জীবনে একটা মাত্র পরীক্ষা দিতে গিয়ে মনে হয়েছিলো, আমি কি পরীক্ষা হলে, নাকি কোনো দু:স্বপ্নের ভেতর আছি? দশম শ্রেণীর টেষ্টের কেমেষ্ট্রি পরীক্ষায়। ঘটনাটা গোড়া থেকে বলি।
১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আমরা। বিজ্ঞান ক্লাসে আতাউর স্যারের সাথে বড় রকমের দ্বন্দ্ব হয়ে গেলো পুরো ক্লাসের। বিষয়টা হেড স্যার তৎক্ষনাত সমাধান করতে পারেন নি। পারেনি পরের দিন মিটিং ডাকা ম্যানেজিং কমিটিও।
ফলাফল। আমরা স্যারের ক্লাস বয়কট করলাম।
স্যার প্রচন্ড রকম মেধাবী, রাগী ও বদমেজাজী ছিলেন। ব্যাপক রাগী বলতে মারাত্মক ব্যাপক। এমনকি হ্যাড স্যারকেও তিনি ধমক মারতেন। আমরা ক্লাস বয়কট করায় তিনি আহত বোধ করলেন। এবং বললেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন।
কারণ স্যার ভাল করেই জানতেন, এই স্কুলে রসায়ন পড়ানোর মতো একমাত্র তিনিই আছেন। সুতরাং সাইন্স যারা পড়বে তাদেরকে ধর্না দিতেই হবে।
এভাবে সপ্তম শ্রেণী শেষ হলো। অষ্টম শ্রেণীতে উঠে আমি এবং আরও কয়েকজন ছাত্র বিষয়টা মীমাংসা করতে চাইলাম। কিন্তু বেশ কিছু ঘাওরা বন্ধু এবং আমাদের প্রতি স্যারের প্রচন্ড রকম ক্ষোভের কারণে বিষয়টা সফল হলো না।
এভাবে নবম শ্রেণী শুরু হয়ে গেলো। হেড স্যারের কঠিন নির্দেশ, ক্লাস করতেই হবে। বাধ্য হয়ে রসায়ন ক্লাস করতেই হয় আমাদের। স্যার ক্লাসে ঢুকেন, চোখ নিচু করে লেকচার দিয়ে চলে যান। আমরা মাথা নিচু করে শুনে যাই। এভাবে কেটে গেল আরও দু’টি বছর।
টেষ্ট পরীক্ষা ঠিক আগে, শেষ ক্লাসের দিন স্যার ক্লাস শেষ করে বের হয়ে যাচ্ছেন। এক পা ক্লাসরুমের বাইরে দিয়ে ঘাড়টা ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন আর বললেন, দেখুম কোন বাপের বেটা কেমেষ্ট্রিতে পাস করে।
ব্যাস! যা হবার তাই হলো।
এমন রসায়ন প্রশ্ন জীবনে দেখিনিরে বাপ। ১ ঘন্টার আগে খাতা জমা নেয় না। সাইন্সের সবাই মিলে ১ ঘন্টা ঘুমালাম। প্রথম বেলটা বাজতেই সবাই ত্যাগ।
সাইন্সের সকল ছাত্র রসায়নে ফেল করলো। এবং স্যার স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানালেন, সাইন্সের একটা ছাত্রও এসএসসি দেওয়ার যোগ্য না। এদের পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি যেন না দেয়া হয়।
আমার বাবা স্কুলের মেনেজিং কমিটিতে ছিলেন। ভিতরের খবর অনেক কিছুই পেতাম। ঘটনার সেদিকে আর গেলাম না।
শেষ পর্যন্ত সাইন্সের সবাই এসএসসি পরীক্ষা দিলো। কোনো ছাত্র ফেল করলো না, মেধাবী একজন বাদে। তাও অন্যরকম একটা দুর্ঘটনার কারণে।
আমাদের SSC পরীক্ষার ঠিক চার দিক আগে স্যার রিটায়ার্ড করেছিলেন। সাইন্সের সব ছাত্ররা মিলে রিটায়ার্ডের তিনদিন আগে স্যারে পায়ে ধরে মাফ চেয়েছিলাম। মাফ করেছিলেন কিন্তু স্যার সেদিন কিছুই বলেননি। শুধু বলেছিলেন, ভাল করে পরীক্ষা দিস। সেদিন স্যারের ক্ষোভ আর জেদের মাত্রাটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।
আমার বাবাও শিক্ষক হওয়ায় স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ গভীর ছিল। কিন্তু ঘটনার পর সবকিছু কেমন যেন উলট-পালট হয়ে গেল।
ঘটনার পর কেটে গেল অনেকটা সময়। স্যারের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। বেশ কিছুদিন আগে ট্রলার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি। ঢাকা ফিরবো। স্যারও আসলেন সেখানে, তার ছেলেকে ট্রলারে উঠিয়ে দিতে। আমাকে দেখে স্যার ডাক দিয়ে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন। অনেক বিষয়ে কথা হলো। বেশ কিছু হতাশা নিয়ে কথা বলতে বলতে স্যার কেঁদে দিলেন। বাদ যায়নি ১৯৯৯ সালের সেইদিনের পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও। আমার কাঁধে হাত রেখে স্যার যখন কাঁদছেন তখন স্যারকে মনে হচ্ছিল ৫ বছরের কোন শিশু।
নাহ! আমি সেদিন কোনো শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করিনি। স্যারকে কাঁদতে দিয়েছি। দেখতে চেয়েছি ইস্পাতসদৃশ্য কঠিন একটা মানুষের ভিতর কিভাবে একটা কোমল মন লুকিয়ে থাকে। তবে কান্না থামানোর জন্য স্যারের পিঠে হাত রেখেছিলাম। আমি নিজেই তখন শিক্ষক হওয়ায় স্যারের অনুভূতিটা বুঝতে কষ্ট হয়নি।
আমার ক্লাসমেটদের কাউকে ঘটনাটা বলিনি। ওদের কেউ হয়তো স্যারের ভেতরটা কোনদিন জানতে পারবে না।
স্যার, সাবানের বিক্রিয়াটা ভুল করার জন্য আপনার বজ্রকণ্ঠের ধমক আর খাওয়া হবে না !!
আমি দু:খিত স্যার,
১৯৯৯ সালের সেই ঘটনার পর আপনি আমার কাছ থেকে কি আশা করেছিলেন আমি তা জানতাম।
কিন্তু পারিনি, স্যার। আমি পারিনি। আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
Note : সেদিন স্যারের কি এমন করেছিল সেটা জিজ্ঞেস করে আমাকে ব্যাথিত করবেন না। আমি ভুলে যেতে চাই।
[একটা বিশেষ ঘটনা পুরোনো ঘটনাকে আবার মনে করিয়ে দিলো]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




