somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনবৃক্ষ-৩

১৪ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেঘের ওপর আকাশ ওড়ে,
নদীর ওপার পাখির বাসা,
মনে বন্ধু বড় আশা...


সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলো বৃষ্টির শব্দে। টিনের চালে বৃষ্টি। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না একটুও। মাথার কাছে ভাইয়া আর আপা বসে চা হাতে নিয়ে গল্প করছে। মা এসে জানালো ঘরের উঠানেও পানি চলে এসেছে! বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণ নেই। আমি শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছি আর ভাইয়ার গল্প শুনছি।
আপা ডেকে যাচ্ছে একটু পর পর আমাকে। ভাইয়া বললো, থাক , আরেকটু ঘুমাক।
আরেকটু যখন বেলা হলো, আর চারপাশটা আরো অন্ধকার করে আরো যখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো, তখন উঠলাম আমি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি উঠানের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
পানি চলে এসেছে অনেক দূর! বাউন্ডারির কাছ দিয়ে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো ধুয়ে গিয়েছে বেশ। সামনের কৃষ্ণচূড়ার ডালে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে কয়েকটা ভেজা শালিক।
আমার খুব ইচ্ছে হলো কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দেই উঠানটায়।
ছোট আমগাছটার ডালপালা এমন করে পানিতে ঝুঁকে আছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন আমাজনের রেইনফরেস্টের কোন জায়ান্ট ট্রি। জায়গাটাকে কল্পনার কুয়াশায় নিয়ে গেলাম আমি বারান্দার গ্রিল এ মাথা ঠেকিয়ে।

পানিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কচুপাতাগুলোকে মনে হলো জায়ান্ট ভিক্টোরিয়া লিলি! এখুনি যেনো মাথা ভাসিয়ে দিয়ে সরসর করে এপাশ থেকে ওপাশে অলস ভঙ্গিতে চলে যাবে বোয়া কন্সট্রিকটর, আমাজনে বসবাসকারী সুরিনামের সেই ভয়াবহ সাপ!
আমার স্বভাবসুলভ কল্পনায় হারিয়ে যাচ্ছি আমি, টের পাচ্ছি।

আমি সত্যি সত্যি কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দিলাম। একটা ছোট্ট ছাউনী দিতে ভুললাম না নৌকাটায়। যদি বৃষ্টিতে ভিজে যাই আমরা!
আমরা, মানে আমি , ভাইয়া আর সাইফুল। আরেকজনকে নিতে ইচ্ছে হলো খুব। সেই খুব অনুসন্ধিৎসু মনের কিশোরীর কথা মনে হয়ে গেলো হুট করেই!
একটু লজ্জ্বা লজ্জ্বা লাগলেও নিয়েই নিলাম তাকে।
কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিছুই জানি না। শুধু জানি ওই দুর্ভেদ্য অরন্য পার হতেই হবে আমাদের।
ভাইয়া শংকিত মুখে বোটের স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না সামনে। হাউসবোট টা দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁটে আমরা কেউ ডেক-এ বের হতে পারছিনা। আপা আর বাবুলী ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ার দিকে। আমার চোখ গোগ্রাসে গিলে চলেছে আমাজনের সবুজাভ পানির ওপর বৃষ্টির ছাঁট, এপিফাইটেস আর সারক্রোপিয়া গাছের ডাল থেকে বেয়ে আসা লিয়ানা লতা আর চারিদিকের আধো-অন্ধকার এর মধ্যে ঢিমিয়ে চলতে থাকা বোট টার মধ্যে ব্রাজিলিয়ান কফির গরম গরম ধোঁয়া!

দুপুর বেলা সর্ষে ইলিশ হবে শুনলাম। বৃষ্টির তেজ একটু কমে এসেছে। আমাদের হাইসবোট টা ডুবে গেছে! আমাদের কার কি হাল, কে সাঁতরে কোথায় উঠলাম সেটা ভাববার অবকাশ পেলাম না। আপাতত অন্য বিষয়ে উত্তেজিত, ভাইয়ার সাথে নদীর দিকটায় সাঁতরাতে যাবো। সাঁতারে দুই ভাই-ই পটু, তাই বাড়ি থেকে আপত্তি করলো না মা।

