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কোনো পক্ষ থেকেই পরিষ্কার কোন বক্তব্য নেই। আরাকানে রাষ্ট্রীয় যেসব পদক্ষেপের কারণে রোহিঙ্গারা ভীতির মুখে পালাতে বাধ্য হয়েছে, তার অবসানে দেশটির সরকার এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আন্তর্জাতিক মহলের চাপের মুখে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়েছিল মিয়ানমার। কিন্তু জাতিগত নিধনের জেরে তাদের আবার পালাতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন বাস্তবতায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিয়ে জোর করে তাদের ফেরত পাঠালে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়াটা কার্যকর হবে না।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক কিছু প্রচারমাধ্যমে ইতিমধ্যে খবর প্রকাশিত প্রত্যাবর্তনের কথা শুনে মানসিক চাপে কয়েকজন রোহিঙ্গা আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলে এর মতে এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পাঠানো হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কেননা কক্সবাজার থেকে শরণার্থীরা বর্তমান বাস্তবতায় যেতে চাইছে না। আর শরণার্থীদের জোর করে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইন সমর্থন করে না। তার এই মতামত দান হুমকি দানেরই নামান্তর।
বাংলাদেশ অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে অবশ্যই মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু এও তো সত্য যে শুধুমাত্র মানবিক বিবেচনায় এত বড় একটি জনগোষ্ঠীর বোঝা বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। এজন্য দরকার সঠিক পদক্ষেপের, কাজ করতে হবে এই নির্যাতিতদের আসল অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়া করা মোটেও কাজের কাজ হবে না। সব থেকে যা বেশী প্রয়োজন সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলকে নিজেদের পক্ষে রাখা।
মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করা। তারপর তাদের বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের স্বায়ত্বশাসন দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয়েছে তার নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারের মুখোমুখি করতে হবে দোষীদের।
নতুবা ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গারা কোনো বিপদে পড়লে তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহজেই বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিবে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে , তা হারিয়ে যাবে নিমিষেই। অসহায় হয়ে পড়বে বাংলাদেশ নিজেও। আর এভাবে মিয়ানমারের সাথে চুক্তি করে, দাতা সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধীতা সত্বেও রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠালে মিয়ানমার এর সুযোগ নিবে। তারা তাদের এক ঘরে অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে। দোষারোপ করবে বাংলাদেশের প্রতি। রোহিঙ্গারা যেহেতু এই অবস্থার মধ্যে ফেরত যেতে চাচ্ছে না, বাংলাদেশেরও উচিৎ হবে না জোর করা।
আবার ‘মাথার বোঝা’ বেশিদিন বয়ে বেড়ানোও দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। অনেকেই রোহিঙ্গাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে বরাবরই সরকার এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রেও আমরা এই ধৈর্য দেখতে চাই। না হলে কূটনৈতিকভাবেও ঝুঁকিতে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। আশা করি ধৈর্য ও কৌশলের পরিচয় দিয়ে সরকার এই ঝুঁকি থেকে দেশকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবে।
-সাদাত মোহাম্মদ সায়েম
শিক্ষার্থী, গাইবান্ধা।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৫০