somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরে নিহতের সংখ্যা, জেনারেল নিয়াজীর সাক্ষাৎকার ও কিছু প্রশ্নের জবাব!

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা চুটকি মনে পরে গেল। আগে সেটা শুনুন। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি।
একছেলে বেজায় পড়াচোর। যতই চাপ দেয়া হোক না কেন সে কিছুতেই বই নিয়ে বসে না। এই বেহাল দশা দেখে বাবা বাড়িতে তার জন্য মাস্টার রাখার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু মাস্টার মশাই বহুৎ চেষ্টা করেও তার সেই গুনধর ছাত্রকে ‘গরু’ রচনা ছাড়া আর কিছুই শেখাতে পারলেন না। সে যখনই বই পড়তে বসে তখনই গরুর রচনা পড়ে। “গরু একটি গৃহপালিত পশু। গরু খুব উপকারি প্রাণী। গরুর চারটা ঠ্যাং, একটা লেজ, দুইটা কান আর দুইটা চোখ আছে। গরু ঘাস খায়”।
সকালে ঘুম থেকে উঠেও চিৎকার করে করে সে পড়ে ‘গরু একটি গৃহপালিত পশু’, বিকেলেও একই কেজ আর সন্ধ্যা নামতে না নামতেই তাকে বিছানা আদুরে স্বরে ডাকে। সেই আদুরে ডাক ইগনোর করা তার পক্ষে ‘মুস্কিলই নেহি নামুনকিন’। সে হাই তুলে, চোখ রাঙিয়ে, পড়ার টেবিলে মাথা রেখে পড়ে, ‘গরু একটি গৃহপালিত পশু’!
এমনি করে করে পরীক্ষা চলে এলো। বাবা বলেছেন, ‘এবার পাস করতে না পারলে হাল চাষ করতে লাগিয়ে দেব। মনে রাখিস’। বালকের সেকথা স্পষ্ট মনে আছে।
কিন্তু পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রশ্ন দেখেই মাথায় হাত দিল সে। সে আজীবন পড়ে এসেছে গরুর রচনা আর পরীক্ষায় এসেছে কিনা ‘আমাদের গ্রাম’! এবারও আগের বারের মত ফেল ছাড়া গতি নেই। কিন্তু বালকের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে আল্লাহর নাম নিয়ে ‘আমাদের গ্রাম’ লেখা শুরু করে দিল।
“আমাদের গ্রামের নাম ঢাকা। এখানে অনেক মানুষ বাস করে। আমাদের গ্রাম অনেক সুন্দর। আমাদের গ্রামে একটা গরু আছে। গরু একটি গৃহপালিত পশু। গরু খুব উপকারি প্রাণী। গরুর চারটা ঠ্যাং, একটা লেজ, দুইটা কান আর দুইটা চোখ আছে। গরু ঘাস খায়। গরু আমাদের দুধ দেয়। গরুর দুধ খুব মিষ্টি। দুধ আমাদের পুষ্টি দেয়............................................”।
এই হল অবস্থা। এরকম আরেকটা লিখে গিয়েছেন সৈয়দ আলী সাহেব। তারটা নিজের ভাষায় লিখছি।
একছেলে দারুণ পেটুক। সারাদিন খাওয়া ছাড়া অন্য কিছু করা তো দূরের কথা ভাবতেও পারে না। পড়ার সময়ও তার খাওয়ার চিন্তা আসে। যখন বানান করে লেখা শিখছিল, তখন সে পড়ত, ‘ক তে কমলা, খ তে খই, গ তে গাঁজর, ঘ তে ঘৃত, ঙ তে ব্যাঙ, চ তে চমচম, ছ তে ছানা, জ তে জাম, ঝ তে ঝালমুড়ি, ঞ তে মিঞা” ইত্যাদি ইত্যাদি।
যখন সে একক দশক শিখছে, তখন- ‘একক দশক শতক হাজার অযুত লক্ষ্মী সরস্বতী’ (লক্ষ না বলে লক্ষ্মী বলে ফেলেছে। আর লক্ষ্মী বললেই সরস্বতীর কথা এসে যায়)।
‘লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিক অগ্রহায়ণ”। কার্তিক যেমন ঠাকুরের নাম, তেমনই মাসও। তাই কার্তিকের পর অগ্রহায়ণ!
