সুজানার সাথে শারদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো বিয়ে হওয়ার দেড় বছরের মাথায়। সময়ের হিসাবে খুব বেশি দিন ওরা কাছাকাছি থাকেনি। তাই ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর দু’জনার প্রতি দু’জনার বিপরীত আবহাওয়াটা খুব বেশি গুমট নয়। যোগাযোগের সুনিদিষ্ট সরল রেখাটা ওদের মধ্যে অবশ্য থাকেনি। এ সমাজে অনর্থক কিছু মানুষের হিসাবের অংক মিলবেনা বলে। আবার শুধুই বিরোধীতার নামে কাঁদা ছোড়া ছুড়িতেও ওরা মাতেনি।
ওদের বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিক সুত্র ধরেই। সে সময় সুজানা কেবল অনার্ষ তৃতীয় বর্ষে। বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ত ছিলনা। কিন্তু মেয়েদের অনির্ধারিত প্রস্তুতির চির চেনা চিত্রে প্রস্তুতি ছিল নিজের মাঝে। ওর বাবা মা এবয়সে ওকে বিয়ে না দেওয়ার অপরাধে নিজেদের তখন শাপান্তর অপরাধী ভাবতে শুরু করেনি। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে নির্ধারিত সত্য বৃত্ত মেনে তারা চুপচাপ। ঠিক এরকম একটি সময় বিয়ের প্রস্তাবটা এলো। আদর্শের কথকথায় অর্থের চেয়ে বংশের মানকে সুজানার বাবা মা মেনে চলে আজীবন। এর সাথে শারদের ভাল চাকুরি যোগ হয়ে বিয়েটা পুরোপুরি এক দড়িতে আটকে গেলো। আর সুজানা এর চেয়ে বেশি পাওয়ার অনিশ্চয়তায় দিকে না গিয়ে মত দিয়ে দিলো।
এদিকে শারদ তখন পাত্রি না পাওয়ার হতাশায় মনোরোগি। আজ এখানে এক পশলা বৃষ্টির মত মেয়ে, কাল ওখানে রৌদ্রের রঙের মেয়ে দেখে দেখে দ্রুত গামি ট্রেনের মত ক্লান্ত। নিজের মন ভাবনার লেনস্কেপ চিত্রের সাথে দেখার চিত্র মিলিয়ে বন্ধুদের বলে এ জীবনে আর বাজবেনা ছাঁদনা তলার গান। বন্ধুরা হাস্যরস করে বলে, হতাশ হইয়োনা বন্ধু। যে আসবার সে চুপিসারেই আসবে। সেই চুপিসারে আসাটাই সুজানা। অফিস শেষ করে সেদিন বাসায় ফিরেই যার সংবাদটা পেলো বাবার কাছে-
- তোমার মাকে নিয়ে আমি একটি মেয়ে দেখেছি আজ হঠ্যাৎ করেই। আমাদের পছন্দ হয়েছে। তুমি দেখো আমাদের বলো। এরপর আমরা পাকা কথা পাড়ব। সামনের সাপ্তাহিক ছুটিতে আমরা তোমাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যাবো।
এখানে ভাবনায় এসে যেতে পারে শারদার বাবা মা সেই পুরনো আমলের নিত্তি মাপা ধ্যান ধারনার মানুষ। তারা যা বলবে শারদকে তাই মানতে হবে। বাস্তবিক তারা যথেষ্ট পরিমানেই আধুনিক হলেও শারদের ক্লান্তি ওদের কেউ ছুয়ে গিয়েছিলো।
