somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাধ্য নই, বাধ্য হই

১৮ ই মে, ২০১০ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মন কেমন করে। এই পরবাসে মন টেকে না একেবারে। দেশে থাকতে যেসব জিনিস পাত্তা দেই নি একেবারে, সেগুলোই এখন কত বড় হয়ে চোখে পড়ে, মনে চাপ দেয়। আমার ইস্কুল, কলেজ, ভার্সিটির কত বন্ধু, যাদের সাথে তেমন কথা হয় নি, ঘনিষ্ঠতা থেমে গেছে অল্পেই, তাদের কথা, মুখ মনে পড়ে ভরদুপুরে বুকের ভেতরটা যেন রক্তাক্ত হয়ে যায়। বুকের শিরা ধরে সেসব স্মৃতিগুলো যেন বাদুড়ের মত ঝুলে পড়ে। অসহ্য ব্যথায় বুকটা টন টন করে।

বড় কষ্ট। বড় কষ্ট।

কিন্তু জীবন তো তা বলে থেমে থাকবে না।

আসার সময় চার লাখ টাকা ব্যাংক একাউন্টে দেখাতে হয়েছিল। আমরা সাদামাটা মানুষ। কোথায় পাই এতো টাকা?

এর থেকে, ওর থেকে ধার করে এমনকি চড়া সুদে নানা জায়গা থেকে টাকা ধার করে শেষপর্যন্ত আমার আসার ব্যবস্থা হয়। বাবার শুকনো হাসিভরা মুখটা মনে পড়ে। ছেলের বিদেশ যাওয়ার সাধ মেটাতে কত কষ্ট করে যে টাকাটা জোগাড় করতে হয়েছে, সেসব তখন বুঝি নি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। হাসিটার পেছনে কতটা আনন্দ আর কতটা অনিশ্চয়তার ভয় লুকিয়ে ছিলো, তা হিসেব করার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই হয় নি।

"বাইরে যাবো" শব্দদুটোর মাঝখানেই কেমন একটা নেশা আছে। আমার আত্মীয়েরা, যারা মিডল ইস্টে থাকে, দেশে এলেই কেমন যেন একটা দাওয়াতের সুর লেগে যায়। তাদের গায়ে পারফিউমের কড়া গন্ধ, তাদের চোখে বিকেলবেলায়ও রোল গোল্ডের ফ্রেমের কালো চশমা, তাদের গলায় সোনার মোটা চেন, হাতে সোনালি ঘড়ি। আর, মেয়েদের গায়ে সব ঝলমলে গয়না আর ঝকমকে শাড়ি।

প্রথম যেবার আমার খালাতো ভাই বেলাল ভাই ওমান থেকে এসে বিরাট স্যুটকেসের ঢাকনা উল্টে সবার জন্যে নানান গিফট বের করছিলো, আমার তখন থেকেই একটা বাইরে যাওয়ার নেশা পেয়ে বসেছিলো।

কিন্তু, যথারীতি পড়াশুনো করে বেকারের দলে নাম লেখানোর স্বাভাবিক নিয়মেই যাত্রা করেছি। আমাদের ঘরে যা হয়, পড়ো আর চাকরি করো। স্বপ্নই দেখি অন্য কম-আয়ের মানুষদের মতো, সফল হয় না বড় একটা।

কিন্তু, আমার বেলায় এটা সফল হয়েই গেলো। অবশ্য এখন বুঝছি না এটা কী ইচ্ছাপূরণ হলো, না কি অন্য কিছু।

"খালেদ," শফিক ডাক দেয়।

"কী রে?" কষ্ট করে মাথা তুলি। মাথাটা খুব ব্যথা করছে। দেশে থাকলে টিপিয়ে নিতাম মা নয়তো ছোটবোনকে দিয়ে। জ্বরই আসবে বোধহয়।

"যাবি না?"