‘কার্তিক অগ্রহায়ণ পৌষ মাগ ছেলে-পিলে’। মাঘ কে আমরা উচ্চারণ করি ‘মাগ’। ‘মাগ’ মানে মহিলা (আঞ্চলিক)। তাই মাগ এর পর ছেলে চলে এসেছে।
‘ছেলে-পিলে জ্বর সর্দি কাশি-‘
পিলে হলো গিয়ে রোগ। তাই পিলের পর সর্দি কাশি আসবেই।
‘সর্দি কাশি গয়া মাথুরা বৃন্দাবন পুরি’
কাশি যেমন রোগের নাম, তেমনই সেটা তীর্থস্থান। অতএব......
‘পুরি সন্দেশ রসগোল্লা মিষ্টি দৈ পোলাও চানাচুর ঝালমুড়ি’!
পুরি শুধু তীর্থ না, পুরি খাদ্যও। অতএব শুরু হয়ে গেল বালকের খাদ্যের ট্রেন!
প্রতিবছরের মত এবারও ডিসেম্বরে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অনেকের মাথাব্যাথা শুরু হয়েছে। এর আগে অনেক এ নিয়ে চিল্লাচিল্লি হয়েছে। এবারেও হচ্ছে। তিন না ত্রিশ? অনেকে তো আরও সরেস। তারা বলছে, ত্রিশ লাখ না হাজার! কেউ তো পারলে বলে, যুদ্ধই হয়নি!
আর একটা প্রশ্ন বরাবরের মতই উঠছে- “১৬ ডিসেম্বর ভারত সেলিব্রেট করছে কেন?” আসলে যুদ্ধটা কার সাথে হয়েছিল? এটা কি বাংলাদেশ-পাক যুদ্ধ ছিল না পাক-ভারত?
অনেকে অনেকবার এ নিয়ে বলেছেন। কিন্তু ‘গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী! এর দুইটা চোখ আর চারটা ঠ্যাং আছে!’
খালেদা জিয়ার এখনকার বক্তব্য শুনলেও উপরের গল্পগুলো মনে পড়ে। শাহরুখ খানের প্রত্যেকটা মুভিতে যেমন অন্তত একবার ‘তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম’ এর মিউজিক ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে ঠিক তেমনই খালেদা জিয়া বক্তৃতা করলেই মুক্তিযুদ্ধ টেনে আনবেন আর বিতর্ক সৃষ্টি করবেন।
প্রথমেই আসি বেগম জিয়ার একটা উক্তিতে। তিনি বলেছেন, “তিনি(শেখ মুজিব) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি”।
এটার জবাব আমি দেব না, আমি কেউই নই। দেবেন এমন একজন মানুষ যিনি বেগম জিয়ার সাথে খুব ক্লোজলি রিলেটেড। মনজুর আহমেদ। মনজুর আহমেদ হলেন সেই সাংবাদিক যিনি সর্বপ্রথম বেগম জিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ৭১ এর বন্দীশালা থেকে মুক্তির পর। এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সেটাই ছিল পত্রিকার পাতায় তার প্রথম আত্মপ্রকাশ।
“একদিন একটি মিছিলে বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু যখন ঘরে ঢুকছিলেন তখনই তাঁকে পাকড়াও করলো পশ্চিম জার্মানীর দুজন সাংবাদিক। টেপ রেকর্ডারের লম্বা চোঙাটা এগিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো- ‘আপনি কি প্রকারান্তরে সার্বভৌম অধিকার দাবী করছেন?’ সাথে সাথেই জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু, ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। জনগনের সার্বভৌম অধিকার। দেশ শাসনের সার্বভৌম অধিকার। এক কথায় সার্বভৌমত্বই তো আমি চাই।’
আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধুও বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি টেপ করে নিয়েছিলেন। পরে বাড়ীর অঙ্গনে এক গাছের ছায়ায় বসে এটি আবার আমরা ক’জন বাজিয়ে শুনছিলাম। কোথা থেকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ ছুটে এলেন বঙ্গবন্ধু। গায়ে গেঞ্জি পরনে লুঙ্গি। আসন গেড়ে বসে পড়লেন আমাদের পাশে ঘাসের ওপর। বললেন, ‘আবার বাজা। আমিও একটু শুনি।’ মনোযোগ দিয়ে তিনি পুরোটা শুনলেন। তারপর হেসে উঠে বললেন, ‘তোরা এই কথাগুলি লিখবি নাকি?’ বললাম, ‘অবশ্যই’। একটু যেন কপট আপত্তি তুলে বঙ্গবন্ধু বললেনঃ ‘এটা তো তোদের বলিনি। বলেছি জার্মান সাংবাদিকদের কাছে।’ সাথে সাথেই আমাদের জবাব- ‘এতো আপনার প্রকাশ্য উক্তি। একান্ত সাক্ষাৎকার তো নয়’।” (সেই বিভীষিকাময় রাত/ একাত্তর কথা বলে, দ্বিতীয় সংস্করণ, মে ১৯৯২;)
আপনার নিশ্চয়ই জানার কথা (যদি সামান্য লেখাপড়াও করে থাকেন), সার্বভৌমত্ব হল একটি রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান যা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা। বঙ্গবন্ধু নিঃসন্দেহে সমগ্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব চাননি। অবশ্য আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, “কীভাবে বুঝলেন তিনি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব চাননি?”। উত্তর হল- সেই দেশই সার্বভৌম যা বহিঃবিশ্বের আক্রমণ হতে মুক্ত। আর কেউ কি বলতে পারবেন যে সে সময় কোন রাষ্ট্র পাকিস্তান আক্রমণ করেছে? স্পষ্টতই তিনি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব চাননি। আর একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে অবস্থান করে আরেকটি সার্বভৌম রাষ্ট্র চাওয়া কি স্বাধীনতা দাবি করা নয়?
বেগম জিয়ার কথাটা ধোপে টেকে?
এবারে আসি শহীদদের সংখ্যা নিয়ে। এজন্য আমাদের একটু অংক করতে হবে। না না আপনাদের বাইনোমিয়াল থিয়োরির কোন জটিল অংক করতে বলছি না। সামান্য যোগ বিয়োগ জানলেই যথেষ্ট।
আমরা জানি, একাত্তরে নব্বই হাজারেরও বেশি (প্রায় তেরানব্বই হাজার) পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। এখন প্রত্যেক আর্মি যদি মাত্র ৩ জন করেও বাঙালি হত্যা করে, তাহলে সংখ্যাটা হয় ২ লাখ সত্তর হাজারের মত। যদি ৪ জন করে হত্যা করে তবে সংখ্যাটা হয় ৩ লাখ ষাট হাজার। ৫ জন করে হত্যা করলে হয় সাড়ে চার লাখ। অনেকে তিন লাখ শহীদের কথা বলছে, যদি একজন মাত্র ৪ জন করেও হত্যা করে থাকে তবুও এই ‘তিন লাখ থিয়োরি’ খাটে না।
এবারে একটু বাকশালি হিসেব করি, কেমন? হিসেব মতে একজন পাক আর্মি ২৬ জন করে বাঙালি হত্যা করেছে। এটাকে আদর্শ ধরলে মোট শহীদের সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২,৩৪০,০০০ জন (তেইশ লাখ চল্লিশ হাজার)। বিশ্বাস না করলে আপনিও ক্যালকুলেটর দিয়ে গুন করে দেখতে পারেন।
ছাব্বিশ জন করে হত্যা করেছে, এটাই বা বলছি কীকরে? এটা হল এভারেজ একটা রেট। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ২৬ মার্চ আর শেষ হয়ে ১৬ ডিসেম্বর। মানে প্রায় ২৬০ দিন (আসলে ২৬৭ দিন)।
এবারে ঐকিক নিয়ম করি।
১ জন পাক আর্মি ২৬ জন বাঙালি হত্যা করে ২৬০ দিনে।
অতএব, ১ জন পাক আর্মি ১ জন বাঙালি হত্যা করে ২৬০/২৬=১০ দিনে।
একাত্তরে পাক আর্মি যা করেছিল, সেটা একটা গণহত্যা। একটি গণহত্যায় একজন আর্মির পক্ষে ১০ দিনে ১ জন হত্যা করা কি খুব অসম্ভব? দেশের মানুষকে না চেয়ে দেশের মাটিকে চাওয়া, পাক বাহিনীরা কি ২৬৭ দিনে একেকজন মাত্র ৩/৪/৫ টা করে মানুষ মারবে?