প্রতিটি মেয়ে দেখার আগে শারদের কল্পনার অবয়বে তৈরী পরবাস্তব গল্পটা শেষ হয় বাস্তবিক মেয়ে দেখার মাঝে। এবার মেয়েটির নামের সাথে ওর নামের অদাক্ষর এবং শাব্দিক মিলের জন্য বিষয়টি ব্যতিক্রম হবে এ বিশ্বাস শারত করতে পারেনি পুরনো ব্যথিতে। তারপরও বিষয়টি ব্যতিক্রমী হয়ে ওর পছন্দ হওয়ার মাঝ দিয়ে বিয়েতে গড়ালো।
আধুনিক প্রযুক্তির সর্বচ্চ সোপান ছেলেবেলার ধুলো বালির মত ওদের এপাশ ওপাশ গড়ালেও বিয়ের আগের কটা দিন আর ওদের মাঝে কোন যোগাযোগ হলোনা মধ্যস্থতাকারি অভাবে। ওরা দুজনেই যেমন পারেনি মা বাবার কাছ সামান্য নিলর্জ হতে। তেমনি আবার একে অপরের যোগাযোগের সেতুবন্ধন হতে পারেনি নতুনত্বেও আড়ালে। তাই এ যুগের মধ্যমণি হয়েও ওদের বিয়ে হলো পুরনো দিনের গল্পের মত। বাসর রাতে এ নিয়ে ওদের কথা হয়েছিল বেশি। এরপর নিমন্ত্রণ নামক অত্যাচারের মহাজঞ্জ আজ এবারি, কাল ওবারি করে ফিরল এক মাস। সব শেষ করে নিজেদের প্রকৃত জীবনে এসে ওরা অনুভব করল একে অন্যের পরিপূরক অনেক বিষয়। যা শুরু হলো ঘুম থেকে উঠা এবং ঘুমাতে যাওয়া নিয়ে। শারদের অনেক দিনের অফিস হিসাবি জীবন সকালে ঘুমাও, সকালে উঠো। আর সুজানা ছাত্রী জীবনের বেহিসেবী পনায় তখনও বহমান। তাই দেরিতে ঘুমাও দেরিতে উঠো। শারদ প্রথম যে ভুলটা করল সুজানাকে বদলে নিতে চাইল নিজের মত কর। সুজনাও ঠিক একি ভুল করল সারদকে বদলে নিতে। এই অদল বদলের খেলায় ভালোবাসা প্রকৃত জমাট না বেধে আরো বেশি অদৃশ্য হয়ে গেলো দুজনার মাঝে। যা লোকাল ট্রেনের মতো ধীকে ধীকে চললো বছর দেড়েক। এক সময় এসে তা পুরোপুরি থেমে গেলে।
ওদের বাবা মা এসবের মধ্যে আগুনের স্ফুলিংগও হয়নি, প্রতিবাদী হয়নি। এরা চেয়েছিল ওরা নিজেদের মত করে গড়ে নিক নিজেদের। সর্বশেষে এরাও হাল ছেড়ে দিয়ে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সম্মতি জানালো।
সুজানা শারদের ইতিটা হয়ত এখানেই ইতি হতে পারত। জীবন চরিত্রের নাটকীয়তা তা হতে দিলো না। একটি ফোনের মাঝে আবার ফিরিয়ে আনল শারদের জীবনে। । অফিসের কর্মব্যস্ত সময়ের মাঝে একদিন হঠ্যাৎ একটা ছেলে ওকে ফোন করে সুজানার বিষয়ে কথা বলতে চাইলো। শারদের মনে তখন কি ইর্ষা আঘাত হেনেছিলো শারদ বুঝতে পারেনি, তাই ফোনটা কেটে দিয়েছিলো অভভ্রের মত। পরবর্তীদিন আবার ছেলেটা ফোন করে ওকে অনুরোধ করল একি বিষয়ে। প্রতি উত্তরে ও বলল
- যা জানতে চান ফোনেই বলুন। আমার দেখা করার সময় নেই।
- সব কথা কি ফোনে বলা যায়। একটু দেখা করলে আপনি ক্ষতি হবে না কিন্তু আমার উপকার হবে।
ছেলেটার শান্ত বিনয় ব্যবহার জন্য ও আর না শব্দ উচ্চারণ করতে পারলোনা। দেখা হওয়ার প্রথম কথায় ছেলেটি ওকে অভিবাদন জানিয়ে বলল
- আমি অনিত। আপনার ব্যস্ত সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
- বলুন কি জানতে চান?
