somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প - অপেক্ষা

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুই ভাল লাগছে না। না গান, না কবিতা অথবা সিনেমা। আজ বড় বেশী একাকীত্বে ভুগছি। পুরানো ফার্নিচারগুলো অফিসের স্টোররুমে যেভাবে অযতেœ, অবহেলায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকে, তেমনি পুরানো আসবাব পত্রের সাথে মিল খুঁজে পাই নিজের। ধুলোর উপর ধুলোর পরত পরছে ওখানে। মাঝে মাঝে পরিষ্কার করা হয়। ওগুলো আছে কবে সের দরে লাকড়ী হিসেবে বিক্রি হবে তার অপেক্ষায়। চুলোর আগুনে জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে তবেই তো মুক্তি। মুখের ভেতরটা টক-টক হয়ে আছে। বুয়ার বানানো চা খেলেই মুখটা এমন হয়ে যায়।

কিছুক্ষন আগে শীলা ফোন করেছিল। গত ক’দিনের মতই রাগ করে ফোনটা আগে আমিই রেখে দিয়েছি। ও ফোনে বুয়ার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। আমি দেইনি। এভাবেই কথা বাড়তে বাড়তে এক সময় ধ্যত বলে কলটা কেটে দিয়েছি। জানি একটু পর ও আবার ফোন করবে। কিংবা আমি করব। তারপর কেন মোবাইল কাটলাম তার কৈফিয়ত চাইবে ও। আমি দেব কিংবা দেব না। দিলেও সে বুঝতে চাইবে না। সত্যি বলতে কৈফিরত দেবার কিছু নাইও। কথা শুনতে ইচ্ছা করছিল না। তাই কেটে দিয়েছি।

দিনকে দিন আমাদের দু’জনের ভেতর দূরত্ব বাড়ছে। অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না। নিজেদের পছন্দের বিয়ে। মা-বাবা অমত করেছিলেন। শুনিনি। কিন্তু তাদের ছাড়া বিয়ে করতে চাইনি বলে অপেক্ষা করেছিলাম। শেষকালে বিয়ে হল। সবকিছ্ইু ঠিক ছিল। কিন্তু তারপরও কিছুই ঠিকভাবে চলছিল না। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বিরাট এক গোলক ধাঁধা। এই গোলক ধাঁধা আরও বাড়ল যখন তার চাকুরিটা হল। দু’জন দু’জায়গায় থাকি। ভালবাসার দিনগুলোর মত মোবাইলে আলাপ করি। কিন্তু দুই সময়ের আলাপের বিষয়বস্তু ভিন্ন। ধীরে ধীরে টের পেলাল ভাব-ভালবাসার বিয়ে এ সমাজে প্রায় সহনীয় হয়ে আসলেও পুরো ব্যাপারটা মেনে নিতে মা-বাবারা যেমন অভ্যস্ত হয়নি তেমনি অভ্যস্ত হয়নি আমরা স্বামী-স্ত্রীরাও। কিন্তু জীবন বড় জটিল। সব বুঝেও তার সমাধান করা যায় না। অপরিচিত লোকের বুটের লাথি খেয়েও আমরা নিরবে সহ্য করতে জানি। অথচ আপনজনের চুলের আঘাতেও সম্পর্ককে একেবারে দফারফা করতে ছাড়ি না। হয়ত প্রত্যাশার ভারে ভেঙ্গে পড়ি কিংবা ভালবাসার শক্তির উল্টোদিকেই তীব্র অভিমানরূপী ঘৃণা জমে থাকে তার খেয়াল করি না। এসব থাক। এসব কথায় মনের ভেতরের শূন্যতা বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপকার পাচ্ছি না ।

ওর পোস্টিংটা রাজধানীতে। চাকুরিটা বেসরকারী। বেশ ভালো বেতন দেয় ওরা। সত্যি বলতে ও যা পায় তা দিয়ে তা দিয়ে আমার মত সরকারী চাকুরের মাস তিনেকের বেতন হয়েও কিছু থেকে যাবে। আমাকে থাকতে হয় মফস্বলে। একটা রুম নিয়ে থাকি। সপ্তাহে সপ্তাহে ঢাকা যাবার চেষ্টা করি। সব সময় যে যেতে পারি তা নয়। বরং আজকাল শুক্র-শনিবারই যেন কাজটা বেশী থাকে। আমার ছুটি দু’দিন। তার একদিন। কাজেই বৃহস্পতিবার রাতের ভেতর বাসায় না ঢুকলে তার সাথে দেখা হবার সময় থাকে না। বাসায় পৌঁছানোও এক বিরাট হাঙ্গামার কাজ। ঢাকায় যেতে যত না কষ্ট তার থেকে বেশী কষ্ট বাস, রিকশা পাল্টে মহল্লার গলির ভেতরের ফ্ল্যাটটাতে পৌঁছানো। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বারোটা বাজবেই। পরের ঘটনাগুলো একই রকম পুনরাবৃত্তি হয়। গোসল করে, খাবার খেয়ে সোজা বিছানা । ক্লান্ত বিছানাতে ঘুম ছাড়া আর কিছুই জমে না। পরের দিন আটপৌরে কাজ করতে করতে দিন শেষ। রাত পেরোলেই তার ব্যস্ততা। আর দিনটা গড়ালে আমার ছুটে চলা। এভাবেই চলছে। মাঝে মাঝে ভেঙ্গে পড়ি। তারপর মনকে সান্ত¦না দেই। আর কয়েকটা বছর। হয় ঢাকায় ট্রান্সফার কিংবা চলার মত কিছু জুটাতে পারলেই চাকুরিটা ছেড়ে দেব। এখানে-ওখানে তদবির করি। কারও ট্রান্সফার হয়। কেউ বা অপেক্ষা করে সরকার পরিবর্তনের। এদের মধ্যে অনেকেই ঢাকায় ছিল কোন এক সময়। চেয়ার আঁকড়ে থাকার জন্য গায়ের চামড়াও মোটা করেছিল। দু’কান কেটে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলাফেরা করাও রপ্ত করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারে নাই।