এবারে আসি জেনোসাইড ওয়াচের একটি রিপোর্টে। এই সংস্থাটি গণহত্যা বিষয়ে গবেষণা করে।
‘’The number of death in Bangladesh in 1971 was almost certainly well into seven figures. It was one of the worst genocides of the World War 2 era, outstripping Rwanda (800000 killed) and probably surpassing Indonesia (I million to 1.5 million). As R.J RUMMEL writes.
The human death toll over only 267 days was incredible. Just to give for five out of eighteen districts some INCOMPLETE STATISTICS. In Bangladesh newspapers or by an inquiry Committee, the Pakistan army killed 100,000 in Dacca, 150,000 in Khulna, 75,000 in Jessore, 95,000 in Comilla, and 100,00 in Chittagong. For eighteen districts the total is 1,247,000 killed. This was an INCOMPLETE TOLL, and to this day no one really knows the final toll……”
অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- “একাত্তরে বাংলাদেশে নিহতের সংখ্যাটা নিযুতের ঘরে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর এটা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গণহত্যাগুলোর মধ্যে একটা। এই গনহত্যা রুয়ান্ডা আর ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
২৬৭ দিনে মোট নিহতের সংখ্যাটা বিরাট। ১৮ টি জেলার (তখন আঠারটি জেলায় বিভক্ত ছিল দেশ) মধ্যে পাঁচটি জেলার নিহতের সংখ্যার একটি অসম্পূর্ণ রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে, পেপার আর তদন্ত কমিটির মাধ্যমে। পাকিস্তানি আর্মি ঢাকায় ১ লাখ, খুলনায় দেড় লাখ, যশোরে পচাত্তুর হাজার, কুমিল্লায় পঁচানব্বই হাজার আর চট্টগ্রামে ১ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। আঠারটা জেলা মিলিয়ে মোট নিহতের সংখ্যা ১২ লাখ সাতচল্লিশ হাজার। কিন্তু এটা একটা অসম্পূর্ণ রিপোর্ট। আসলে মোট নিহতের সংখ্যাটা এখন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।”
আবারও বলছি, এটা একটা incomplete statistics।
এই ইনকমপ্লিট হিসেব কে আদর্শ ধরলেও, শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম আর খুলনার নিহতের সংখ্যা যোগ করলে সাড়ে তিন লাখ হয়!
এবারে একটি চিঠির দিকে তাকাই। একাত্তরের চিঠি। চিঠিটির লেখক শহীদ কাজী নুরুন্নবি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি।
“আম্মা,
সালাম নেবেন।
আমি ভাল আছি এবং নিরাপদেই আছি। ............ এখানে গতকাল ও পরশু পলিশ বনাম আর্মির সাংঘাতিক সংঘর্ষ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমরা জিততে পারিনি।
রাজশাহী শহর ছেড়ে লোকজন সব পালাচ্ছে। শহর একদম খালি। মিলিটারি কামান ব্যবহার করছে। ২৫০ জন পুলিশ মারা গেছে, ৪ জন আর্মি মারা গেছে। মাত্র। রাজশাহীর পরিস্থিতি এখন আর্মির আয়ত্তাধীনে আছে। .........”
