কালো শার্ট,ফেড জিন্স আর স্যান্ডেল পায়ে হাটছে রাহী।
হাতের বেনসন টা ফুরোয় নি এখনো।
কেবল মাত্র সকাল ১১ টা, রোদ কড়া না হলেও চোখে সানগ্লাস।
একটু আগে নতুন বিজয় একাত্তর হলে ওঠার আবেদন জমা দেয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছিল সে।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে কি মনে করে যেন বেরিয়ে এসেছে লাইন থেকে, ছিঁড়ে ফেলেছে ফর্ম।
হয়তবা নিজের হলকে অনেক ভালোবাসে আবেগি ছেলেটা, কিংবা পুরনো কে আঁকড়ে ধরে থাকার পুরনো স্বভাবের কাছে হেরে গেছে
শেষ মুহূর্তে ।
জিয়া হলের সামনে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন বসে থেকে পরপর দু কাপ চা খেয়ে সিগারেট হাতে নিজ হলে ফিরছে এখন।
ভার্সিটি বন্ধ আজ। তাই মলচত্তরটা বেশ খালি খালি লাগছে।
অবশ্য ফাঁকা রাস্তায় হাটাটা খুব পছন্দ তার।
তাই হয়ত মধ্যরাতের ফুলার রোডটা তার কাছে স্বপ্নের মত লাগে।
বিশাল রাস্তা, এস এম হলের রাজকীয় দেয়াল, জগন্নাথ হলের পেছনের বিশাল মনুমেন্ট,
সোডিয়াম বাতির মায়াবী সোনালি আলো, উচু উচু বুড়ো বুড়ো গাছ যেন দাঁড়িয়ে আছে প্রহরির মত!
সব মিলিয়ে সপ্নই তো!
ফাঁকা মলচত্তরের মাঝের রাস্তাটায় হাটছে সে,
রাস্তার শেষ প্রান্তে দুজন ছেলে মেয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে,
রাস্তায় যতোটুকু দূরত্ব বজায় না রাখলেই নয় ততটুকু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে।
বোঝাই যাচ্ছে প্রেম বেশ গভীর।
মেয়েটার গায়ে হালকা সবুজ একটা জামা।
''কি ক্ষ্যাত! সবুজ জামা কেউ পড়ে'' ?? মনে মনে ভাবে সে।
কিন্তু দূরে থাকায় কারো চেহারাই বুঝতে পারছে না সে।
চোখ ফিরিয়ে নিলো রাহী, নিচের দিকে তাকিয়ে হাটতে হাটতে কানে হেডফোন গুজে সিগারেট টানায় মন দিলো।
সে পারতপক্ষে এসব দেখেনা, এড়িয়ে চলে।
''গান্স এন্ড রোজেস'' এর "ডোন্ট ক্রাই'' গানটার সাথে গুন গুন করতে করতে সেই কপোত-কপোতিকে পাশ কাটায় ।
কিন্তু হঠাত কি মনে করে পেছন ফিরতেই বুকটা কেপে ওঠে তার!
মুহূর্তে হাটা থেমে যায়। পা গুলো যেন গেথে যাচ্ছে মাটিতে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে!
এতো সেই মেয়ে যে কিছুদিন আগেও তার সাথে রিকশায় ঘুরেছে!!!
রাতের পর রাত ফেসবুকে চ্যাট করেছে!!
স্বপ্ন দেখেছে,স্বপ্ন দেখিয়েছে।
যে মেয়েটার সব কষ্ট মুছে দিয়েছিল সে পরম আদরে।
মাত্র কয়েকটা দিন আগেও ঐ হাতে তার হাত ছিল!!
ওই কাধে তার মাথা রাখার অধিকার ছিল!!
মেয়েটির নাম ধরে ডাকতে চায় রাহী, কিন্তু গলা থেকে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না!
রাহীর এই অদুরে অবস্থান যেন আমলেই নিলনা ওরা।
যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই ওখানে।
নিজেদের মাঝেই বিলিয়েছে সব মনযোগ, হাতে হাত, চোখে চোখ।
লজ্জা,ক্ষোভ,কষ্ট,অভিমান সব যেন একসাথে পেয়ে বসলো রাহীকে....
