somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বনলতা সেন গর্ভবতী ছিলেন

২৯ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বনলতা সেন গর্ভবতী ছিলেন
টোকন ঠাকুর


তিন বাচ্চার মা, পেটে তার অারেকটি বাচ্চা উঁকি দিচ্চে। স্বামীর দফতরির চাকরি, স্কুলে। বাড়ি থেকে স্কুল অাট কিলো দূরে। দফতরি লোকটা যে সকালে বেরিয়ে যায় বাইসাইকেল চালিয়ে, ফেরে প্রায় সন্ধ্যায়। স্বামী বেচারা মানুষ হিসেবে কেমন? তা অার ভাবনায় অাসে না। খালি মনে হয়, দফতরি থেকে যদি কোনো প্রোমশন পেত, হয়তো বেতন বাড়ত। সংসারে খরচ তো বাড়ছেই। তিনটা বাচ্চা, অারেকটা কামিং সুন।

প্রমোশনের সম্ভাবনাহীন দফতরি বেরিয়ে গেছে সেই সকালেই। যাওয়ার সময় বউকে অাজও বলেছে, সাবধানে থাকবা। বেশি চলাফেরা করবা না, পেটে চাপ লাগবে।
স্বামীর সাবধানবাণী মনে রাখলেও সে একটু অাধটু চলাফেরা করে, সংসারের কাজও তো অাছে। কে করে দেবে? তদুপরি তিন, চার ও পাঁচবছর বয়সী তিনটা সন্তানকেও বড় করে তুলতে হচ্ছে!

জেঠা শ্বশুরের নতুন বাড়ি দুশো গজ দূরে। জেঠার বড় মেয়েও পোয়াতি। পোয়াতি-পোয়াতিতে গল্প করার ইচ্ছে হলো বলেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে জেঠা শ্বশুরের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। পথে ছোট্ট একটু ফাঁকা মাঠের মতো, সেখানে খানিকটা জঙ্গল। তারই পাশে পুরোনো দিনের দীঘি। দীঘিরপাড় দিয়েই রাস্তা, জেলা শহরেের দিকে চলে গেছে। কিন্তু অাজ সে দীঘির পাড়ে পৌঁছুতেই বিপত্তিটা বাঁধল। প্রথমে সে খেয়ালই করেনি যে, রাস্তায় অাগন্তুক লোকটা তার দিকে তাকিয়ে অাছে। অাগন্তুক লোকটা তাকে দেখছে দেখে সে প্রথমে লজ্জ্বা পেলেও তারপর সামলে নিল।
পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময়ই লোকটা অাচমকা কথাও বলে উঠল, একটু জল খেতে চাই।
সে বুঝতে পারে না, এই অপরিচিত লোকটা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে জল পান করতে চায় কীভাবে? তাই সে লোকটার পিপাসাকে পাত্তা নি দিয়েই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটা অাবারও বলল, জল খাব।
সে এবার টেন পার্সেন্ট অামলে নিল তার পিপাসা। বলল, রাস্তায় খাওয়ার জল পাব কোথায়?
লোকটি পরিচিত লোকের ভঙ্গিতে বলল, তাহলে বাড়িতে গিয়েই খাব, অনেক হেঁটেছি...পিপাসা পেয়েছে।
অামাদের বাড়িতে?
সে বুঝেই উঠতে পারল না, একজন অপরিচিত পুরুষ লোক কীভাবে এ অাবদার করে! বলল, মানে?
মানে অামি জল খাব।
জল খাবেন তো অামি কি করব? অামি গেলাম।
বলেই, সে চলে যেতে চায়, একটু হাঁটেও সামনে। লোকটিও নাছোড়বান্দা। লোকটি তার পথ অাটকায়। ফলে, সে এবার গলার স্বর পরিবর্তন করে, যেখানে যাচ্ছিলেন যান। অাপনি তো অামার পরিচিত না।
পরিচিত হয়ে পড়েছি এতকষণে, তাই না? লোকটি বলল।
অাপনি কি নাটোর রাজবাড়ি দেখতে অাসছেন? যান, দেখে অাসেন।
দেখে অাসব? কোথায় অাসব, তোমাদের বাড়িতে? কোন বাড়ি তোমাদের?
অামাদের বাড়ি কেন অাসবেন? মুশকিলে পড়লাম তো! অাপনি কে?