- সুজানার সাথে তো আপনার দেড় বছরের মত বিয়েটা টিকে ছিল। ওকে ডির্ভোস দিয়েছিলেন কেন।
- আমি ওকে ডিভোর্স দেয়নি কিংবা ও আমাকে ডিভোর্স দেয়নি। আমরা দুজনে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
- এই সিদ্ধান্তটা কেন নিয়েছিলেন? আমি আসলে সেটিই জানতে চাচ্ছি।
- কথা গুলো পুরোটাই আমার কিংবা আমাদের ব্যক্তিগত যা জানতে চাওয়া অনধিকার চর্চা।
- রাগ করবেন না। আসলে হয়েছি কী জানেন আমার বাবা মা চাচ্ছে আমি সুজানাকে বিয়ে করি। আমারো অমত নেই। প্রেম ভালোবাসার বিয়ে হলে হয়ত আপনার সাহায্য প্রার্থি হতাম না। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হয়নি বলেই ওর সম্বন্ধে একটু ভাল করে জানতে চেয়েছিলাম আপনার কাছ থেকে।
- এটাতো আপনি ওর সাথে ফোন কথা বলেই বুঝতে পারতেন। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন।
- আসলে বিষয়টি পরিস্কার করে হয়ত আপনাকে বুঝাতে পারছিনা। দুটি মানুষের মাঝে ডির্ভোস একেবারে শেষ বিন্দুতে এসে হয়। সেই শেষ বিন্দুটিকে জানা আমার হয়ত অনধিকার চর্চা। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন এই শেষ বিন্দুর জন্য আবার দুটি জীবন বিপন্ন হতে পারে। আমার কথা বাদ দিন, সুজনার জন্য সেটা কত বড় বিপর্যয় হবে ভেবে দেখেছেন। তাই আমি চাইছিলাম সেই বিষয়গুলো জেনে আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে যাতে সুজানাকে আমাদের মাঝে সুখ না থাকুন দুখের উপস্থিতি কম হয়।
শারদ সেদিন বলার মতো কোন দোষ খুজে বের করতে পারেনি ভেবে অবাক হয়েছিল। বাসায় ফেরার পর সারারাত কোন অদৃশ দুঃখ ওর ঘুম কে তাড়িয়ে বেড়াল। মনে পড়ে যেতে লাগলো, ওদের প্রথম চুমু, প্রথম শরীরীকতা আরো অনেক প্রথমার প্রথম কিছু। নিজের যুক্তি দিয়ে বের করতে চাইল ভালবাসা আর জৈবিকতার ব্যবধান। প্রচন্ড মান অভিমানের মাঝেও তো ওরা শাররিক সম্পর্কে মিলিতো হয়েছে। সেখানে কি কোন ভালোবাসার বন্ধন নেই। নাকি সবই জৈবিকতা, পাশাপাশি থাকার অভ্যেস। ভালবাসাও তো এক প্রকারের অভ্যেস। যা নিত্যদিনের অন্য কিছুর চেয়ে একটু ব্যতিক্রম হয়ে আসে বলে এত ভাললাগে। যতই ভাবতে লাগল ততই অপরাধী হতে লাগল। যে বিষয়গুলোর জন্য ওদের ব্যবচেছদ, খুব কি কঠিন বিষয় ছিল এগুলো? এগুলো কি মেনে নেয়া যেতে না? প্রচন্ড অভিমানী রাগ হতে লাগল সুজানার প্রতি। ও না হয় পারেনি। সুজাতো পারতে পারতো।
সকালে অফিসে আসার সময় মার দৃষ্টিতে ওর নিঘূর্মতা এড়ালনা।
- তোর কি শরীর খারাপ।
- না মা রাতে ভালো ঘুম হয়নি।