একটা প্রচন্ড চিৎকার দিতে গিয়েও আটকে গেল।
না,কারো মনযোগ নষ্ট করার ইচ্ছে নেই তার।
ছলছল চোখের সানগ্লাসটা ঠিক করে হাটা শুরু করলো।
সার্জেন্ট জহুরূল হক হলের ১১১ নাম্বার রুমটা রাহীর ঠিকানা।
বলাবাহুল্য সেটা গনরুম।
যেটাতে তার মত আরো ১৫ জনের আবাস!
মলচত্তর পেরিয়ে ডান দিকে গেলেই রাহীর হল।
কিন্তু হলের দিকে না গিয়ে সে সোজা ফুলার রোডে ঢুকে পড়লো।
ঘটনার আকস্মিকতায় এখনো ঘোরের মধ্যে সে,
বার বার সেই চেনা আর অচেনা মুখটা,হাত ধরার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে,আর বুকে একটা হাহাকার বয়ে যাচ্ছে!
ব্রিটিশ কাউন্সিল এর সামনের দোকান থেকে সিগারেট ধরালো আবার।
সে হাটছে।
খুব বেশিদিনের সম্পর্ক ছিলনা তার নিশার সাথে,
ফেসবুকে পরিচয়,
আর সৌভাগ্যবশত একই ভার্সিটির আলাদা ডিপার্টমেন্ট এ ভর্তি হয়ে সেটা পরিনয়ে রূপ নেয়।
এই তো সামনের মাসের ১৯ তারিখ আসলেই সম্পর্কের আট মাস পূর্ণ হত।
কিন্তু ভালবাসার গভীরতা তো আর সময়ের ব্যাপ্তির উপর নির্ভরশীল না,
ভালবাসা বাড়ে জ্যামিতিক হারে, সময়ের সমানুপাতিক হারে নয় অবশ্যই।
অবশ্য নিশার ভালবাসার সংজ্ঞাটা মনে হয় একটু আলাদা ছিল রাহীর চেয়ে।
কিন্তু পাগলটা কখনো এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি,শুধু পাগলের মত ভালোবেসেই গিয়েছে।
এইতো দিন বিশেক আগে যখন নিশা বলেছিল,
'তার বাসায় রাহীর ব্যাপারে সব জেনে গেছে,
তাই রক্ষনশীল মা দিব্যি দিয়েছে এ সম্পর্ক না রাখতে'!!
রাহী সে কথা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।
ভেবেছিল নিশা হয়তবা ফাজলামি করছে নয়তো তার ভালবাসার পরীক্ষা নিচ্ছে।
রাহী জানতো যে নিশার মত ভালো মেয়ে অন্তত তার হাত কখনোই ছাড়বে না,
সেটা সে নিজে ছেড়ে দিতে চাইলেও না!
কিন্তু দুদিন পরে আসলেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিল নিশা,
রাহীর নাম্বার চলে গেল তার ফোনের ব্লাকলিস্টে,
যে ফেসবুকে পরিচয়,সেই ফেসবুকেরই ব্লকলিস্টে জায়গা পেল রাহীর আইডিটা!
রাহী প্রচন্ড রাগ হলেও উদ্বিগ্ন হলনা মোটেও,
কারণ এরকম ব্রেকআপ আগেও তিনবার হয়েছে তাদের!
প্রতিবারই নিশা করেছে, আবার থাকতে না পেরে দুদিন পরেই সরি বলে হাউমাউ করে
কেঁদে জড়িয়ে ধরেছে!
মনে মনে ভাবে এবারের ব্রেকআপ নাটকটায় একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে নিশা,
কত্ত বড় সাহস তাকে ব্লক পর্যন্ত করে দিয়েছে?
এবার ফিরে আসলে হারামীটাকে আচ্ছা মত কাদাব!
