মেঘের ওপর আকাশ ওড়ে,
নদীর ওপার পাখির বাসা,
মনে বন্ধু বড় আশা...
সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলো বৃষ্টির শব্দে। টিনের চালে বৃষ্টি। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না একটুও। মাথার কাছে ভাইয়া আর আপা বসে চা হাতে নিয়ে গল্প করছে। মা এসে জানালো ঘরের উঠানেও পানি চলে এসেছে! বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণ নেই। আমি শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছি আর ভাইয়ার গল্প শুনছি।
আপা ডেকে যাচ্ছে একটু পর পর আমাকে। ভাইয়া বললো, থাক , আরেকটু ঘুমাক।
আরেকটু যখন বেলা হলো, আর চারপাশটা আরো অন্ধকার করে আরো যখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো, তখন উঠলাম আমি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি উঠানের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
পানি চলে এসেছে অনেক দূর! বাউন্ডারির কাছ দিয়ে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো ধুয়ে গিয়েছে বেশ। সামনের কৃষ্ণচূড়ার ডালে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে কয়েকটা ভেজা শালিক।
আমার খুব ইচ্ছে হলো কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দেই উঠানটায়।
ছোট আমগাছটার ডালপালা এমন করে পানিতে ঝুঁকে আছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন আমাজনের রেইনফরেস্টের কোন জায়ান্ট ট্রি। জায়গাটাকে কল্পনার কুয়াশায় নিয়ে গেলাম আমি বারান্দার গ্রিল এ মাথা ঠেকিয়ে।
পানিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কচুপাতাগুলোকে মনে হলো জায়ান্ট ভিক্টোরিয়া লিলি! এখুনি যেনো মাথা ভাসিয়ে দিয়ে সরসর করে এপাশ থেকে ওপাশে অলস ভঙ্গিতে চলে যাবে বোয়া কন্সট্রিকটর, আমাজনে বসবাসকারী সুরিনামের সেই ভয়াবহ সাপ!
আমার স্বভাবসুলভ কল্পনায় হারিয়ে যাচ্ছি আমি, টের পাচ্ছি।
আমি সত্যি সত্যি কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দিলাম। একটা ছোট্ট ছাউনী দিতে ভুললাম না নৌকাটায়। যদি বৃষ্টিতে ভিজে যাই আমরা!
আমরা, মানে আমি , ভাইয়া আর সাইফুল। আরেকজনকে নিতে ইচ্ছে হলো খুব। সেই খুব অনুসন্ধিৎসু মনের কিশোরীর কথা মনে হয়ে গেলো হুট করেই!
একটু লজ্জ্বা লজ্জ্বা লাগলেও নিয়েই নিলাম তাকে।
কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিছুই জানি না। শুধু জানি ওই দুর্ভেদ্য অরন্য পার হতেই হবে আমাদের।
ভাইয়া শংকিত মুখে বোটের স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না সামনে। হাউসবোট টা দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁটে আমরা কেউ ডেক-এ বের হতে পারছিনা। আপা আর বাবুলী ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ার দিকে। আমার চোখ গোগ্রাসে গিলে চলেছে আমাজনের সবুজাভ পানির ওপর বৃষ্টির ছাঁট, এপিফাইটেস আর সারক্রোপিয়া গাছের ডাল থেকে বেয়ে আসা লিয়ানা লতা আর চারিদিকের আধো-অন্ধকার এর মধ্যে ঢিমিয়ে চলতে থাকা বোট টার মধ্যে ব্রাজিলিয়ান কফির গরম গরম ধোঁয়া!
দুপুর বেলা সর্ষে ইলিশ হবে শুনলাম। বৃষ্টির তেজ একটু কমে এসেছে। আমাদের হাইসবোট টা ডুবে গেছে! আমাদের কার কি হাল, কে সাঁতরে কোথায় উঠলাম সেটা ভাববার অবকাশ পেলাম না। আপাতত অন্য বিষয়ে উত্তেজিত, ভাইয়ার সাথে নদীর দিকটায় সাঁতরাতে যাবো। সাঁতারে দুই ভাই-ই পটু, তাই বাড়ি থেকে আপত্তি করলো না মা।
আমাদের পাড়া থেকে একটু বের হলেই কাঁচা রাস্তার শুরু। সেটা বেশ কিছুদূর নেমে গেছে একটা গ্রামের দিকে। ওইখানে যাবার পথেই ছোট শাখানদীটি পড়ে। ওই ছোট কাঁচা রাস্তাটি দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, বৃষ্টির তোড় একটু বেড়েও গেলো যেন। রাস্তার একপাশ টায় ধান ক্ষেত ,আর অন্যপাশটায় বুনো সুপারিগাছ এর সারি। অনেক জংলি লতায় পাতায় ভরে গেছে যায়গা টা। রাস্তায় লোকজন নেই তেমন। দু একজনেও বা আসা যাওয়া করছে, ছাতি মাথায়, নিতান্তই অনিচ্ছা সত্বেই বের হতে হয়েছে যেনো। পাশ দিয়ে যাবার সময় ছাতার ওপর বৃষ্টির শব্দটা শুনতেও দারুন লাগছিলো আমার!
