somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরিহাসপুরের প্রতিশোধঃ বাঙালী বীরত্বের এক ভুলে যাওয়া আখ্যান।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৯:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়া এই কাহিনী বর্ণনা করতে চাইলে সামান্য ভূমিকা প্রয়োজন।

সময়টা অষ্টম শতাব্দী। মধ্য এশিয়া জুড়ে তখন বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছ্বাসের মত আরব-তুর্কি জয়রথ এগিয়ে চলছে। ভারত উপমহাদেশের সাথে আরবদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বহু পুরনো। তারা খুব ভালো করেই জানতো কি বিপুল পরিমাণ ঐশ্বর্য এই ভূমিতে জমা আছে। তাই ভারত বিজয়ের স্বপ্নটাও আসলে পুরনোই।
অতীতে সিন্ধু বিজয় সম্ভব হলেও আরবরা সিন্ধু থেকে বেরিয়ে কোথাও আক্রমণ করতে পারে নি। কিন্তু সমরকন্দ বিজয়ের ফলে ভারত বিজয় অনেকখানিই সম্ভবপর হয়ে উঠে। এই উদ্দেশ্যে বলখে একটি শক্তিশালী ঘাঁটিও গড়ে তোলা হয় কাবুল উপত্যকায় প্রবেশের জন্য। কিলকি ও বামিয়ান গিরিবর্ত্ম হয়ে আরব শক্তি ভারত আক্রমণের চেস্টা শুরু করে। পশ্চিমে সিন্ধু আর উত্তরে গান্ধার হয়ে দু দিক থেকে সাড়াশি আক্রমণ তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এসময় দুর্বার আরব – তুর্কী শক্তির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান কাশ্মীরের লীজেন্ডারি শাসক লালিতাদিত্য মুক্তপীড়।
ভারতের সেরা জিনিয়াস মিলিটারি মাইন্ডদের একজন ছিলেন লালিতাদিত্য। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভিনদেশি আগ্রাসন ঠেকাতে হলে সমগ্র ভারতের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সেসময় ভারতের সবচেয়ে বড় রাজত্ব ছিল মধ্যভারতের মৌখরি বংশের রাজা যশোবর্মনের। তিনি খুব দ্রুত যশোবর্মনকে আক্রমণ করেন যেন সীমান্তবর্তী সামন্ত রাজাগণ সাহায্য পাঠানোর পূর্বেই যশোবর্মনকে পরাজিত করা যায়। যশোবর্মন পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। কাশ্মীরের লালিতাদিত্য এগুতে এগুতে দক্ষিণের কর্ণাটক (বিতর্কিত) আর পশ্চিমে দ্বারকা পর্যন্ত জয় করে নেন। তিনি সিন্ধু উদ্দেশ্যেও রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু জলাভাবে বিশাল সৈন্যবল নিয়ে রাজস্থান মরুভূমি পার হতে ব্যার্থ হন। সিন্ধুর আরবগণ বেঁচে যায়। কিন্তু তিনি কম্বোজ এবং বোখারা দখল করে সেখান থেকে আরব ও তুর্কিদের বিতাড়িত করেন। শোনা যায় তিনি খোরাসান পর্যন্ত আক্রমণ করেছিলেন, তবে ব্যার্থ হয়ে ফেরৎ আসেন। বলাবাহুল্য, ভারতে আরব আক্রমণ সেই সময়ের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। তবে এই গল্প লালিতাদিত্যের নয়। এই গল্প এক বাঙালী রাজা ও তার অনুগত সেনাদের।
কহ্লন রচিত “রাজতরঙ্গিনি” অনুযায়ী লালিতাদত্যের সাথে-

