রাষ্ট্র হিসেবে নতুন হলেও বাংলাদেশের ইতিহাস বহু শতাব্দীর। এ দেশের সংস্কৃতির শেকড় প্রাগৈতিহাসিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃত। কখনো সাম্রাজ্যের, কখনো উপনিবেশগত, কখনোবা স্থানীয় সামন্ত সমীকরণের বহু বিচিত্র রাজনৈতিক পরিবর্তন এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবনধারকে প্রভাবিত করেছে। এই বহুমুখী পরিবর্তন দেশের সৃজনশীল প্রতিভাকে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের চারুকলার বিবর্তণের ধারার তাই একটি সুস্পষ্ট কালক্রম রয়েছে যা আধুনিক মূলধারা পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের আধুনিক চিত্রকলার ধারা ঐতিহ্য উত্তরাধিকারে ঋদ্ধ। চল্লিশ দশকের শেষে থেকে শুরু করে পঞ্চাশ দশকের মধ্যে পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্পশিক্ষা নিয়ে যে সকল শিল্পীদের আর্বিভাব ঘটে তাঁরাই মূলত বিরাট পরিবর্তন এনেছেন আমাদের শিল্পচর্চায়।
১৯৪৮ এর শেষে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের শিল্পশিক্ষা। ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টম্বর সর্বপ্রথম ছাত্র ভর্তি করার বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রচারিত হয়। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে নতুন আর্ট ইনষ্টিটিউটে প্রায় ১৬/১৭ জন ছাত্র ভর্তি পরীক্ষাও দেয় এবং তার দু-এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয় ক্লাস । ঢাকায় আর্টস্কুল কেন্দ্রীক চিত্র চর্চার সূচনা হয় ১৮৬৪ সনে বৃটিশভারতের রাজধানী কলকতা সরকারী আর্ট স্কুল থেকে। অবশ্য আধুনিক ভারতবর্ষীয় চারুকলার শুরুও এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই। অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫০) এক শিল্পধারার সূচনা করেন যা ক্রমে বেঙ্গল স্কুল নামে পরিচিতি হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিল্পরীতি পূণপ্রবর্তন ছাড়াও তিনি মোগল অনুচিত্রের কমনীয়তা, জাপানের সংযত বিন্যাস এবং পাশ্চাত্যের গঠনশৈলী সমন্বয়ে এক নিজস্ব রীতির প্রবর্তন করেন। তবে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, খাজা শফিক আহমদ এবং আরও কয়েকজন। ১৯৭৪ সালে ভারত বিভাগের পর জয়নুল আবেদিন ঢাকায় চলে আসেন এবং পরবর্তী বছর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রধান চারুকলা প্রতিষ্ঠান যা আর্ট কলেজ বলে সমধিক পরিচিতি। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান চারুকলা ইনষ্টিটিউট হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ভূক্ত রয়েছে।
সূচনাবর্ষের উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে শিল্পী আমিনুল ইসলাম তার শিল্পকর্মে নিজস্বতার ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ভাষায়- আমাদের শিল্পীরা সাধারণত ঘন রঙ ব্যবহার করে, তাদের উদ্দেশ্যে টেকস্চার তৈরি করা। রেমব্রান্ট বা রুবেনস-এর কাজে টেকস্চার রয়েছে। রেমব্রান্ট এর ব্রাশের কাজ খুব উঁচু মাপের। রেমব্রান্ট টেকসচারের জন্যই টেকস্চার তৈরি করেন নি। দীর্ঘ সময় ছবিটা নিয়ে কাজ করেছেন, ওইভাবেই টেকস্চার তৈরি হয়ে গেছে।