বড় কচু গাছগুলির নিচে গুটিশুটি মেরে থাকা পাতিহাসগুলোও যেন অলস দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আর সব লোকজনদের মতো পাগল গোছের কেউ ভাবছিলো হয়তো!
আমার খুব মনে হতে লাগলো, মানুষজন আসলেই বেরসিক। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে, ভাইয়াও জবাব দিলো না তেমন। তাড়াতাড়ি চল রে, বলে স্মিত হাস্যে পা চালাতে থাকে। আমার মনে হল, সাইফুল থাকলে কি ভালোই না হতো! সাইফুল কে আশা করাও ঠিক না। ওর যদি আমার মতো একটা ভাইয়া থাকতো!
মানুষজন বড্ড বেরসিক! আবারও ভাবতে থাকি আমি।
নদীর পাড়টায় প্রকান্ড দু-চারটা কড়ই আর বটগাছ দাঁড়িয়ে। বট গাছটার নিচেই রাস্তার দিকে মুখ করে পুরি-সিঙারার ছোট্ট হোটেল। সামনেই সরিষার ক্ষেত। পাশেই নদীর এই কিনারাটায় গোটাকয়েক তাল গাছের গুঁড়ি ফেলে বানানো হয়েছে ঘাট। মানুষজন বিকালে সকালে এদিকটায় প্রায়ই আসে বেড়াতে, এক বুক খোলা বাতাসের লোভেই হয়তো।
নদীর কাছটায় এসে আমি অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। ঝমঝম বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছোট ছোট সব ছেলের দল দাপড়ে বেড়াচ্ছে চন্দনা নদীর বুকে।
আমার দিকে চেয়ে ভাইয়া বললো, এর চাইতে রসিক মানুষ আর কোথায় পাবি বল।
চোখে মুখে মাথায় বৃষ্টি নিয়ে আমি দেখছি ছেলের দলের গাছ থেকে ঝাপিয়ে পড়ার দৃশ্য! ভাইয়ার বন্ধুরা হোটেলটায় বসে, হাত নেড়ে ডাকলো ভাইয়াকে দেখে।
আমি এসে দাঁড়ালাম কড়ই গাছটার নিচে।
সারা নদীর ধূসর পানির বুকে কী অদ্ভুদ রিমঝিম শব্দে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। দূরে একটা দুটা মন খারাপ করা নৌকাগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। কি জানি তার মধ্যে হয়তো জেলেরা আয়েশ করে স্টোভ এ ভাত রাধছে কিম্বা নকশা কাটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ছই এর মধ্যে।
পরিচিত গন্ধ পেতেই পেছনে ফিরলাম আমি, তাকিয়ে দেখি চুল সজারুর কাঁটা করে সাইফুল দাঁড়িয়ে! হি হি করতে করতে আমাকে বললো, চলো লাফ দেই!
পানির মধ্যে বৃষ্টির সুর অন্যরকম। যেন তানসেনের দ্বিতীয় লয়! পানির মধ্যে গলা বের করে ভেসে আছি আমি। আকাশে ছাই রঙা মেঘ, একেবারে কানের কাছটায় ঢেউ এর বক্রতলে জলশব্দ! খুশিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আমরা। চশমা রেখে আসায় আমাদের দুজনেরই চোখে বিস্মিত ভাবটা একটু বেশি ফুটে উঠছে বোধ হয়। শরীর হালকা করে দিয়ে আবার স্বপ্নে ভেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
ভাইয়াদেরকে নামতে দেখলাম একবার।
পাশেই অদূরে ছোট্ট ছাতা মাথায় এক কিশোরীকেও অবাক চোখে নদী-বৃষ্টি মাখামাখি প্রত্যক্ষ করতে দেখলাম যেনো, খুব পরিচিত লাগলো মুখটা আমার।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০০৮ দুপুর ২:১৫