"এই তো, যাই।"

"দেরি করলে কিন্তু বাসটা মিস করবি।"

জোর করে গা-টা টেনে তুলতে হয়। এখান থেকে একটা বাস যায় বুড়োদের হাসপাতালে। একটু আগে উঠে কোন বুড়োর পাশে বসে থাকতে হয়, যেন আমি ওকে সাহায্য করছি। আমার কাজের জায়গাটার কাছেই বাসটা থামে। সবার সাথে আমিও নেমে যাই। আসার সময় টিউবে আসি। কখনো ভাগ্য ভালো থাকলে কারোর লিফট পাই কিছুদূর।

আমার কাজটা বলার মতো কিছু নয়। রুটিতে লেবেল লাগাই, প্যাকেটে ভরি। বেশ কয়েকটা কাজ বদলেছি এর মধ্যে। এটার কিছু সুবিধে আছে। টাকাটা বেশি না, কিন্তু, খাবার পাওয়া যায়। বাসা থেকে বেশি দূরে না। আর, ঠান্ডার সময় ভেতরটা গরম থাকে। এর আগে জানালার কাচ পরিষ্কার করার কাজ করতাম। ঠান্ডার সময় বেশি কষ্ট।

বাসাটাও অবশ্য পাখির বাসা। পাঁচজন মিলে থাকি। খাওয়াটা বেশিরভাগ মিলেমিশে। আমি অবশ্য চেষ্টা করি যত বেশি সময় না খেয়ে থাকা যায়। খরচ যত কম হয়।

তবে, এখন খুব খারাপ অবস্থা কাজের। আগে যতটা সহজে কাজ পাওয়া যেত, এখন তার ধারেকাছেও নেই কাজ পাওয়ার সুবিধা। ট্যাক্সি চালালে ভালো টাকা পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে ড্রাইভিং শেখার জন্যে যে-টাকা লাগবে, সেটা আমি এখন দিতে পারবো না। বাবার টাকা সব শোধ হয় নি। যত দেরি হবে, ততোই সুদ বাড়বে। তাই, এটাই শেষ ভরসা। চারদিকে শুনি ডিপ্রেশন, ডিপ্রেশন। সেদিন সামাদ ভাই মুখ কালো করে বাসায় ফিরলো। ছাঁটাই। এখনো ও কাজ খুঁজছে।

সব দেখে শুনে ভয় লাগে। ভয় বাড়ে। যত চুপচাপ সম্ভব কাজ করে যাই।

আমাদের বস পাকিস্তানি। সেলিম মুরাদ। বাড়ি করাচিতে। কাজ আদায় করতে জানে বটে। যেমনি ধমকায়, তেমনি ভালোভাবে কথাও বলে। তবে, রাগটা একটু বেশি। আর ইন্ডিয়ান দেখলে বোধহয় চুলকানিটা বেড়ে যায়।

সেদিন আমাদের সাথের দক্ষিণ ভারতীয় ছেলেটা, আয়ার ডাকি আমরা, ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টিম নিয়ে কী একটা বলছিল, ওকে প্রথমে হালকা দাবড়ানি দিলো। তারপরে, পাঠিয়ে দিলো বেকারিতে। সবচাইতে বাজে জায়গা ওটা এখানকার।

আমি চুপচাপ কাজ করে যাই। আমার বাবার টাকা শোধ করা হয় নি। আমার বোনের বিয়ের জন্যে টাকা জমাতে হবে। অনেক কাজ আমার। অনেক দায়িত্ব। আমি চেষ্টা করি ম্যানেজারের কথায় কান না দিতে।

আমাদের সাথের রাসিফ আবার একটু দেশপ্রেমিক টাইপের আছে। ওর সাথে মাঝেমাঝে লেগে যায় ম্যানেজারের। একবার ম্যানেজার বলছিলো, কেন যে বাঙালিরা পাকিস্তান ভাঙলো, তা নাকি সে বুঝতে পারে না। ব্যস, রাসিফের সাথে লেগে গেলো। তবে, খুব বেশি না। কারণ, রাসিফও জানে এই কাজটা হারালে আবার পাওয়াটা খুব ঝামেলার হবে। তবে, ভেতরে এসে প্রচুর গালাগালি দিয়েছিলো। ওর মেজাজটা সাংঘাতিক খারাপ। আগে হলে হয়তো মারামারি করে চাকরি ছেড়েই চলে যেতো। সে বারবার বলছিলো, ৭১-এর পরে পাকিস্তানিদের ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয় নি। ওদের ঘাড়ে ধরে মাপ চাওয়ানোর কথাও বলছিলো। সাথে সাথে মা-বাপ তুলে গালি দিচ্ছিল রাজাকারদের। ওদেরও নাকি বিচার করা দরকার এখনই।