সেও যোগাযোগ বন্ধ রাখে ইচ্ছে করেই,
নিশার ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়েও হাটেনি আর।
২০ দিন পেরিয়ে যায় কোন যোগাযোগ ছাড়াই।
রাহী ফুলার রোড পেরিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হাটছে,
আজ তার কোন গন্ত্যব্য নেই,
উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটছে আর ভাবছে।
''আচ্ছা,নিশা আজ সবুজ জামা কেন পড়লো?''
''ও কি জানেনা সবুজ জামায় ওকে একদম মানায় না??''
''নাকি ওই হারামজাদার প্রিয় রং সবুজ??''
''তার কি নিশাকে চড় মারা উচিত ছিল?কিংবা হারামজাদাটার নাক বরাবর ঘুশি তো দেয়াই যেত?''
রাগে গজগজ করতে করতে সিগারেটে ঘনঘন লম্বা টান বসায়।
হাটার গতিও বেড়ে যায় তার।
পরমুহুরতে শান্ত হয়ে যায় সে...
ভাবে
''এসব করে কিইবা উসুল হত?''
''যা কিছু সে হারালো,ভালবাসা,আস্থা, বিশ্বাস তাকি সে ফিরে পাবে?"
''কিংবা সেই ছেলেটারই বা কি দোষ?''
একটা মেয়ে স্বেচ্ছায় স্থান না করে দিলে, পৃথিবীর কোন ছেলের সাধ্য নেই তার কাছে আসার।
আজ শহীদ মিনার যুগলে ভরা।
ওরা কি রাহীর মনের দুঃখ আরো বাড়ানোর জন্য এসেছে আজ?
শত শত স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে ওরা।
নীল পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা মাত্র মেয়েটার খোপায় গোলাপ গুজে দিল,
রাহীর দৃষ্টি এড়ায় না সেটা।
ওর মনে পড়ে যায় নিশা বলেছিল, -
''তুমি যেদিন আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করবা সেদিন কিন্তু ৫০০ টা লাল গোলাপ দিতে হবে!"
- "কি বলেন বউ??? !! ৫০০ টা!! অত টাকা আমি কই পাবো? ৫ টা দিমু হাইয়েস্ট"
"ওরে খোদা, আমার কপালে এমন কিপ্পন জামাই লিখা ছিল? আচ্ছা যাও ১০০ টা নীল গোলাপ দিও,পারবানা?''
-"উমম.... পারব। কিন্তু কিস্তিতে দিব ! ৫ টা ৫ টা করে ! হা হা হা"
"যাহ! লাগবেনা তোর ফুল"
কথাটা মনে করে নিজের অজান্তে হেসে ফেলে রাহী।
এখানে থাকা তার ঠিক হবেনা।
খামোখা কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি?
পলাশী মোড়ের দিকে হাটতে থাকে সে।
ওর চোখের সামনে দুটো আইস্ক্রিম কিনে রিকশায় অপেক্ষমান গার্লফ্রেন্ডের কাছে গেল তারই হলের
এক বড় ভাই।
ওনার জায়গায় রাহী থাকলে অবশ্য নিশার সাথে শেয়ার করে খাওয়ার জন্য একটি আইসক্রিম ই কিনত।
রাহীর মতে এক আইস্ক্রিম এক কামড় করে শেয়ার করে খেলে প্রেম বাড়ে!!
ওর সেই বৃষ্টির দিন গুলোর কথা মনে পড়ে যায় যখন দুজন রিকশার হুড নামিয়ে বৃষ্টিতে ভিজত!
হুম! বৃষ্টি ওদের দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল।
তাই সবাই যখন বৃষ্টি থেকে গা বাচাতে আড়াল খুজত, তখন ওরা বৃষ্টি তে ভিজত রীতিমত আয়োজন করে,
রিকশায় ঘুরে ঘুরে!!
এমন কি ওরা নিজেদের মেয়ের নাম "রেইন" রাখবে বলে ঠিক করে ফেলেছিল!