“সৌহার্দ্যবশত গৌড়ের সমস্ত হাতি আসিয়া যোগ দেয়।“

আন্দাজ করা যায় গৌড় অর্থাৎ বাংলা জয় করতে লালিতাদিত্যকে তেমন বেগ পেতে হয় নি। বাংলা নিজেই স্বেচ্ছায় নতি স্বীকার করেছিল। সেসময় গৌড়ের রাজা ছিলেন রাজা গোসাল। অত্যন্ত স্বল্প পরিচিত এই রাজা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। এমনকি তিনি কোন বংশের ছিলেন তাও না। তবে অভিযান শেষ হওয়ার পর লালিতাদিত্য রাজা গোসালকে রাজধানীতে ডেকে পাঠান। লালিতাদিত্যের রাজধানী ছিল ঝিলম নদীর তীরে শ্রীনগর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে পরিহাসপুর নামক শহরে। এই শহর লালিতাদিত্য নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নামকরণ করেছিলেন তার নির্মিত “পরিহাসকেশব” নামক বিশাল এক বিষ্ণুমন্দিরের নামে। এই মন্দিরে কস্টিপাথরের সুবিশাল বিষ্ণুমূর্তি ছিল।
সে যাই হোক, রাজ সভায় লালিতাদিত্য গৌড়ের রাজা গোসালকে ডেকে এনে অত্যন্ত অপমান করেন। তিনি এও বলেন, গোসাল গৌড়ের সিংহাসনে আছেন শুধুই তার কৃপায়। এরপর লালিতাদিত্য রাজা গোসালকে রাজসভা থেকে বের করে দেন। এতেই তিনি ক্ষান্ত দেন নি। ফেরার পথে ত্রিগামী নামক স্থানে গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে লালিতাদিত্য রাজা গোসালকে হত্যা করেন। গুপ্ত ও শশাংকের সাম্রাজ্যের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বাঙলার সূর্য তখন অস্তমান। প্রবল লালিতাদিত্যের সাথে যুদ্ধের ক্ষমতা বাঙলার ছিল না। তবুও একদল দুঃসাহসী বাঙালী সৈনিক শপথ নিয়েছিল, এই অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে তারা ঘরে ফিরবে না।
এই সৈন্যদল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বাংলা থেকে কাশ্মীর পৌঁছে যায় প্রতিশোধের স্পৃহায়। তারা সারদা দেবীর মন্দির দর্শনের অজুহাতে রাজধানী পরিহাসপুরে প্রবেশ করে। এরপর সবাই একত্র হয়ে আচমকা পরিহাসপুরের প্রধান মন্দির ও লালিতাদিত্যের নিজস্ব উপাসনালয় পরিহাসকেশব মন্দির আক্রমণ করে বসে। লালিতাদিত্য সেসময় রাজধানীর বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। তখন গৌড়ের সেনারা সিদ্ধান্ত নেয়, লালিতাদিত্যের গর্ব কষ্টি পাথরের বিশাল বিষ্ণুমূর্তি টি ভেঙে ফেলা হবে। পূজারিরা ব্যাপার টের পেয়ে দ্রুত মূর্তিটি সরিয়ে ফেলেন। উপরন্তু, মন্দিরে প্রায় সমান আকৃতির একটি কষ্টিপাথরের রামমূর্তি ছিল। গৌড়ের সেনারা সেটিকে প্রধান মূর্তি ভেবে ভুল করেন।
ততক্ষণে কাশ্মীরি সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে মন্দির ঘিরে ফেলে আক্রমণ শুরু করেছে। এই অভিযানে সমস্ত বাঙালী সেনা শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ করে প্রাণ দেন। তবে মৃত্যুর পূর্বে তারা সেই কষ্টিপাথরের মূর্তিটিকে ভেঙে গুঁড়ো করে বাতাসে উড়িয়ে দেন।


কহ্লণ “রাজতরঙ্গিনি” লিখেছিলেন লালিতাদিত্যের প্রশংসা করবার উদ্দেশ্যে। সেই রাজতরঙ্গিনিতেই তিনি লিখেছিলেন-

“তদিয়রুধিরসারৈঃ সমভূদুজ্জলিকৃতা।

স্বামীন্ড ভক্তির সামান্যা ধন্যা চেয়ং বসুন্ধরা।।

অদ্যাপি দৃশ্যতে শূন্যং রামস্বামীপুরাস্পদম।

ব্রহ্মাণ্ডং গৌড়বীরাণাং সনাথং যশস্ব পুনঃ। “

অর্থাৎ, তাদের রুধির ধারার অসামান্য প্রভুভক্তির উজ্জ্বলতায় বসুন্ধরা উজ্জ্বল হয়েছিল। অদ্যপি রামমন্দিরটি শূণ্য পরে আছে, কিন্তু তাতে গৌড়ের বীরত্ব যেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ঘোষিত হচ্ছে।



রেফারেন্সঃ

রাজতরঙ্গিনি- কহ্লণ। (৪। ২৯৪-৩৩৫, ৪। ৪৮৩-৪৮৫)

গৌড়বাহো (শ্লোক ৭৩৮-৭৯৬)

Hindu History of Kashmir- H. H. Wilson.

Kashmir and Kashgar- H. W. Bellew.
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৯:৪০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×