আমাদের পাড়া থেকে একটু বের হলেই কাঁচা রাস্তার শুরু। সেটা বেশ কিছুদূর নেমে গেছে একটা গ্রামের দিকে। ওইখানে যাবার পথেই ছোট শাখানদীটি পড়ে। ওই ছোট কাঁচা রাস্তাটি দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, বৃষ্টির তোড় একটু বেড়েও গেলো যেন। রাস্তার একপাশ টায় ধান ক্ষেত ,আর অন্যপাশটায় বুনো সুপারিগাছ এর সারি। অনেক জংলি লতায় পাতায় ভরে গেছে যায়গা টা। রাস্তায় লোকজন নেই তেমন। দু একজনেও বা আসা যাওয়া করছে, ছাতি মাথায়, নিতান্তই অনিচ্ছা সত্বেই বের হতে হয়েছে যেনো। পাশ দিয়ে যাবার সময় ছাতার ওপর বৃষ্টির শব্দটা শুনতেও দারুন লাগছিলো আমার!
বড় কচু গাছগুলির নিচে গুটিশুটি মেরে থাকা পাতিহাসগুলোও যেন অলস দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আর সব লোকজনদের মতো পাগল গোছের কেউ ভাবছিলো হয়তো!
আমার খুব মনে হতে লাগলো, মানুষজন আসলেই বেরসিক। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে, ভাইয়াও জবাব দিলো না তেমন। তাড়াতাড়ি চল রে, বলে স্মিত হাস্যে পা চালাতে থাকে। আমার মনে হল, সাইফুল থাকলে কি ভালোই না হতো! সাইফুল কে আশা করাও ঠিক না। ওর যদি আমার মতো একটা ভাইয়া থাকতো!

মানুষজন বড্ড বেরসিক! আবারও ভাবতে থাকি আমি।

নদীর পাড়টায় প্রকান্ড দু-চারটা কড়ই আর বটগাছ দাঁড়িয়ে। বট গাছটার নিচেই রাস্তার দিকে মুখ করে পুরি-সিঙারার ছোট্ট হোটেল। সামনেই সরিষার ক্ষেত। পাশেই নদীর এই কিনারাটায় গোটাকয়েক তাল গাছের গুঁড়ি ফেলে বানানো হয়েছে ঘাট। মানুষজন বিকালে সকালে এদিকটায় প্রায়ই আসে বেড়াতে, এক বুক খোলা বাতাসের লোভেই হয়তো।
নদীর কাছটায় এসে আমি অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। ঝমঝম বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছোট ছোট সব ছেলের দল দাপড়ে বেড়াচ্ছে চন্দনা নদীর বুকে।
আমার দিকে চেয়ে ভাইয়া বললো, এর চাইতে রসিক মানুষ আর কোথায় পাবি বল।
চোখে মুখে মাথায় বৃষ্টি নিয়ে আমি দেখছি ছেলের দলের গাছ থেকে ঝাপিয়ে পড়ার দৃশ্য! ভাইয়ার বন্ধুরা হোটেলটায় বসে, হাত নেড়ে ডাকলো ভাইয়াকে দেখে।
আমি এসে দাঁড়ালাম কড়ই গাছটার নিচে।

সারা নদীর ধূসর পানির বুকে কী অদ্ভুদ রিমঝিম শব্দে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। দূরে একটা দুটা মন খারাপ করা নৌকাগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। কি জানি তার মধ্যে হয়তো জেলেরা আয়েশ করে স্টোভ এ ভাত রাধছে কিম্বা নকশা কাটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ছই এর মধ্যে।

পরিচিত গন্ধ পেতেই পেছনে ফিরলাম আমি, তাকিয়ে দেখি চুল সজারুর কাঁটা করে সাইফুল দাঁড়িয়ে! হি হি করতে করতে আমাকে বললো, চলো লাফ দেই!

পানির মধ্যে বৃষ্টির সুর অন্যরকম। যেন তানসেনের দ্বিতীয় লয়! পানির মধ্যে গলা বের করে ভেসে আছি আমি। আকাশে ছাই রঙা মেঘ, একেবারে কানের কাছটায় ঢেউ এর বক্রতলে জলশব্দ! খুশিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আমরা। চশমা রেখে আসায় আমাদের দুজনেরই চোখে বিস্মিত ভাবটা একটু বেশি ফুটে উঠছে বোধ হয়। শরীর হালকা করে দিয়ে আবার স্বপ্নে ভেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।

ভাইয়াদেরকে নামতে দেখলাম একবার।
পাশেই অদূরে ছোট্ট ছাতা মাথায় এক কিশোরীকেও অবাক চোখে নদী-বৃষ্টি মাখামাখি প্রত্যক্ষ করতে দেখলাম যেনো, খুব পরিচিত লাগলো মুখটা আমার।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০০৮ দুপুর ২:১৫
১০টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×