অনেক বছর পর বন্ধু আনিসের সাথে আবার হঠ্যাৎ দেখা। বন্ধু বলতে শহরতলীর বন্ধু। স্থায়ী ভাবে ঢাকায় চলে আসার পর প্রথম যে চাকুরীটি আমার ভাগ্য জুটেছিল। আনিস তার কলিগ। পৃথিবীর মানুষ বৈচিত্র্যটার বিষয়টি আনিস কে দেখে আমার প্রথম বোঝা। আমার সবচেয়ে কান্নাময় অকাল সময়ের সহমর্মিতার দেয়াল হয়েছিলেন এ মানুষটি । জানিনা পৃথিবীর সকল মানুষের নিজের গ্রাম, বন্ধুত্ব, দূর্বার আড্ডা বে-হিসেবী জীবন ছেড়ে এসে কতটা কষ্ট হয়। আমার হয়েছিল অনেক। প্রতিদিন কান্নায়, হতাশায় ডুবে থাকা মানুষটিকে আনিস ধরে ফেলেছিল এবং সেটা ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। তার কৃপায় আমি টিকে গিয়েছিলাম শহরে।
আনিসের প্রথম যে বিষয়টি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল ওর পরোপকারী মন। বিশেষ করে অসুস্থ মানুষের জন্য। যার প্রথম পরিচিতিটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম অফিসের বস হঠ্যাৎ অসুস্থ হয়ে যাবার পর। উনি যে দিন অসুস্থ হলেন আনিস খুব স্বাভাবিক থেকে হাসতে হাসতেই সব কিছু সামলে নিলো। যেন অনেক দিনের চেনা এ পথ। হাসপাতাল যাওয়া, ডাক্তার ঔষধ সব কিছু। কিন্তু বস কিছুটা সুস্থ হয়ে যাবার পর আনিস কে আমি আর বসের সেবায় দেখালাম না। অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে। প্রথমে আমি ভেবে নিয়েছিলাম অফিসের বস বলেই এত পরোপকারিতা। পরে লক্ষ করতে থাকলাম শুধু অফিসের বস নয়, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, পারা প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, এমনি চারপাশের কোন একটি মানুষ অসুস্থ হয়ে গেছে আনিস সবার আগে। কোন কারণে যদি কোন অসুস্থতার সংবাদ পরে পেয়ে না যেতে পারে সেটা নিয়ে খুব আপসোস করতে থাকে।
একদিন অফিসের কাজ করতে গিয়ে আমার অনেক খানি হাত কেটে গেলো। যথারীতি আনিস সবার আগে এসে আমার কাটা জায়গায় জোরে চেপে ধরল এবং হাসতে লাগলো। আমার কাটাতে ওর চাপ লেগে আমি আরও বেশি ব্যথা পাচ্ছিলাম আর ওকে বার বার বলছিলাম আমি খুব ব্যথা পাচ্ছি এখন ছাড়ুন। ও তত বেশি আমার কাটা জায়গায় আরও চেপে ধরে আরও বেশি হাসছিল যেন খুব মজা পাচ্ছে। ওর সেদিনের সেই হাসিটাই ওর সম্বন্ধে আমার দৃষ্টি ভঙ্গি কিছুটা বদলে দিল। আমি লক্ষ করতে থাকলাম ওর এই হাসিটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয় সবার ক্ষেত্রেই হয়। কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করে ভয়ংকর ভাবে আবিষ্কার করলাম ও বিভিন্ন হাসপাতালের ইমাজিন্সি ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে অসুস্থ মানুষে দেখে হাসতে থাকে। কোন হাসপাতালে কারো দৃষ্টিতে পরে গেলে ও আরেক হাসপাতাল খুঁজে নেয়। বুঝতে পারলাম ওর এই অসুস্থ পরোপকারী মানুষিকটার পিছনে একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে। ও মানুষের কষ্ট দেখে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে। যে কারণে বার বার অসুস্থ মানুষ খুঁজে বেড়ায়। পরোপকারের স্বার্থে নয়।
সদ্য শহরে হওয়া একজন গ্রামের মানুষের মধ্যে তথন এত জ্ঞান বুদ্ধি নেই এর ব্যাখ্যার। বার বার মনে হতে লাগলো আমারই ভুল। আমি আসলে ঈর্ষান্বিত। তবে মানুষের সহজাত ভাবনা বার বার বলছিল ও মানসিক ভাবে অসুস্থ। ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু সঠিক রাস্তার খোজার মত শহরে তখনও আমি হয়ে উঠতে পারিনি।
অনেক ভাবনা চিন্তা করে একদিন সাহস নিয়ে সরাসরি আনিস কে বললাম তার বিষয়ে আমার ভাবনার কথা। প্রথমে বিষয়টি মজা করে উড়িয়ে দিতে চাইলো । পরে যখন বুঝতে পারলো আমি ধরে ফেলেছি ওর আসল রহস্য। তখন বার বার মাথা নেড়ে না করতে লাগলো এবং যথেষ্ট চুপসে গেলো। আমি কয়েকদিন যথেষ্ট রকম চেষ্টা করতে লাগলাম ওকে বুঝানোর জন্য। এর পর আনিস আমার থেকে পালিয়ে বেড়াতে লাগলো। একবার ভাবলাম ওর পরিবার কে বলি অথবা অফিস বস কে বলি ও মানসিক ভাবে অসুস্থ। ওর চিকিৎসার প্রয়োজন।
আমাদের সমাজে কাউকে মানসিক ভাবে অসুস্থ বলার বিষয়টি বড়ই জটিল। আমরা ধরেই নিই মানুষটি ভারসাম্যহীন পাগল। আনিস তো পুরোপুরি স্বাভাবিক একজন মানুষ। কিছুতেই কাউকেই বুঝানো গেল না ওর সমস্যার কথা। হলো না কিছুই মাঝ খান থেকে ওর সাথে আমার স্বাভাবিক সমর্পক টা নষ্ট হয়ে গেলো। আমি খুব কষ্ট পেতে লাগলাম। এর কিছুদিন পর আমার একটা নতুন চাকুরী হওয়াতে আমি সেই চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকুরীতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আনিস ও হারিয়ে যায় আমার মাঝ থেকে।
আমি খুব পরোপকারী এবং অন্যের উপকার উপযোগী মানুষ নই। নিজেকে ভাল মানুষ প্রমানের দায়বদ্ধতাও আমি কখনও অনুভব করিনা। তবুও আমি খুব করে চেয়েছিলাম আনিস কে সুস্থ করে তুললে। কারণ ও আমার কান্নার সাক্ষী হয়ে ছিল । অনেক কষ্টের মধ্যে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় তা শিখিয়েছিল।
আজ হঠ্যাৎ আবার দেখা। দাড়ি টুপিতে যথেষ্ট বদলে গেলে। কিন্তু সেই হাসিটা এখন আছে। বার বার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল এখন সেই ভাবে হাসপাতালে ছোটাছুটি করে কিনা। পরে ভাবলাম থাকনা একটা মানুষের মানসিক সমস্যা দিয়েও তো কিছু মানুষের সেবা হয়, কিছু মানুষ সুস্থ হয়, কিছু মানুষ হয়ত বেঁচেও যায়। তথাকথিত সুস্থ তকমা গায়ে লাগিয়েও আমি তো একজন মানুষকে সুস্থ কিংবা বাঁচাতে পারিনি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২১ দুপুর ১:৫৮