প্রথম থেকেই আনোয়ারুল হক পেন্সিল ও কালি কলমে ষ্টিল লাইফ অর্থাৎ একটা সুরাই কিংবা কলসি, পারস্পেকটিভ ক্লাসে একটি টুল কিংবা কিউব ও পিরামিড ইত্যাদি আঁকতে দিতেন। প্রথমদিকে শুধু লাইন ড্রইংই হতো। কামরুল হাসান প্রধানত আউটডোরে নিয়ে যেতেন। রমনার বিভিন্ন গাছের গুঁড়ি, ডালপালা, আর ক্লাসে টবে লাগানো পাতাবাহার ইত্যাদি আঁকাই ছিল প্রধান কাজ। আর সফিউদ্দিন আহাম্মেদ করাতেন শুধু উডকাট। বিভিন্ন জাতীয় কাঠ কাটার জন্য নুরুণ ও বুলি কিনে আনা হতো। বিষয় ছিল প্রধানত পাতা অথবা সুরাই ইত্যাদি। এ-সময় অর্থাৎ প্রথম বছর উপরে উল্লিখিত বিষয়সমূহ ছাড়াও ব্লাকবোর্ডে কিছু ড্রইং করতে হতো। অজন্তার ছবির লাইনের কাজের কপি, যা না-কি কলকাতার আর্টস্কুলেও করানো হতো। প্রথম থেকেই জয়নুল আবেদিন সহ সকল শিক্ষকই শিল্প-শিক্ষাক্রম সম্বন্ধে কলকাতার আর্টস্কুলেই আর্দশকেই বেছে নিয়েছিলেন। পাঁচ বছরের কোর্সে প্রথম দুই বছর এলিমেন্টারি বিভাগ ও পরবর্তী তিনবছর, ড্রইং ও পেইন্টিং অথবা কমার্শিয়াল আর্ট। তবে কামরুল হাসান বাইরে স্কেচ করতে উৎসাহ দিতেন খুবই আর প্রত্যেককেই সর্বদা স্কেচ করতে নিয়ে যেতেন। ১৯৪৮-এর প্রথম বর্ষে যোগদানকারী ছাত্রদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রাহমান, আবদুর রাহমান ভুইয়া, আবদুল কাদের, মোহাম্মদ ইসমাইল, আলফাজুদ্দিন খন্দকার, নরুল ইসলাম, খালেদ চৌধুরী, শামসুল আলম, ইমদাদ হোসেন, জুলফিকার আলী, প্রভাস সেন , লোকনাথ ধর এবং আরো দু-চারজন। প্রথম থেকেই ক্লাসের কাজ ছাড়াও প্রত্যেক ছাত্রকেই সপ্তাহান্তে স্কেচ খাতা দেখাতে হতো প্রধানত কামরুল হাসানকে। আনোয়ারুল হক এবং সফিউদ্দিন আহাম্মেদও মাঝে মাঝে দেখতেন এবং সবসময় সঙ্গে স্কেচ খাতা রাখতে বলতেন। ক্লাসের শেষে প্রায় প্রত্যেক দিনই সকলেই দল বেঁধে সদরঘাট অঞ্চলে যেত; বিভিন্ন ধরনের নৌকা, জাহাজ, লঞ্চ এবং অসংখ্য মানুষজনের বসার ভঙ্গি, হাঁটার ভঙ্গি গভির মনোযোগ দিয়ে দেখার চোখ তৈরি করতে। প্রথা অনুযায়ি ক্লাসে অবশ্য রেখার কাজের সঙ্গে আলোছায়া দিয়ে প্রথমে পেন্সিল, তারপরে কালি-কলমে,সুরাই জাতীয় মাটির পাত্র অঙ্কনের কাজ হতো। এই সময়ে ক্লাসে কালি কলমের কাজ ছাড়া প্রধানত সেপিয়া রং দিয়ে পারস্পেকটিভ করানো হতো জলরঙে ওয়াশের মধ্যামে। এই সকল ক্লাসে আনোয়ারুল হক ওলন ধরার নানাবিধ কৌশল আয়ত্ত করতে বলতেন। দ্বিতীয় বছর থেকে ক্লাসে জলরং দিয়ে পাতাবাহার গাছের রঙ-বেরঙের পাতা, ক্যানা ফুল আর ষ্টিল লাইফ হুবহু আঁকতে হতো একাডেমিক পদ্ধতিতে। এর মধ্যে বাইরেও বিভিন্ন ধরনের কাগজে প্রকৃতি থেকে অসংখ্য দৃশ্যচিত্র আঁকা হতো জলরংকে আয়ত্তে আনার জন্য। তখন কার্টিজ কাগজ ছাড়া বিলাতি হ্যান্ডমেইড অথবা কেন্ট কাগজ দুস্প্রাপ্য ছিল। তবু ব্যবহার করা হতো অতি সাবধানে, যেন কাজটা নষ্ট না হয়। জয়নুল আবেদিন এর একটা কম্পোজিশন ক্লাসের সাবজেক্ট ছিল স্বর্ণকার, ধুনকার, নৌকায় গুণ টানা, কামার অথবা কুমারের কর্মরত অবস্থায় দৃশ্য। ছাত্ররা ঐসব বাইরে অর্থাৎ ওদের কাজের জায়গায় গিয়ে স্কেচ করে নিয়ে আসতো। প্রথমে পেন্সিল দিয়ে পুরো ড্রইংটা করে কেন্ট অথবা হ্যান্ডমেইড কাগজে ট্রেস করে জলরঙে ছবিটা সম্পূর্ণ করতে হতো।