একবার ভেবে দেখুন যেখানে পাক আর্মির সামনে সশস্ত্র পুলিশ নিহত হয়েছে ২ দিনে ২৫০ জন, সেখানে নিরীহ মানুষ কতজন নিহত হতে পারে?
এবারে আরেকটা প্রশ্নের জবাব দেই। যদি শুমারির কাজটা একবার হয়েই থাকে, তাহলে আবার শুমারি করে কেন জানার চেষ্টা করা হচ্ছে না?
হ্যাঁ, চমৎকার প্রশ্ন। উত্তর দেয়ার আগে একটা জোক বলি।
দুজন চাকরি (চাকুরি না চাকরি?) প্রত্যাশী ছেলে একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়েছে। একজন ইন্টার্ভিউ বোর্ডকে আগেই টাকা খাইয়ে রেখেছে। আরেকজন এসেছে মেধা দিয়ে লড়তে।
যাই হোক, যে ঘুষ দিয়েছে, তাকে জিজ্ঞেস করা হল, “বলুন তো, একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মি কতজন বাঙালি হত্যা করেছে?”
উত্তর করলো সে, “ত্রিশ লাখ”।
এবারে যে ঘুষ দেয়নি তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পালা। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, “এবার তুমি ঐ ত্রিশ লাখ শহীদের নাম বল।”
লে ঠ্যালা!
উপরে জোকটা চমৎকার সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে অধিকতর চমতকার একটা ব্যাপার আছে। সেটা হল, ‘ত্রিশ লাখ শহীদের নাম বলা অসম্ভব”!
এটা গণহত্যা, মিছিলের মধ্যে গুলি চালানো নয়। অনেকে হয়তো বলবে, গণকবরের কথা, সেখান থেকে হিসেব করলেই তো হয়! কিন্তু অগুনতি লাশ যে নদীর পানিতে ভেসে গেছে, নর্দমায় পচে গেছে, দাফন হয়নি কত মানুষের, তাদের হিসেব কি চাঁদে দেখা যাবে? আর একাত্তর পরবর্তী দুর্ভিক্ষের সাথেও এর যোগসূত্র মেলানো যায়। দুর্ভিক্ষটা তো আর শখ করে বাংলাদেশ বেড়াতে আসেনি। এরকম একটা ‘ম্যাসাকারের’ পর দুর্ভিক্ষ হওয়া স্বাভাবিক, যখন ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সে দুর্ভিক্ষের দায়ভার কে নেবে?
এই দায়ভার তাদের উপর না চাপালেও, শহীদদের সংখ্যা পাওয়াটা অসম্ভব। কারণ এতে দুর্ভিক্ষে মৃত আর যুদ্ধে নিহতের মধ্যে গুবলেট পাকিয়ে যেতে পারে।
আর কোন গণহত্যার শহীদদের সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপিত হয়েছে, বলতে পারেন? একটা উদাহরণ দেখান যেখানে শহীদদের লিস্ট আছে। আমি তো জানি না। শুধু একটা দেখান। যদি দেখাতে পারেন, আমি সিগারেট ছেড়ে দেব, আমার জিএফের এক্স বয়ফ্রেন্ডের কসম।
যারা তিন লাখ তিন লাখ করে চেঁচাচ্ছে, তাদের কথা শুনলে মনে হয়, ত্রিশ লাখ হত্যা করা অপরাধ, আর তিন লাখ হত্যা করা অপরাধই না! মানে ত্রিশ লাখের জায়গায় তিন লাখ হলে পাকিস্তানের সব দোষ মাফ! খালেদা জিয়ার বক্তৃতার ভিডিও দেখেছি। তিনি বলেছেন, ‘এতো লক্ষ’। ‘এতো লক্ষ’ শব্দ দুটি তিনি যেভাবে উচ্চারণ করেছেন, তা শুনে শুধু বিদ্রূপের কথাই মনে আসে। অথচ তিনি একাত্তরে তিনি নিজেই নির্যাতিত হয়েছিলেন!
