somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালাঃ ডেনালী, আলাস্কা (৩)

২১ শে এপ্রিল, ২০০৭ দুপুর ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডেনালীতে বা আশে পাশে অনেক হোটেল, মোটেল আছে, কিন্তু ভয়াবহ দাম৷ সস্তা খুজতে গিয়ে বেশ দুরে যেতে হলো৷ বেড এ্যান্ড ব্রেকফাস্ট৷ বয়স্ক মহিলা নিজের বাসার রুমগুলো ভাড়া দিচ্ছে৷ এমনিতে খারাপ না৷ কাচা রাস্তায় মাইলখানেক গাড়ি চালাতে হলো৷ বেশ অন্ধকার, ১০/২০ মাইলে হয়তো আর কিছু নাই, কেমন খা খা শুন্যতা৷ রাতে একটু ভয়মেশানো অনুভুতি হচ্ছিল৷

খোলা মাঠের মতো জায়গায় বুড়ির দোতলা বাড়ি৷ আরও কাস্টমার আছে, তাই চুপচাপ চাবি নিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম৷ কথা ছিল অরোরা দেখার চেষ্টা করব, যদিও প্লেনে দেখে আসছি, এখন মাটি থেকে দেখতে চাই৷ ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে এলাম৷ ঘুটঘুটি অন্ধকারের মধ্যে বিশাল আকাশ৷ ভয়াবহ৷ আকাশটাও কেমন অপরিচিত৷ ধ্রুবতারা সবসময় উত্তর দিগন্তে দেখে এসেছি, এখানে একদম মাথার উপরে৷ সপ্তর্ষী মন্ডলও তাই৷ আমাদের দেশে যেমন তারা গুলো পুর্ব থেকে পশ্চিমে যায়, এখানে ব্যাপারটা তা নয়৷ ধ্রুবতারা যেমন কখনই অস্ত যায় না এখানে৷ সপ্তর্ষী, লঘু সপ্তর্ষী, ড্রাকো সারারাত আকাশে থাকে, ধ্রুবতারার চারপাশে ঘুরতে থাকে৷ কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল আমার৷ কে জানে ঝোপঝাড়ে হয়তো কোন ভাল্লুক লুকিয়ে আছে৷ মিনিটখানেক আকাশ দেখে দৌড়ে রুমে ঢুকলাম, থাক পরে দেখবো সবার সাথে, একা দেখে কাজ নেই৷

সকালে তাড়াতাড়ি উঠলাম৷ ৮ টায় ডেনালীর বাস৷ ১৩/১৪ ঘন্টার জার্নি৷ ব্রেকফাস্ট ছিল ভালই, মাফিন, ব্রেড, ডিম, কমলার রস এসব৷ খেয়েদেয়ে বুড়ির সাথে ছবি তুলে ডেনালীর রাস্তা ধরলাম৷ একবার বাসে ঊঠলে কোন খাওয়া নেই, এজন্য সাবওয়ে থেকে স্যান্ডউইচ কিনলাম৷ বাসের টিকেট কিনতে গিয়ে দেখি আমার বাত্সরিক ন্যাশনাল পার্ক পারমিট এক্সপায়ার করে গেছে৷ আরেকটা কিনতে হলো৷ বহু লোকজনের ভীড়৷ ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছে অনেকে, কেঊ বাসে আমাদের মতো, অনেকে আবার গাইডেড ট্যুর নিয়েছে৷

ডেনালী, আলাস্কার মধ্যভাগের বিশালাকৃতি ন্যাশনাল পার্ক৷ ৯ হাজার বর্গ মাইল আকারে, মানে বাংলাদেশের পাচ ভাগের একভাগ৷ পুরো উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে উচু চুড়া এই পার্কের মধ্যভাগে, মাউন্ট ম্যাকিনলী৷ এমনিতে পাহাড়ি পার্কটার নীচু এলাকায় তৈগা বনভুমি, একটু উচুতে গেলে তুন্দ্রা এলাকা শুরু হয়েছে৷ তুন্দ্রার ঘটনাটা হচ্ছে মাটির নীচে এখানে জমাট বাধা বরফ, সারা বছরে কখনই ঐ বরফ গলে না, এজন্য বড় গাছ জন্মাতে পারে না৷ প্রানীর মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রীজলী ভালুক (বা ব্রাউন বেয়ার), বল্গা হরিণ, মূজ, ডাহ্ল ভেড়া, গ্রে উল্ফ৷

গ্রীজলী ভালুক তাদের হিংস্রতার জন্য পরিচিত৷ অনেকে দেখলাম পেপার স্প্রে (মরিচের গুড়া) নিয়ে এসেছে, ভালুককে ভয় দেখানোর জন্য৷ আমাদের অবশ্য বাস থেকে নেমে বীরত্ব দেখানোর কোন ইচ্ছা নেই৷ আর এমনিতে জংলী প্রানী খুব ভয় পাই, আমার আফ্রিকান পুর্বপুরুষরা লক্ষ বছর আগে সাভান্নাতে সিংহ দেখে যে ভয় পেত সেটা এখনও আমার ভেতরে আছে৷ চিড়িয়াখানায় ভয় লাগে না, কিন্তু যতবারই সত্যিকার জংগলে গিয়েছি ততবারই বেশ ভয় পেয়েছি৷ অথচ এখানে অনেকে বেশ অবলীলায় ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছে৷ গ্রীজলী ভালুকের আক্রমন বেশ কমন৷ যে বিরান এলাকা, কোন সেল ফোন, বা লোকালয় নেই কয়েকশ মাইলের মধ্যে, সুতরাং বিপদে পড়লে নিজের বুদ্ধিই ভরসা৷