প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের কাজের উপকরনগত বৈচিত্র ও নিরীক্ষা তরুনদের উপর প্রভাব ফেলে। একদিকে জয়নুল আবেদিনের প্রেরণা, কামরুল হাসানের বাইরে স্কেচ করা আর সফিউদ্দিন আহাম্মেদ এর উডকাট ও উডগ্রেভিং তখনকার দিনে সকল ছাত্ররই প্রেরণার উৎস ছিল। প্রথম বছর বেশ কয়েকটা উডকাট করার পর আমিনুল ইসলাম উড এনগ্রেভিংয়ে কাজ করেছিলেন। এনগ্রেভিংয়ে কাজ করতে প্রয়োজন কাঠকে ক্রস সেকশনে কাটা, তক্তার মত নয়। সে সময় ঢাকায় শাড়ি ছাপাবার জন্য বংশালে কাঠাঁল কাঠের ক্রস সেকশনে কাটা পাওয়া যেত, যদিও সূক্ষ্ম কাজের জন্য ব্যবহারে অনুপযুক্ত, তা-হলেও আমিনুল ইসলাম ঐ কাঠেই প্রথম উড এনগ্রিভং করেছিলেন। বেঙ্গল স্কুল বা রেনেসাঁ-র প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রথম প্রজম্মের শিল্পীরা এ দেশের শিল্প আন্দোলনে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সংযুক্ত করতে সক্ষম হন একেবারে গোড়া থেকেই। তাঁদের শিল্পকর্ম ছিল পৌরাণিক অলঙ্কারণ ও বিষয়বস্তুরহিত এবং যদিও লোকজ শিল্পরীতি ও ভঙ্গির প্রতি তাঁদের ছিল বিষ্ময়সূচক দূর্বলতা এ বিষ্ময় ছিল গ্রামীণকে মহিমান্মিত করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিজাত: কোনো সুদূর অতীতের লোকজ ঐতিহ্যের জন্য নষ্টলিজিয়া নয়। দুই কারণে যাত্রাকালেই আধুনিক শিল্পধারা প্রচন্ড রকম সেকুলার হয়ে ওঠে। বৃটিশ ভারতে প্রাচীন ও পৌরানিকে ফিরে তাকানো ভারতীয় জাতীবাদের প্রেক্ষিতে যুক্তিযুক্ত ছিল, কিন্তু দেশবিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় দেশজ ঐতিহ্যের আকর্ষণ, তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় ও গ্রামীণ বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে মেতে ওঠেন, সবল টানে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে।
শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর বিখ্যাত মন্বন্তরের স্কেচ এবং সজীব এপিকধর্মী স্ক্রলের জন্য সমধিক পরিচিত। অন্যদিকে কামরুল হাসান দেশজরীতিতে এবং পটুয়ার প্রবল প্রকাশভঙ্গিতে নিজস্ব দ্যোতনা খুজে পান। যদিও নারী অবয়বের শরীরী আবেদন তাঁর প্রধান শিল্পকর্ম জুড়ে ব্যাপৃত, কামরুল হাসান সৃষ্টি করেছেন কিছু অসামান্য প্রকৃতিচিত্র যা বর্ষণস্নাত এই দেশের সপ্রাণ পরিস্ফুটন ঘটায় তাঁর ক্যানভাসে। তাঁর কিছু অন্যবদ্য জলরঙ এর কাজ রয়েছে যা আকাশ বা মেঘচিত্র নামের এক নতুন নিসর্গ চিত্রের ধারা হিসেবে বিবেচনা করা যায় । জয়নুল-সুলতানের