অফিসে এসে কাজে মনোযোগ দিতে চাইল নিজেকে ফিরে পেতে। জীবন বৈচিত্রতা এখানেও ওকে সুজানাতে ফেরাতে লাগল বার বার । বুঝতে পারলো ও কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। কোন অনিশ্চিত কথা ওকে তাড়িয়ে নিচ্ছে নতুন স্বপ্নে। যেখানে ভালোলাগা পরিধির সাথে দুঃস্বপ্নের পরিধি জড়িত। এই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের পরিধি ওকে টেনে নিয়ে গেল নিজের মোবাইলে থাকা সুজানার নাম্বার পর্যন্ত। দেখল সেখান প্রথম লিখা “জান” শব্দটি এখনো জল জলে। বুঝতে পারলো হাজার ঝড়ের মাঝে সুজানা প্রতি ওর ভালোবাসা একবিন্দু বৃষ্টি ফোটা হয়ে আজো বেচেঁ আছে। চেষ্টা করল সুজানাকে মোবাইলে পেতে। ব্যর্থ হয়ে টিএনটির আশ্রয় নিলো পেলে ওর মাকে। সম্বোন্ধন সংকোচনে প্রথমে কিছু বলতে পারলোনা। ফোনটা রেখেও দিয়ে আবার ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে সুজানাকে চাইল কাপা কাপা কন্ঠে।
এরপরের কিছুদিন শারদের উদ্ভান্ত মাতাল প্রেমিক মত। ফোনে সুজানার সাথে ও দেখা করার অনুমতি চেয়েছিল। সুজানাও দিয়েছিলো দ্বিধাহীন চিত্তে। যেটুকু সংশয় ওকে আগলে রেখেছিলো ফিরিবার তরে সেটুকু হারিয়ে গিয়েছিলো সুজানাকে দেখে। নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি, স্পটষ্ট সুজানাকে বলেছিল আমি পুনরায় তোমাকে চাই।
সুজানা কিছুতেই রাজি হয়নি। কারণ ততদিনে ও অনিতকে জড়িয়ে অনেক স্বপ্ন দেয়াল গড়েছে নিজের ভিতর। যা শারদের আকুলতার ধ্বনি একটুও ভেদ করতে পারিনি। বরং শারদের নিলর্জ কাপুরুষের মত ওদের বাসার সামনে সারারাত দাড়িয়ে থাকা। ও যেখানে যায় অন্ধের মত অনুসরণ করা। সময় অসময়ে মোবাইলে ফিরে আসা আসার আকুতি কান্না। ওকে বির্বত পরিস্থির এবং বিরক্তির সামনে দাড় করিয়েছে। বাধ্য হয়ে শারদের মা-বাবাকে বলেছে ওকে ফেরাতে।
কেউ ফেরাতে পারেনি শারদকে, সমাধান ও করতে পারেনি। অবশেষে সমাধানের মাধাম্য হয়ে এগিয়ে এসেছে একটি কাঙ্খিত রোড একসিডেন্ট। এখানে কাঙ্খিত শব্দ এ কারনে ব্যবহার হরা হলো। সে সময় শারদের উদ্ভান্ত মন দেবদাসপনার কৃতদাস হয়ে গিয়েছিল একেবারেই। নিজেকে দেখার, চারপাশ দেখার কোন সবল চিন্তাশক্তি শারদের মস্তিক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপর প্রায় মাসাধিক সময় ধরে শারদ হাসপাতালে। ওর একটি পা কেটে ফেলে দেওয়াটা ডাক্তারা বলেছে সামান্য বিষয়। যেখানে জীবন ফিরে পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এর মধ্যে সুজানার বিয়ে হয়ে গেছে অনিত সাথে। আজ বিকেলে ওরা এসেছিল ওকে দেখতে। যাওয়ার সময় সুজানা শুধু এটুকুই বলেছেন, তুমি কেন রবীন্দ্রনাথের সেই কথা মনে রাখতে পারোনি।
অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকার রক্ষা করার মত বিড়ম্বনা আর নাই।