এটাও আমার মাথায় ঢোকে না।

এতদিন পরে বিচার কট্টুক করা যাবে, আর করারই বা দরকারটা কী, এসব নিয়ে আমার তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। ওদের বিচার করা ছাড়া যেন দেশে আর কোন সমস্যা নেই। ওদের বিচার করলে যেন লোডশেডিং, পানির সমস্যা, বেকার সমস্যা, দুর্নীতি রাতারাতি দূর হয়ে যাবে। দেশের দিকে লোকগুলোর মন নাই, খালি বিচার চায়। পলিটিকাল পার্টিগুলোরও কোন চিন্তা নাই দেশ নিয়ে। আমরাও তো দেশেই থাকতে চাই। আমাদের কেন বাইরে আসতে হয়, তার জন্যে পার্টিগুলো কি একটুও চিন্তা করে? গালি চলে আসতে চায় মুখে। কিন্তু অভ্যেস নেই। একবার আমাকে আমাদের ক্লাসের সবচাইতে ফাজিল ছেলে মাহবুব শেখালো, বাসায় গিয়ে যেন আমি "ঔষধ আনি" কথাটা তাড়াতাড়ি বলি। এরপর, যা মারটা খেলাম প্রথমে মা, তারপর বাবার হাতে। সেই থেকে গালি দিতে মুখ খুলতেই পারি না। সর্বোচ্চ মনে মনে।

ওফ্, মাথাটা বেশি ব্যথা করছে আজ। জ্বর বোধহয় এসেই গেলো। কিন্তু, এই শিফটের কাজটা সারতেই হবে। এখন আর কাউকে পাওয়া যাবে না। এমনিতে তিনজন লাগে এখানে, কিন্তু আমরা দুজনেই কাজ করি। একজনের ওপর পুরো ভার দিয়ে যাওয়া যায় না। আজ আমার সাথে আছে শ্রীলংকার জয়। ছেলেটা ভালোই। আমার অবস্থা দেখে বললো, "ডুড, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। কিছুক্ষণ পর থেকে কাজে হাত লাগিও।"

আমি চেয়ারে বসেই পা ছড়িয়ে ঝিমাতে লাগলাম।

বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছিলাম, দেশে ফিরে গেছি। আমার ছোট বোনটা আমায় দেখে লাফাচ্ছে, জিজ্ঞেস করছে আমি ওর জন্যে কী এনেছি।

হঠাৎ একটা চেঁচামেচিতে জেগে উঠলাম। চোখ খুলে দেখি আমায় জয় ঝাঁকাচ্ছে। ওর মুখটা একটু ভয়-পাওয়া। আমার ঘুম-ভাঙা মাথায় কিছু ঢোকে না। একটু পরেই বুঝতে পারি আমাদের পাকিস্তানি ম্যানেজার চিৎকার করছে। উর্দুতেই। রেগে গেলে আর বিশেষত উপমহাদেশের কারো ওপর রেগে গেলে ও প্রায়ই উর্দু বলে।

আমি লজ্জা পেয়ে কাজ করার জন্যে উঠে দাঁড়াই। একটু পরে ওর রাগ করার কারণটাও টের পাই। কাল পাকিস্তান খেলায় হেরে গেছে অস্ট্রেলিয়ার কাছে, তাই জমানো ক্ষোভটা ঝাড়ছে আমার ওপর। ঝাড়ুক, আমিও কি কাজটা ভালো করেছি?

কানে আসে যেন ম্যানেজার বলছে, "...মাদারচোদ বাঙালি।"

আমি চমকে যাই। আমার রক্তপ্রবাহ চট করে দ্রুততর হয়। কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে মাথাটা। আমি ওকে বলতে চাই যেন জাত তুলে সে গালি না দেয়। এরমধ্যেই শুনি সে বলছে, একাত্তরে নাকি পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলো, বাঙালিদের এরকম শিক্ষাই দরকার। আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে (অত্যন্ত অশ্লীল একটা শব্দ ব্যবহার করে সে), ঠিকই করেছে। বাঙালিদের নাকি এরকম ....দার ওপরেই রাখা উচিত।

আমি আমার শরীরের সব শক্তি জড়ো করে ওর সামনে গিয়ে ওর চোখের দিকে তাকাই।
পৃথিবীর সব ঘৃণা একত্র করে আমি বাংলাতেই চেঁচিয়ে উঠি,
"ওই পাকিস্তানি খানকির পোলা, তর মায়রে চুদি।"

[বি. দ্র.: http://raselpervez.amarblog.com/posts/106452' target='_blank' >এই পোস্টের সাথে] কোন সম্পর্ক নাই



সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১০ দুপুর ১:২৪
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×