রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে ছবি আঁকছি । হঠাৎ দেখি ১টা কৌতূহলী মুখ আমার স্কেচ খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছে ! ভীষণ মায়াবী চেহারার একটা মেয়ে ! মেয়েটার সাথে আলাপ জমাতে ইচ্ছে হল । চট করে বুদ্ধিদীপ্ত কিছু বলতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । ক্যাবলার মত দেঁতো হাসি হেসে বললাম , “পেন্সিলটা কিন্তু নতুন না ।” মেয়েটা সাথে সাথে বললো , “কিন্তু পেন্সিলে আঁকা ছবিটাতো নতুন ।” তার মুখে ভুবন ভোলানো না হোক অন্তত আমাকে ভুলিয়ে দেবার মত অসম্ভব সুন্দর একটা হাসি । মনে হল যে ভিঞ্চি সাহেব যদি এ যুগের হতেন এবং এই মেয়ের দেখা পেতেন , তবে মিস (অথবা মিসেস) মোনালিসা ফেল মারতেন । বহু বছর ধরে দখল করে রাখা বিশ্ববিখ্যাত হাসির খেতাবটা এই মেয়েই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতো !
হঠাৎ “এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস ?” বলে খেঁকিয়ে ওঠা একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে গেলাম । প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখি রাগি রাগি চেহারার একজন মোটা মহিলা ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । ওনার পাশে ১২/১৩ বছরের একটা ছেলেও দাঁড়িয়ে আছে । ঐ মহিলা ছেলেটাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন । মেয়েটা “আসছি” বলে ঐ মহিলার পেছনে পেছনে না গিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগলো ! ঘটনা কি দেখার জন্য উঠে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম । এবার দেখি যে মেয়েটা তার মোবাইল সেট এগিয়ে ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে ! খুশিতে ‘আবেগাপ্লুত’ হয়ে গেলাম ! সে নিশ্চয়ই আমার মোবাইল নম্বর চাইবে । তার মোবাইল সেটে আমার মোবাইল নম্বর তুলে দেবার জন্য হাত বাড়ালাম । কিন্তু মেয়েটা মোবাইলটা আমার হাতে না দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই মোবাইল ক্যামেরাতে আমার একটা ছবি তুলে ফেললো ! বললো , “শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে ।” সে হন হন করে হাঁটতে লাগলো কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়া অন্য দুজনকে ধরার জন্য । আমিও খুশিতে আত্মহারা হয়ে বেকুবের মত তাদের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলাম ।
আমি রাস্তার এক পাশে , ওরা অন্য পাশে । চারপাশের কোন কিছুকেই তোয়াক্কা না করে আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাঁটছি । মেয়েটাও একটু পর পর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে ! এভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের হলের সামনে চলে এলাম । ওরা ৩ জন ১টা রিক্সায় উঠে নিউ পল্টনের দিকে চলে গেলো ।
মনের সুখে গুন গুন করতে করতে হলে ঢুকলাম । রুমে ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুতে বের হয়ে ঝন্টু ভাইয়ের রুমে হৈচৈ শুনতে পেলাম । বিষয়টা কি দেখতে গিয়ে দেখি যে পোলাপান হৈচৈ করে কম্পিউটারে হিন্দি সিনেমা দেখছে । “এতে আবার হৈচৈ করার কি আছে ? ” মনে মনে ভাবতে ভাবতে ঐ রুম থেকে বের হতে যাবো , এমন সময় দেখি ঝন্টু ভাই উদাস ভাবুকের মত দরজায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন । এই লোকটাকে আমি একটুও সহ্য করতে পারি না । ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে একবার আমাকে র্যাগ দেবার কথা বলে কনকনে শীতের রাতে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় হলের মাঠে দৌড়াতে বাধ্য করেছিলেন । সেই থেকে আমি প্রতিশোধ নেবার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় আছি । আজ হঠাৎ তাঁকে এরকম উদাস ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না । এক দৌড়ে রুম থেকে বের হবার সময় দু’হাতের ধাক্কায় তাঁকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে আমার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম ।
আমাদের রুমে আর কেউ নেই । ঝন্টু ভাই উঠে এসে পাগলের মত দরজা
ধাক্কাচ্ছেন । আর তার সাথে তাল মিলিয়ে ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছেন । এদিকে আমার বুকের ভেতর ঢোলের বাজনা শুরু হয়ে গেছে । বেশ কয়েক মিনিট পার হবার পর হঠাৎ দরজা ধাক্কানো বন্ধ হল । টিভি রুমের বিকট শব্দের সাউন্ড বক্সে শুনতে পেলাম যে বগুড়াতে সন্ত্রাসীদের সাথে পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে । দরজা একটু ফাঁক করে দেখলাম যে ঝন্টু ভাই দরজার সামনে নেই ! হয়তো তিনি গোলাগুলির কথা শুনে টিভি রুমের দিকে গেছেন । মনে মনে ভাবলাম , “এই সুযোগ । পরে যা হবার হবে । এখন পালাই ।”
আমি সি, এন, জি, র মত তীব্র গতিতে দৌড়াচ্ছি । এই দৌড়েই ঘটলো যত বিপত্তি । আর মনোযোগ দিতে পারছিনা । সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । বুঝতে পারলাম যে এতক্ষণ যা ঘটেছে তার সবই একটা স্বপ্নের ঘটনা । বিষয়টা টের পাওয়ার কারনে মনে হল যে আমার স্বপ্নটা শেষ হয়ে যাচ্ছে । তবু প্রাণপণে স্বপ্নটাকে চালু রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম । ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন কিভাবে চালু রাখা যায় , তার কোন পদ্ধতি আমার জানা নেই । কি করবো বুঝতে না পেরে দৌড়ের গতি বাড়াতে লাগলাম । দৌড়টা কোথায় গিয়ে শেষ হবে জানি না । সে বিষয়ে কিছু ভাবতেও পারছি না । মাথায় ঘুরছে কেবল একটা কথা , “যে করেই হোক স্বপ্নটা চালু রাখতেই হবে । স্বপ্নের পরবর্তী অংশে মেয়েটার সাথে আমার প্রেম হবে । বন্ধু বান্ধবের কাছে বলতে পারবো যে বাস্তবে নাহয় নাই হল , স্বপ্নের মধ্যে তো একবার অন্তত প্রেম করেছি ।” হঠাৎ মাথায় আরেকটা চিন্তা এসে পড়লো । স্বপ্নের পরবর্তী অংশে তো ঝন্টু ভাইয়ের সাথেও আমার মোকাবেলা হবার কথা । ঐ লোক তো আমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না । স্বপ্নটার পরবর্তী অংশের কোন এক দৃশ্যে হয়তো আমাকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যাবে । আমার পাশে ছল ছল চোখে বসে থাকবে ঐ মেয়েটা ! প্রেম হবার আশায় স্বপ্ন চালু রাখবো , নাকি ধোলাইয়ের ভয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবো ঠিক করতে পারছি না...
চোখ খুলে দেখি ঘড়িতে ৭টা বেজে আরো ৮ মিনিট পার হয়ে গেছে । ফুরফুরে মেজাজে বিছানা থেকে নামলাম ।