এবারে, আরেকটা ক্যাচালমূলক প্রশ্নে আসি। ‘ভারত কেন সেলিব্রেট করছে এই বিজয়?’। ভারতীয় আর্মি কেন তাদের এফবি স্ট্যাটাসে ‘বিজয় দিবস’ লিখে পোস্ট করলো?
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে বিমান হামলা চালালে ভারত এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পরে। ইন্দিরা গান্ধী সেইদিনই মধ্যরাতে ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’
আসলে পাকিস্তান যদি ভারত আক্রমণ না করত, তবে ভারত সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারত না। পাকিস্তানের সেই ভারতে বিমান হামলা আমাদের জন্য একটা আশীর্বাদ ছিল। ভারত চাইছিল যুদ্ধ যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কারণ এককোটি শরণার্থীর বোঝা ছিল তার কাঁধে। এককোটি বিশাল একটি সংখ্যা। আর শরণার্থী সমস্যাটা যে কতো বড়, তা বর্তমান সিরিয়া পরিস্থিতি থেকেই বোঝা যায়।
ভারতীয় আর্মি মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে মিত্রবাহিনী বা যৌথবাহিনী গঠন করলে যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় একপ্রকার।
এখন বলছি, কেন ভারতীয় আর্মি, ‘বিজয় দিবস’ লিখে এফবিতে স্ট্যাটাস দিয়েছে। কারণটা হল, পাক আর্মি আত্মসমর্পণ করেছিল যৌথবাহিনীর কাছে, মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়। আত্মসমর্পণের দলিলে স্পষ্ট লেখা আছে-
“The Pakistan Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed Force in BANGLADESH to Lieutenant-General JAGJIT SING AURORA, General Officer Commanding in Chief of the Indian and Bangladesh forces in the Eastern Theatre.”
তাই এই বাহিনীটা যেমন আমাদের বিজয়, তেমনই ভারতীয় আর্মিরও বিজয়। তাই তারা এই দিনটাকে সেলিব্রেট করবে না কেন? হোয়াই দিস কোলাবেরি ডি?
শরণার্থীর কথা যখন এসেই গেছে, তখন আরেকটা হিসেব করি। এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। ১ জন শরণার্থীর খাওয়া ও চিকিৎসা (অন্যান্য মৌলিক চাহিদা বাদই দিলাম) বাবদ যদি এখনকার হিসেবে ৩০ টাকাও খরচ হয়, তাহলে ২০০ দিনে খরচ হয় ৬০০,০০০০০০০০ (ছয় হাজার কোটি) টাকা। ছয় হাজার কোটি টাকা শরণার্থী খাতে ব্যায় করলে, একটা দেশের অর্থনীতিতে কতোটা চাপ পড়বে ভেবে দেখুন। আজকাল সিরিয়ান শরণার্থী নিয়ে অনেকে অনেক জ্ঞানগর্ভ পোস্ট দিচ্ছেন, অথচ তারাই ভারত বিরোধিতা করছে সবচেয়ে বেশি। শুধু মাত্র, এককোটি মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য হলেও তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এই এককোটি দেশে থাকলে, আরও অন্তত দশ লাখকে পাক আর্মি হত্যা করত। অথচ, আজ আমাদের দেশপ্রেম ভারত বিরোধিতাতেই সীমাবদ্ধ!