হয়ত কারও বিরাগভাজন হয়ে কিংবা কোন সমীকরনের হিসেবে বিয়োগ হয়ে মফস্বলে আসে তারা। তারপর শুরু করে চেষ্টা। এর বাইরে যারা আছে তারা নিজেদের ভবিতব্য মেনে নেয়। একটা করে তোষক, কম্বল, বালিশকে সঙ্গী করে মফস্বল থেকে মফস্বলে ঘুরে বেড়ায়। নতুন জায়গায় পুরাতন চৌকি খোঁজে। অফিস থেকে একটা টেবিল, চেয়ার, থালা-গ্লাস জোগাড় করে নেয়। সৌখিন হলে একটা টিভিও থাকে তাদের সাথে। চৌকিদার, পিয়নরা নিয়মিত বাজার করে দেয়। বুআর রান্না ভাল না হলে হৈ-চৈ করে। তারপর সময় হলে যেভাবে বিক্রেতা খুঁজতে খুঁজতে মেসে এসে উঠে তেমনি ক্রেতা খুঁজতে খুঁজতে মেস থেকে বিদেয় নেয়। এ সবই মফস্বলের আমার মত চাকুরিজীবীদের জীবনের নিয়মিত দৃশ্য।

আমাদের কেউ সরকারী, কেউ বেসরকারী। আমার মত জামাই-বউ দু’জনই চাকুরিজীবী হলে যৌবনকাল থেকেই বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন যাপন শুরু হয়। চাকুরিজীবী দম্পত্তির সংসার করার জন্য কত কাঠ খড় পোড়াতে হয় তার খবর এদেশের ক’জন রাখে। হেড অফিসে গেলে দেখি সংসার আঁকড়ে থাকার জন্য সাথে সাথে সামলাতে হয় অফিসের চেয়ারও। কেবল পোস্টিং ধরে রাখার জন্য এদেশের চাকুরিজীবীরা কত অপরাধ বিনে পয়সায় করে দেয় তার পরিসংখ্যানটা নিশ্চয়ই চমকে যাবার মত হবে। আর যে চাকুরের বউ কেবলই গৃহিনী তারও রক্ষা নাই। যৌবন কালটা একত্রে পার করলেও ছেলেমেয়ের পড়ালেখার জন্য সংসারকে কেন্দ্র চাকুরিজীবীরা ঘুরতে শুরু করে। যেমন ঘুরছিলেন আমাদের বাতেন সাহেব। ছেলেটা কলেজে আর মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছর দশেক ধরে পরিবারকে ঢাকায় রেখে তিনি মফস্বলে, মফস্বলে ঘুরেছেন। মাসে শেষে ঢাকা যেতেন। এক সপ্তাহ থেকে ফিরতেন। মেসে আমার পাশের রুমেরই থাকতেন। আমার মত সংসার নিয়ে তার ছটফটানিটা কম। কারন সয়ে গিয়েছিলেন। মারফতি কথা বলতেন আসর জমিয়ে।

আড্ডাবাজ বাঙ্গালী অফিসারদের সন্ধ্যার এই আসরে বয়স কোন বাঁধা হত না। মাঝে মাঝেই বলতেন , এই যে একা একা একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি ওদের জন্য ওরা কি মনে করবে আমাকে?

কেন করবে না?- আমাদের প্রশ্ন ছিল। আমরাই আবার উত্তর দিতাম পরের লাইনে। নিশ্চয়ই করবে।

বাতেন সাহেব বিষন্ন হাসি হাসতেন। না। করবে না। আমার মা-বাবাও তো আমার জন্য কত কষ্ট করেছে জীবনে। আমি ক’দিনই বা তাদের কথা মনে করেছি। আমরাই করি না আর আমার ছেলে-মেয়েরা সামনের বন্ধনহীন সমাজে মনে করবে এইটা আপনারা বিশ্বাস করেন?

এই প্রশ্নের উত্তর আমরা মুখে আনতে চাইতাম না। কারন উত্তরটা আমাদের পছন্দের না।

তবে তারপরও সবাইকে নিয়ে থাকার বাসনাটা মাঝে মাঝেই প্রকাশ করে দিতেন তিনি। এই সেদিনও বলেছিলেন, আর না । অনেক হয়েছে। এই বছর শেষ হলেই ফুল পেনশন পাব। চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় একটা দোকান নেব।

বাতেন সাহেবের মেয়েটা সেদিন চাকুরি পেয়েছিল। বাতেন সাহেবের অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে এসেছিল। কিন্তু বিধাতার হিসেব বড় অন্যরকম। বাতেন সাহেব গতরাতে ঘুমের ভেতর মারা গিয়েছেন। আমি পাশের রুমেই ছিলাম। টের পাইনি। তার লাশটা ট্রাকে তুলে দিয়ে চা খেতে খেতে এই জীবনের কথাই ভাবছিলাম। এর ভেতরই বউয়ের ফোন। এ কথা -সে কথার পর আর ভাল লাগছিল না। কলটা কেটে দিলাম।

অন্য জীবনে আটকা পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর নিজ জীবনে ফেরৎ যাওয়ার অপেক্ষার প্রহরে কোন কিছুই আসলে ভাল লাগে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:৩৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×