অমৃতের সন্ধান নয় অন্য এক মানুষের ধ্যানে স্থির হয়েছিল কামরুল হাসানের শিল্প-চেতনা। তার ছবির মানুষও অনাদি। সফিউদ্দিন আহমেদ শুরুতে কাঠ খোদাই ও এচিং-এ কাজ করেছেন। বিলেত থেকে ফিরে তিনি নিরেট জ্যামিতিক বিমূর্ততায় নিমগ্ন হন। চল্লিশের দশকে উড এনগ্রেভিং তিনটি দাবিকে পূরণ করেছিল। দুঃসহ বাস্তব অবস্থাকে ছাপিয়ে গণমানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার লক্ষ্যে দ্বিতীয়টি ছাপাচিত্র মাধ্যমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে মনোবিকার সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রয়োজনে এবং তৃতীয়টি সবচেয়ে পুরনো তা হলো পুঁথিপত্রে ইলাসট্রেশন মুদ্রিত করার কাজে। শিল্পী সফিউদ্দিন কাঠখোদাইয়ের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে সেই সময় তিনি গ্রাফিক্সের প্রথম সারির একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর কাজে যে স্নিগ্ধ চিক্কন আলো তা গ্রাফিক্স মাধ্যমের মর্ম উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে স্বোপার্জিত। ঐ একই সময়ের ময়ুরাক্ষী নদীর শোভা বিম্বিত করতে গিয়ে শিল্পী নির্ভরতা খুঁজলেন অ্যাকুয়াটিন্ট করণকৌশলে।
প্রথম প্রজন্মের শিল্পী দের মধ্যে আরেকজন প্রধান শিল্পী ছিলেন এস এম সুলতান যাঁর প্রথম দিককার কাজ খুব একটা সহজলভ্য নয়। দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তিনি ১৯৮০-র দশকে আবার শিল্পের জগতে প্রত্যাবর্তন করেন প্রকৃতি ও ভেষজ রঙ এর কাজ নিয়ে । তিনি কৃষককে তাঁর চিত্রকলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেণ-মানব সভ্যতার শক্তিমান নায়ক হিসেবে । শিল্পী সুলতান পশুপাখির সঙ্গে কথা বলতেন। বুঝতেন তিনি বৃক্ষের ভাষাও। পশুপাখির প্রতি প্রীতি বৃক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষ একসময় অস্তিত্ব সংরক্ষণের যে মন্ত্র শিখেছিল সেই প্রত্ন পৃথিবীকে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন শিল্পী সুলতান। সুলতান এর আগে কখনও সাম্যবাদী দর্শনে স্মাত হয়ে কৃষক আসেনি বাঙলার চিত্রপটে।
এইরূপ নানান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে দেশের চিত্রকলা হয়েছে সমৃদ্ধ আর বিস্তৃত।বাংলার চিত্রকলার চরিত্র নির্ভর করেছে ধর্মিয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যনধারনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে। পালরাজাদের আমলে ছিল মহাযান-তন্ত্রযান বৌদ্ধ ধ্যান ধারনার অনুপ্রেরনা আবার সুলতানি শাসন আমলে চৈতন্যদেব আশ্রিত - গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ভাবধারায়। আর এই শতাব্দীর সূচনায় স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দীপনায় সৃষ্টি হয়েছে প্রাচ্যদেশীয় নতুন এক চিত্র শৈলী। বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক জাগরণ ও সমাজ জীবনের জটিলতাও নানা ভাবে উত্তেজিত করেছে আমাদের চিত্রকলাকে।