আহা, অনেকদিন পর এলাম ব্লগে, বছরের প্রথম আম ভর্তা খেতে খেতে। অবশ্য এটা ইংরেজি বছরের প্রথম, বাংলা বছরের হয়তো এই শেষ। হয়তো এই শেষ ব্লগে আসাও। আবার পরীক্ষার যাঁতাকলে পড়বো। বাংলা বছরের শেষ পরীক্ষাটা ইংরেজী হয়াতেই খানিকটা অবসর।
ছোটবেলা ঝড়ের দিনে আম কুড়াইনি কখনই, মা ঠাণ্ডা লাগবে ভয়ে বাইরে যেতে দিত না। মামার বাড়ি কোন আম গাছও ছিল না, তাই 'ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়ানো সুখ' লাইনটা আমার জন্য সারা জীবন ছড়াই থেকে গেল। কিন্তু বৃষ্টিতে মাঝে মাঝেই ভিজি এখন। ভিজতে হয় বলাটাই ভালো। ঘোর বরষায় বেরসিক প্রাইভেট কিনবা কলেজ়ে যেতে রিক্সার প্রয়োজন। যেন তেন না, পর্দাওয়ালা। ছাতা নিয়ে উদাসীনের মত রাস্তা দাঁড়িয়ে থাকা, কখনো একটা দুইটা খালি পাওয়া গেল, তারা হয় বলল যাবে না নয়তো পাঁচগুণ ভাড়া দাবি করে বসল। অনেক কষ্ট করে রিক্সা করে গিয়ে দেখলাম প্রাইভেটের সামনে সাঁতার পানি। এলাম তো, যাবো ক্যামনে? এভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে ভিজতে ভিজতে কাক ভেজা হতে হয়।
এমনি এক ঝরোঝরো বরষার দিনে অনেক কষ্ট করে এক রিক্সা পেলাম, গন্তব্য ইংরেজী প্রাইভেট যা এমনি তে শহরের মাঝখানে হলেও বরষার সময় নদীতীরে চলে যায়! আশা করি সিচুয়েশনটা বোঝাতে পেরেছি। রিক্সায় ওঠার পর থেকেই চিন্তা করছি, কতটুকু পানি জমতে পারে, পানি টা কতটুকু নোংরা হতে পারে, কখন সরতে পারে ইত্যাদি। এমন সময় টের পেলাম, রিক্সাওয়ালা কথা বলছে। মুখ যেহেতু আছে, কথা সে বলতেই পারে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, সে আমার উদ্দেশ্যে কথা বলছে, যা আগে কখনো হয়নি। আমি আবার কানে সামান্য খাটো, তার উপর আবার বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। অনেক কষ্টকরে কিছু কিছু কথা উদ্ধার করতে পারছিলাম। ছেলেটা (আমার প্রায় সমবয়সীই) তার জীবনের গল্প করছিল। গ্রামে বাড়ি, কি ভাবে জানো (আমি উদ্ধার করতে পারি নি) সে শহরে আসে। ভালোই ছিল। আশরাফুলের বন্ধু ছিল। এই আশরাফুল সেই, যে কিছু কাল আগেও আমাদের ক্রিকেটের আশার ফুল ছিল, এখন নির্ভুল ভাবে বাজে ফরমে আছে। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় আশরাফুল সাফল্যের শীর্ষে ছিল। ছেলেটা বলছিল, আজ কোথায় সে আর কোথায় আশরাফুল। যার সাথে একসাথে খেয়েছে, শুয়েছে - সে আর আজ তাকে চেনে না। ছেলেটা আন্তরিক ভাবে বলছিল, আমারও বেশ খারাপ লাগছিল। মাঝে মাঝে কিছু কিছু উত্তরও দিচ্ছিলাম। এতে ছেলেটার কথা বলার আগ্রহ বাড়ছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল আমার সম্পর্কে। সাথে সাথে বলছিল তার নিজের অনেক গল্প। মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ, কিন্ত অনেক গল্প হল, একটা বন্ধুত্ব তৈরি হল।
গলির মুখে ঢুকে যা ভেবেছিলাম, সেইটাই দেখলাম। ড্রেনের জলে গলি ভেসে গেছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম, ফিরার সময় কি করব ভেবে। ছেলেটাই সব সমস্যার সমাধান করে দিল। সে বলল, আমাকে সেই নিতে আসবে। আমি তাকে ১২টায় আসতে বলে দিলাম।
প্রাইভেটের এক গার্জিয়ান কে বললাম ঘটনাটা। আমার বেশ মজা লেগেছিল ব্যাপারটা। কিন্তু আন্টির ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগে নি। কোথাকার কোন উটকো বস্তির ছেলের সাথে বন্ধুত্ব, এরা তো মেয়ে দেখলেই গলে যায় ইত্যাদি। আমি নিজেও একটু চিন্তায় পড়লাম। এতকিছু ভেবে তো বন্ধুত্ব করিনি কখনো। তাই একটু কষ্টও পেলাম। কিন্তু অপেক্ষা করতে লাগলাম। এর মধ্যে বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে। বারোটা বাজল। আরো কাটল দশ মিনিট। তবুও ছেলের দেখা নেই। আন্টিটা বার বার বলছিলেন, আসবে না আসবে না। আমিও ভাবলাম, আসবে না। তখন অগত্যা ড্রেনের পঁচা জল পাড়িয়ে বাসায় এলাম। সারা দিন মন খারাপ ছিল।
পরে আবার যখন সেখানে গেলাম, স্যার আমাকে ডেকে বললেন, এক রিক্সাওয়ালা এসেছিল তোমার খোঁজে। সে দিনও বৃষ্টি পড়ছিল।
ছেলেটাকে আর কখনো দেখিনি।