লোকটি এবার একটা নিঃশ্বাস ফ্যালে জোরে। সে তাকিয়ে থাকে, কেন যেন যেতেও পারে না। লোকটি বলল, রাজবাড়ির পুরোনো ইট-সুরকি দেখতে অাসিনি অামি।
সে তাকাল। তাকানোতে যেন তার জিজ্ঞাসা, কি দেখতে অাসছেন তবে?
অামি হাজার বছর ধরে হাঁটাহাঁটি করে বেড়াচ্ছি, কেন জানো?
সে কোনো উত্তর দিল না। চারপাশ দেখে নিল, কেউ দেখছে কীনা। ভাদ্র মাসের ভ্যাবসা গরমে, এই দুপুরে কেউ নেই চারপাশে। তবু সে প্রশ্ন করে বসে, কত বছর হাঁটছেন অাপনি?
হাজার বছর।
হুম। পাগল!
নিশ্চিত।
মানুষ বাঁচে কয়বছর?
তার কোনো ঠিক নেই। কেউ অাশি বছর, কেউ অাটশো বছর।
হেসে ফেলল নারী। লোকটি বলেই যেতে থাকল, পেয়েছি। অামি যা চাই, পেয়েছি।
কি?
একজোড়া চোখ, যেখানে অামার বাসা বুনতে চাই। বাস করব।
এবার একটু সন্দেহ হলো তার। সেই চোখ কোথায় পাবেন?
তোমার কাছে।
মানে?
তোমার চোখজোড়া অামি নিয়ে যাব।
কি? পথ ছাড়েন। অামি যাব।
তোমার চুলও অামি নিয়ে যাব।
কোথায় নিয়ে যাবেন? অামার চুল দিয়ে অাপনি কি করবেন?
কবিতার মধ্যে তোমার চুলের কথা বলতে গিয়ে তোমার কথা বলব।
তাতে কি হবে?
পাঠক পড়তে পারবে।
তাতেই বা কি হবে?
তারা জানবে এই চোখের কথা, চুলের কথা। তোমার কথা।
অামার জানানোর কোনো দরকার নেই, অাপনি যান।
অামি তো যাবই। চোখও নিয়ে যাব। চুলও নিয়ে যাব। তোমাকে নিয়ে যাব।
কোথায় নিয়ে যাবেন? অামি কোনো পপুরুষের সঙ্গে যাব না।
অামি তোমার ঘরপুরুষ না, অাবার পরপুরুষও না।
তাহলে কি?
অামি জীবনানন্দ দাশ। বাড়ি বরিশাল।
হুম। দাশ মশায়, দয়া করে এবার চলে যান, নাটোরের রাজবাড়ি দেখতে অনেক লোক অাসে...দ্যাখেন গা।
কথাটা লাগল মনে। কিন্তু তখন মনই তো নেই। মন তখন ওই নারী হরণ করে নিয়েছে। জীবন দাশকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। সে এবার তা বলেও ফেলল, অামি খুব ক্লান্ত। তোমাকে চাই।

এভাবে চাইলেই তো অার হলো না। এবার এই নারী মনে হয় সত্যি সত্যি চলে যাবে কবির সামনে থেকে। কবিও তা বুঝতে পারলেন। বললেন, অামার সঙ্গে যেতে তোমার খুব অসুবিধা হবে?
হবে। অামার সন্তানরা অাছে না? স্বামী অাছে।
অাছে থাক। তুমি চলো।
কোথায় যাব?
কোনো একটা দ্বীপে, যেখানে কেউ থাকে না।
নারী তার উঁচু হয়ে থাকা পেট দেখিয়ে ইঙ্গিত করে, এই বাচ্চার কি হবে? অামার অন্য বাচ্চাদের কি হবে...এসব অাপনার মাথায় অাছে?

