যে ভাষায় মানুষ পড়াশোনা করে, সে ভাষা তার ভেতরে একটা বড়োসড়ো জায়গা করে নেয়। সেটা সাধারণতঃহয় তার ‘আপন’ ভাষা, বীরবল যখন দরবারের বহূভাষাবিদকে আচমকা ধাক্কা দিয়েছিলো, সে ‘সড়া অন্ধ অছি’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলো, তাতে বোঝা গেছিলো সে ওড়িয়া। প্রথম ভাষাটি মানুষের মধ্যে এই জায়গাটি পায়। মাত্ত্রিভাষা মানে মায়ের ভাষা নয়, মাতৃ ভাষা হচ্ছে মানুষের ‘প্রাণের সুর’। একটি বাচ্চাকে বারোবছর ইংরেজীতে পড়াশোনা করিয়ে তার কাছ থেকে ‘মাতৃভাষা’ আশা করা অন্যায়, অন্যায্য। তখন আর তাকে বলা যায় না ‘বাংলায় ডায়েরী লেখো’, সাহিত্য চর্চা করছ? বাংলায় করো।
বাংলা মিডিয়ামে যারা পড়েছে তারাও, বিশেষতঃ ঢাকা শহরে, আজকাল নিজের সাকিন সম্পর্কে একটু হীন বোধ করে। দ্রুত কমতি টা পুষিয়ে নিতে চায় নীলক্ষেত থেকে কিনে ইংরেজী বই পড়ে বা অন্য কোন ভাবে।এবং নিজের ছেলেমেয়ের বেলায় এ ভুল শুধরে নেয় তাদের ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে। সব বাবা মাই চায় তারা যে ‘আধুনিক’ ‘সুবিধা’ পায় নি, ছেলেমেয়ে যেন সেটা পায়।
বিশেষতঃ ছোটবেলা থেকে বাবা মা দের আমরা ইংরেজীর ওপর যে রকম গুরুত্ব আরোপ করতে দেখি, অবচেতনেই ধারণা হয়ে যায় যেনো বাংলার স্থান এর নিচে। একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে যদি বিশ জনকে নাম সই করতে দেন, অন্তত বারো জন করবে ইংরেজীতে। এটাকে আমি ভালো বা মন্দ বলছি না। কিন্তু এই প্রবণতাটা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা দিচ্ছে ঠিকই।
আমাদের মুখে মুখে সংখ্যা-তারিখ-ঘড়ির সময়গুলি, সপ্তাহের বারের নামগুলি ইত্যাদি থেকে বাংলা উঠে ইংরেলী হয়ে যাচ্ছে।
একসময় হিন্দি চ্যানেলগুলিতে দেখতাম ওরা সংখ্যা হিন্দিতে বলেও না, লেখেও না।ওদের এই দৈন্য দেখে তখন মজা পেয়েছি,বিদ্রূপে হেসেছি।
বাংলা কোন প্রান্তিক ভাষা নয়। ধার করা বর্ণমালায় লেখা, দশ-বারোটি শব্দ ও চার পাঁচশো ভাষাভাষী সহ কোন অনগ্রসর, দূর্বল ভাষা নয়। এটি একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য বহনকারী, অজস্র মানুষের মুখে বহতা ভাষা। আমাদের সাহিত্যে গর্ব করার মত অনেক অনেক বই আছে, বিভিন্ন প্রসঙ্গের, বিছিন্ন আঙ্গিকের, বিভিন্ন ধারার, ষাখা-প্রষাখা ও মতবাদের, অনেক সাহিত্য-আন্দোলন, গোষ্ঠী,তর্ক-বিতর্কে জীবন্ত সাহিত্য আছে। এখনো বাংলায় বেশ কটি প্রধান দৈনিক বেরুচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত বিষিয়ে এখনো চাইলে সম্পূর্ণ বাংলায় পরীক্ষা দেওয়া যায়। এ ভাষার কারো কৃপাপ্রার্থী হবার দরকার নেই। অথচ বাঙ্গালীদের বই পড়ার প্রবণতা সবসময়ই কম, আজকাল অনেক বাড়িতেই শুধু একটি ইংরেজী পত্রিকা রাখার চল হচ্ছে। বাংলায় এমনকি রাষ্ট্রবিজ্ঞান,নৃতত্ত,লোকপ্রশাসনও আর পড়া হয় না
আমেরিকানরা রেড ইন্ডিয়ান জাতিসত্বা ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে, এখন চলচ্ছিত্রে, সাহিত্যে, পাঠ্যবইতে অনুশোচনা করে। বাঙ্গালী ও অন্যান্য দূর্বল মেরুদন্ডের জাতি এখন নিজস্ব ভাষা গুলি নষ্ট করে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদের উত্তরাধিকারীরা আমাদের বোকামীর মাত্রা বুঝতে পারবে ও প্রত্নতত্মের মতো ভগ্নাংশ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
টেলিভিশনে যখন কোন বিশেষজ্ঞ মতামত দেন, বা বাংলাদেশ ্জেতার পরে ইত্যাদি সময় সাধারণ মানুষ,প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়,বা যখন নামীদামী ব্যাক্তিদের সাংবাদিকেরা মন্তব্যের জন্য মাইক নিয়ে ছেঁকে ধরে, তখন বঝা যায় শিক্ষার দশা...।। এক এক জন যে শুধু পরপর গুছিয়ে পাঁচটা বাংলা বাক্য বলতে পারে না তা না, বাংলা ইংরেজী মিশিয়ে জগাখিচুড়িতেও তারা অনেকে কোন গোছানো বা অর্থবহ মতামত দিতে পারেনা।
টক শো গুলিতে ‘বিশেষজ্ঞ’, ‘সরকারী কর্মকর্তা’, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক’ প্রমুখদের বাংলার ছিরি দেখে হাসিও পায়, লজ্জাও লাগে। এমনকি আঞ্চলিক ভাষারও একটা ব্যাকরণ থাকে, সে ভাষাতেও অসংলগ্ন কথা বললে মানুষ তাকে ভুলটা চিহ্নিত করে দিতে পারবে, শুধরে দিতে পারবে। একজন শিক্ষিত প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ কেনো বলবে ‘we are looking for শত্রুS ?’