এবারে জিয়াউর রহমানের লেখার একটা ছোট্ট অংশ শেয়ার করি। অন্য অনেকের লেখার অংশ তুলে ধরতে পারতাম। কিন্তু জিয়ার লেখা যেহেতু হাতের কাছে আছে, তারটা তুলে ধরাই শ্রেয় মনে করছি-
“স্কুল জীবন থেকেই পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা আমার মনকে পীড়া দিত। আমি জানতাম, অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা করে। স্কুল জীবনেই বহু দিনই শুনেছি আমার স্কুল-বন্ধুদের আলোচনা। তাদের অভিভাবকরা বাড়ীতে যা বলতো তাই তারা রোমন্থন করতো স্কুল প্রাঙ্গণে। আমি শুনতাম, মাঝে মাঝেই শুনতাম তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হতো বাংলাদেশ আর বাংলাদেশকে শোষণ করার বিষয়। পাকিস্তানী তরুণ সমাজকে শেখানো হতো বাঙালীদের ঘৃণা করতে। বাঙালীদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেওয়া হতো স্কুল ছাত্রদের শিশু মনেই। শিক্ষা দেওয়া হতো তাদের বাঙালীকে নিকৃষ্টতর মানব জাতি রূপে বিবেচনা করতে।”
(একটি জাতির জন্ম/ জিয়াউর রাহমান)
শেষ করার আগে, জেনারেল নিয়াজীর একটি সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরছি।
“প্রশ্নঃ- ৩রা ডিসেম্বর আপনি যখন বুঝতে পারলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত আর কোন সৈন্য আসবে না তখন নিজস্ব সম্পদ থেকে আপনি কেন ঢাকার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করলেন না?
নিয়াজীঃ- সবগুলো সেক্টরে একই সঙ্গে যুদ্ধের চাপ এসে পড়েছিল। তাই কোন সেক্টর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভব ছিল না।
প্রশ্নঃ- ঢাকায় আপনার কাছে যেটুকু শক্তি ছিল, তা দিয়েও কি আপনি যুদ্ধকে আরও দিন কয়েকের জন্য দীর্ঘায়িত করতে পারতেন না?
নিয়াজীঃ- কেন তা করতে যাব? সেক্ষেত্রে ঢাকার নর্দমাগুলো মৃতদেহ ভরে উঠত আর রাস্তায় লাশের পাহাড় হতো। ঢাকার নাগরিক জীবনের মারাত্মক অবনতি হতো আর মহামারী আকারে রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ত। অথচ যুদ্ধের ফলাফল একই হতো। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে এই ৯০,০০০ যুদ্ধবন্দী ফিরে নিয়ে যাওয়া শ্রেয় মনে করেছি। না হলে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে আমাদের ৯০,০০০ বিধবা মহিলা আর লাখ পাঁচেক এতিম বাচ্চাকে মোকাবেলা করতে হবে। আমার কাছে যুদ্ধে এভাবে আত্মহুতি মূল্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ফলাফল তো একই হতো।
প্রশ্নঃ- শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাস তো উজ্জ্বল হতো। যুদ্ধের ইতিহাসে এই বীরত্বগাথা উতসাহব্যঞ্জক নতুন অধ্যায় হিসাবে সংযোজিত হতো।
লে। জেনারেল নিয়াজী এ প্রশ্নের আর কোন জবাব দেননি।
(আমি বিজয় দেখেছি/ এম আর আখতার মুকুল)
উপরে নিয়াজীর সাক্ষাৎকারটা কেন দিলাম জানি না। পোস্টের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পড়ার সময় কেমন গর্ব হচ্ছিল। সেই গর্বের ভাগ দিতেই এটা তুলে দিলাম।
এতো কথার পরও, আবার শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হবে। কারণ, “গরু একটি গৃহপালিত পশু। গরুর চারটা ঠ্যাং আর একটা লেজ আছে”!
২২ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫
আরিফ রহমানের ‘তিরিশ লক্ষ শহীদ, বাহুল্য নাকি বাস্তবতাঃ রিসার্চ-পেপার, ডিকশনারি, এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে শহীদের সংখ্যা নিরূপণের প্রয়াস’ পড়ুন- blog.mukto-mona.com/2014/12/16/43911
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০০
৫৪টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×