আর ভিজতে ভিজতে চলতো ওদের শেয়ার করে আইস্ক্রিম খাওয়া,
নিশা আইস্ক্রিম খুব ভালোবাসত।
তাই রাহী একটা শেষ হবার সাথে সাথেই রিক্সা থামিয়ে আর একটা কিনে আনত।
ঠাণ্ডা লাগার ব্যাপারটাকে থোরাই কেয়ার করত ওরা।
পলাশির মোড়ে এসে দাড়াল রাহী।
ওর এখন ঘুম দরকার।
কষ্ট পেলেই ঘুমানোটা ওর অভ্যাস।
কারণ ঘুমের সময়টাতেই কোন আবেগ,অনুভুতি কাজ করেনা,ছুতে পারেনা কোন দুঃখ-কষ্ট।
ফার্মেসী থেকে ঘুমের ওষুধ কিনে রুমে ফিরে গেল।
জহুরুল হক হল,রুম নাম্বার ১১১।
রাহী হল এই রুমের নিউক্লিয়াস কিংবা মাইটোকন্ডিয়া!!
মানে হাসি,আড্ডা,গানে আর ফাজলামিতে সবসময় রুমটা মাতিয়ে রাখে সে !
ও রুমে আসলেই যেন সবাই প্রান ফিরে পায়।
কিন্তু আজ রাহীর মলিন রূপ দেখে রুমমেট সাইদ জিজ্ঞেস করে,
"কি হইসে মামা? মন খারাপ কেন? নিশার সাথে কিছু হইসে?"
-"নারে দোস্ত, কিছু হয়নি"
পাশের বেডে শুয়ে থাকা রাকিব বলল,
-"তুই বিজয় একাত্তর হলের ফর্ম জমা দিছিস না? মামা তোর তো সেই পলিটিকাল ব্যাকআপ! সিট তো তুই পাবিই"
জবাবে রাহী শুধু মুচকি হেসে বলে, ''তাই না?"
''হুম, যা ফ্রেশ হয়ে আয়, দুপুরে একসাথে খেতে যাই" - বলে রাকিব।
"আমি খেয়ে আসলাম মাত্ত্র।তোরা যা।"
এই বলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রাহী।
রাহীর যখন ঘুম ভাংলো তখন রাত ২ টা বাজে।
রুমের সবাই ঘুমে।
প্রচন্ড মাথা ধরেছে ওর,
চা খাওয়া দরকার।
হাতমুখ ধুয়ে কলম আর ডায়েরীটা নিয়ে রুম থেকে বের হয় সে ।
পলাশি মোড়ের রাতজাগা দোকান গুলোর কাছে এসে চা নিয়ে সিগারেট ধরায়।
রাতে আর দুপুরে কিছু খায়নি সে,
কোন এক অজানা কারণে ক্ষুধা পাচ্ছেনা তার।
চা শেষ করে হলের পুকুরপাড়ের বেঞ্চে বসে।
চারতলা হলের জলতে থাকা আলোগুলো পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে!
যেন রঙয়ের ছড়াছড়ি!
পানি যেন চিকচিক করছে...
রাহীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে,
তার চোখের পানিও চকচক করছে সেই আলোয়...।
ইশ! নিশা যদি এই দৃশ্যটা একবার দেখত!
কলম হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করেছে রাহী।
একটু পরপর তাকে চোখের পানি মুছতে হচ্ছে,
কারণ চোখের পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে ডায়েরির পাতা।
রাহী কবিতা লিখছে,
কিন্তু এটাকে কবিতা বলে কি না সে জানেনা -
''স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই থাকে।
বদলায়না,যত সহজে মানুষ বদলায়।
ওদের চিৎকার , ওদের প্রতিবাদ,
কি কখনো তার কাছে পৌছায়?
পৌঁছালে আর না পৌঁছালে ,
এখন আর কিছু আসে যায়না,
সব জীবনের মানে খুজতে নেই,
সব জীবনের মানে হয় না।
স্নৃতিগুলো স্মৃতি হয়েই আছে।
ভোলা হয়নি, যত সহজে মানুষ ভুলে যায়।
ওদের রোমন্থন আর রক্তক্ষরণ,
কি কখনো তাকে কাদায় হাসায়?
সেই হাশি কিংবা কান্নাতে,
এখন আর কিছু আসে যায়না,
সব জীবনের মানে থাকতে নেই,
সব জীবনের মানে থাকেনা।"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৫ রাত ১:০৩