জীবনানন্দ দাশ বললেন, অামি তো ওদের কথা লিখব না। শুধু তোমাকে লিখব। তোমার চোখের কথা লিখব, চুলের কথা লিখব। তুমি অামার সঙ্গে চলো। তোমাকে নিয়েই লিখব শুধু। তোমাকে নিয়েই থাকব।
কোথায় থাকবেন? লোক-লজ্জ্বা অাছে অাপনার?
না। অামার লোক-লজ্জ্বা নেই। অামি কবিতা নিয়ে থাকি। কবিতাই অামার দেশ।
অামি কি কবিতার দেশে থাকব?
হ্যা।
সম্ভব?
সম্ভব। তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি, পথে পথে। বরিশাল, কোলকাতা, অশোকের ধূসর জগতেও খুঁজেছি। ঢাকাতেও খুঁজেছি। ইডেন কলেজের সামনে সন্ধ্যায় ঘোরাঘুরি করেছি। তোমাকে পাইনি। না পেলে কী করব? এবার পেয়েছি। খালি হাতে যাচ্ছি না।
এই নারী এবার দ্বিধাগ্রস্থ। এই নারী এবার দ্বিধাবরী। এই নারী অাজ দ্বিখণ্ডিতা। কী করবে সে?

সে পারছে না, সে অাজ ইচ্ছে করলেও পারবে না, এটা সে জানে। তবু তার মন মোচড় দিয়ে ওঠে। সে এই দীঘির পাড়ের রাস্তা থেকে চলে যেতে চায় কিম্বা চায় না। কবি বুঝে ফ্যালেন, এই নারী যেতে পারবে না। না গেলেও, তার চুল, চোখ নিয়ে যাওয়া যায়। তবু শেষ চেষ্টা...চলো না।

কোথায় যাবে এই নারী, কবির সঙ্গে? কবি বলেছেন, কোনো এক দ্বীপে। কিন্তু দ্বীপ কোথায়?
কবি বললেন, দ্বীপের নাম নির্জনা দ্বীপ। নাম শুনেছ?
নারী বলল, না। এই নামে কোনো দ্বীপ অাছে, শুনিনি তো।
অামরা নাম শুনিনি এমন কত কিছুই তো অাছে। নেই?
তা অাছে--বলে স্বীকার করে নিল সে।

তারপর একটুক্ষণ। কেউ কোনো কথা বলল না। দুপুরের অাকাশের রোদ শুনছে, তারা দুজন কী নিয়ে কথা বলে! দীঘির পাড়ের ছোট্ট একটু ঝোপ দেখছে, তারা এখন কী করে! তারা ইতস্ততবোধ করছে কী?

মোটেও না। কিন্তু লোকটি তো যাচ্ছেন না! হঠাৎ সিদ্ধান্ত চাইলেন, অামি কি চলে যাব?
এবার যেন সত্যি সত্যি চাপে পড়ে গেল এই নারী। সে তাকে কী বলবে? বলবে, চলে যান? না কি বলবে, না, থাকেন। কোথায় থাকতে বলবেন, বললে তার চলতি সংসারের কী হবে? একজন বিবাহিতা নারী কোনো এক পরপুরুষকে বলতে পারে বঙ্গদেশে, থাকেন! অামার সঙ্গে থেকে যান!

কিন্তু কেন যেন মনে হয়, সত্যিই, একহাজার বছরের পিপাসা নিয়ে লোকটা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ক্লান্তি জমেছে তার। ক্লান্তি মোচনে সে কি কিছু করতে পারে? মন যাই বলুক, মনে কথা শোনার বাস্তবতা কোথায়? সেই নিয়ম কি অাছে? কোথায় অাছে?

অামি তোমাকে নিতে এসেছি, বনলতা সেন।

চোখ ফেড়ে জল বেরুতে চাইল হঠাৎ। অশ্রুকে সে অাড়াল করতে চাইল এবং তার চোয়াল একটু শক্ত হলো মনে হলেও শেষপর্যন্ত সেই শক্তি যেন অার এলো না, তবু প্রশ্ন থেকে গেল-- এতদিন কোথায় ছিলেন?

দীঘিরপাড়ে, সেদিন দুপুরের পর তাদের কখনো অার অার দেখা হয়েছে কী হয়নি, জানি না। তুমি থাকলে তোমাকে জিজ্ঞাসা করতাম, তুমি জানো, অনুভূতির মা?


প্রকাশ, বাংলা নিউজ২৪ ডটকম (অনলাইন)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৪ রাত ১:১১
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×