বাসের ড্রাইভার নেটিভ আমেরিকান, হয়তো আলেউট বা আথাবাস্কান৷ রাস্তা বেশ আকাবাকা, এবং কাচা৷ ১৪ ঘন্টা এই জার্নি করতে হবে ভেবে একটু ভয়ই লাগছিল৷ শুরুতে গতদিনের বিকেলের মতোই প্রকৃতি , একটু ইনটেন্স৷ আস্তে আস্তে ইনটেন্সিটি আরও বাড়তে লাগলো৷ বাস একপাশের পাহাড় ঘেষে যাচ্ছিল, মাঝে বিশাল ছড়ানো উপত্যকা, আর আকাবাকা নিনানা (Nenana) (ছবি দিয়েছি) এবং স্যাভেজ নদী৷

বাসের যাত্রীদের বেশির ভাগ অন্যদেশ থেকে এসেছে, জাপান বা ইউরোপ থেকে৷ সবাই হাতে ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে রেডি৷ অনেকে দেখি একদম টেলোফটো লেন্স ওয়ালা ক্যামেরাও নিয়ে এসেছে৷ এত হাকডাক দেখে বেশ দাম দিয়ে কেনা SLR টা লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছিল৷ সবচেয়ে সহজলভ্য মনে হয় ক্যারিবু, অনেক দেখলাম রাস্তার আশে পাশে, মনে হয় এরাই গ্রীজলীর সহজ শিকার৷ আগের দিন একটা মুজ দেখলেও আজকে একটাও দেখলাম না৷ পাহাড়ের গায়ে কিছু ডাহ্ল ভেড়া (Dahl Sheep) দেখলাম, এত দুরে যে খালি চোখে বোঝা যাচ্ছিল না, দূরবীন দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে ভেড়া ছিল ওগুলো৷ কিন্তু দুপুর পর্যন্ত গ্রীজলীর দেখা মিললো না৷ আরেকটা ব্যর্থতা মাউন্ট ম্যাকিনলী দেখতে না পাওয়া, মেঘে পুরোটাই ঢেকে ছিল৷

দুপুরে একটু বিরতি দিয়ে বাস চলতেই রাস্তার পাশে মনে হলো ঝোপে কালো মতো কি যেন নড়ছে৷ ড্রাইভার তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল৷ নাহ, ঠিকই আছে একটা বাচ্চা ভালুক, তার মানে মা ভালুকটা নিশ্চয়ই কাছেই আছে৷ বলতে বলতেই বের হয়ে আসলো বিশালাকৃতির একটা গ্রীজলী৷ এরা মনে হয় মানুষের সাথে বেশ পরিচিত৷ তেমন পাত্তা দিল না আমাদের বাসটাকে৷ গাছগুলোর আড়ালে মনে হয় আরেকটা বাচ্চা ছিল৷ পানির ধারে একটু ঘুরে ফিরে আবার হেলে দুলে ভালুক বাচ্চা সমেত গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল৷ উত্তেজনায় বেশী ছবি তোলা হয় নি৷ তবে ১৪ ঘন্টা জার্নির পয়সা উসুল, ভালুক না দেখলে আসলে কষ্ট লাগতো৷

বাকী রাস্তা ক্যারিবু আর তুন্দ্রা দেখতে দেখতে ৩টার দিকে ওয়ান্ডার লেকে পৌছলাম৷ লেকের আশে পাশে বেশ বড় করে ওয়ার্নিং দেয়া৷ বেয়ার কান্ট্রি৷ যেকোনো সময় ঝোপ থেকে বের হতে পারে৷ বাসের ২০-৩০ জন লোক থাকাতে তেমন ভয় করছিল না৷ আর ভালুক ব্যাটারও তো ভয় আছে৷ অনেকে ব্লু বেরী খাচ্ছিল জংলা জায়গাটা থেকে৷ আমি মুখে দিয়ে দেখলাম এমন আহামরি কিছু না, দোকানে যেগুলো পাওয়া যায় ঐগুলাই, আধোয়া আর কি৷ বাথরুম টাথরুম সেরে নিলাম৷ ক্যামকর্ডারের ব্যাটারী দেখি যায় যায় অবস্থা৷ লোকালয় থেকে এত দুরে কোন ইলেকট্রিসিটিও নাই যে চার্জ দেব৷

আসলে যে টা ভুল করেছিলাম তা হলো যথেষ্ট খাবার না নিয়ে আসা৷ বিকালের মধ্যে ভালো ক্ষুধা লাগলো৷ ফেরার পথে ক্ষুধায় দেখি প্রাকৃতিক দৃশ্যও আর ভালো লাগছে না৷ দলের দু-একজন ঘুমিয়ে ক্ষুধা চাপা দেয়ার চেষ্টা করলো৷ সন্ধ্যা নাগাদ ফিরলাম, টায়ার্ড, তারওপর আধাদিন কাচা রাস্তার জার্নিতে শরীরে হাড়গোড় অনেকগুলাই ব্যথা করা শুরু করেছে৷

[চলছে…]
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×