ওপরে সবুজ, আলোর মুখোমুখি। ভেতরে শেকড়, মন খুড়ে, মাটির মুখোমুখি
আমার বাড়ী মফস্বলে। ছিমছাম ছোট্ট একটা শহর। সন্ধ্যা লাগতেই টিমটিমে আলোয় ভরে যায় চারপাশটা। পাড়ার চাচার দোকানটায় বসে চায়ের আসর। শীতকালে ওই দোকানটার পাশেই তার টেনে এনে চলে রাতভর ব্যাডমিন্টন।
মাঝে মাঝে পড়ার টেবিল থেকে উঠে উঠতি বয়সী ছেলেরা চাচার দোকানে চলে যায় চা খেতে। বাসায় চাইলেই চা পাওয়া যায়, কিন্তু টং দোকানের চা না হলে কেন জানি তাদের মনে হয় চা ই খাওয়া হয়নি!
আমাদের বাড়ীটাও বেশ ছিমছাম। বারান্দায় দুটো ইজি চেয়ার পাতা। গ্রীলে মাধবীলতার গাছ। গাছের পাতার ফাঁক গলে দেয়ালে আলো এসে পড়ে। আমি দুপুর বেলাতে খেয়ে দেয়ে ভরা পেটে ক্যাসেট প্লেয়ারটা নিয়ে বারান্দায় বসি, গান শুনতে শুনতে চোখটা লেগে আসতেই বাবা সাইকেলটা নিয়ে ঘরে ফেরে। ঘরে ঢোকার সময় বাবা প্রতিদিনই মাথায় ক্যামন যেন একটা আরামের হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়। ঘুম নেমে আসে যেন চোখে আবার।
দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেলের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন উঠোনের লোহার গেট টায় শব্দ করে আমার বন্ধু সাইফুল আসে। আমার ঘুরে বেড়াবার সময় সেটা। দুইজনে মিলে সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াই শহরতলী, কিম্বা নদীর ধারে। আমাদের রাজ্যের যত প্ল্যান করা হয় তখন!
বিকালটায় নদীর পাশটা দিয়েই যাওয়া হয় বেশি। সবুজ পাড় জুড়ে গাছগাছালির কমতি নেই। পাশেই ছোটখাটো বাজার থাকায় লোকজনের সমাগম ভালোই বলা যায়।
হুট করে সাইকেল থামিয়ে মাঝে মাঝেই আমরা নৌকার গুণ টেনে হেঁটে যাওয়া পেশীবহুল লোকগুলোকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি। উচ্ছ্বাসহীন চোখগুলোকে দেখে মায়াই লাগে।
ঘাটলায় ভেড়া নৌকাগুলোর প্রতিও আমাদের আগ্রহ অসীম। ঝকঝকে রূপালী মাছে ভর্তি থাকে ওগুলো। আমাদের খুব ইচ্ছে হয় জেলে হতে তখন। কানের কাছে সাইফুলের ফিসফিসানি চলতেই থাকে অনবরত, কোন মাছটা ক্যামন করে, কি দিয়ে খেতে ভালো লাগবে, তার কোন খালার বাসায় রিঠা মাছ আর বেগুনের ঝোল খেয়েছিলো। শুনে জিভে পানি এসে যায়।
চল যাই, বলে তাগাদা দেই সাইফুলকে।
ছোট বাজারটায় হ্যাজাক বাতি আর হারিকেন জ্বলতে থাকে সন্ধ্যা নামতেই।
হারুন মিয়ার দোকানটা একটু নিরিবিলিতে। বটগাছটার ওপাশে রাস্তার শেষ প্রান্তে। ওটার সাথেই ক্লাবঘর। ক্লাবঘরটার আশেপাশে গেলেই আমাদের মনের মধ্যে উৎসব উৎসব ভাব লেগে যায়। সবসময় কিছু না কিছুর আয়োজন চলতেই থাকে যেন। কখনো নাটক, বা কবিতা কিম্বা বই নিয়ে আড্ডা। হারুন মিয়ার দোকান থেকে পালা পালা করে চা যায় সেখানে। ক্লাবঘরে না গিয়ে বরং হারুন মিয়ার দোকানটাতেই বসি আমরা।
উনি সব খবর রাখেন বলেই হয়তো ক্লাবের আশু কর্মসূচীর গল্প শুনতে শুনতে এক অন্যরকম আনন্দে উত্তেজিত হতে থাকি মনে মনে।
ভাইয়া এসবের সাথে ছিলো অনেককাল আগ থেকেই।
ভাইয়া এখন আর এখানে নেই। ঢাকাতে থাকেন। ছুটিতে আসলে আমাদের বাড়ীর সাথে সাথে ক্লাবঘর টাতেও আনন্দ বয়ে যায় যেন।
ভাইয়ার জন্যে পথ অপেক্ষা করে থাকি আমি আর সাইফুল ও। আমাদের সব ঘোরাঘুরি আর উদ্ভট সব প্ল্যানগুলো থাকে ভাইয়াকে সাথে করেই।
আজ বাসায় ফিরেই সবচাইতে আনন্দের খবরটা পেলাম। ভাইয়া আসছে!
এই শুক্রবারেই। আজকের বিকেলের ডাকেই নাকি এসেছে চিঠিটা!
পড়ার টেবিল এ মনই বসছিলোনা একদম। খালি কান পেতে শুনছিলাম বারান্দায় মা আর বাবার ভাইয়াকে নিয়ে গল্প। আপাও ছিলো সেখানে। আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওদের সাথে গিয়ে সামিল হতে, কিন্তু উপায় নেই। মায়ের চিৎকার শুনতেই হবে তাইলে।
সাইফুল কেও খবরটা জানানো হয় নাই! কত্তোকাজ যে বাকি এখনো!
পড়ার টেবিল এ 'আমার বই' টার পাতা উল্টাতে থাকি আনমনে।
বাংলা গল্পগুলোর সাথে ছবিগুলো আমার খুব প্রিয়। একটা ছোট্ট নদীর ছবি দেখে মনে হল, ভাইয়া কে নিয়ে এবার মাছ ধরতে যাব!
বুকের মধ্যে এক অজানা আনন্দ আর উত্তেজনায় কেমন যেন শিরশির করে উঠলো।
মাঝখানে আর একটা দিন। মা আর বাবাকে দেখলাম বাজার এর লিস্ট বানাতে। আমি এঘর ওঘর করছি অদ্ভুদ এক আনন্দ নিয়ে। আপার রুমে উঁকি দিয়ে আপাকেও বেশ খুশি খুশি মনে হলো। আমি জানি এ দুদিন আমার ঘুমও হবে না ঠিক করে।
রাতে মশারির ফাঁক গলে চাঁদের আলো আমার গায়ে এসে পড়ে। রূপালী রং এর মিশেলে অন্যরকম রং তৈরী হয়। আমার কৈশর চোখ সেই রং এর তাকিয়ে আরেক রং এর স্বপ্নে ডুব দেয়। সেই রং ধীরে ধীরে হয় সবুজ তারপর একসময় ফিকে হয়ে হয় সোনালী।
[ বানান ভুল মার্জনীয়। অলসতায় কিম্বা ব্যাস্ততায় অথবা অনভ্যস্ততায় এডিটিং করা হয়নি]
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১১:৫৪