কিছুদিন পূর্বে এক সন্ধ্যেবেলায় হঠাত্করেই মাথায় এলো চিন্তাটি। এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে বহিরাগতদের শাসন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বৈচিত্রময় জনপদের হতভাগা লোকেরা নিষ্পেষিত হয়েছে আরব, পারস্য, আফগান, মঙ্গল আর ইংরেজদের দখলদারিত্বে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কিংবা সাধনা বলতে যা বুঝায়, এ ব্যাপারে এ অঞ্চলের লোকেরা সবসময়ই ছিলো পশ্চাত্পদ। তেমনভাবে উন্নত জ্ঞানচর্চার কোন সুযোগ না থাকায় এই জনপদের অধিবাসীদের বুদ্ধির বিকাশ দারুনভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহিরাগত বিভিন্ন জাতি কর্তৃক গৃহপালিত তৃণভোজী প্রানীর মতো চারিত হয়েছে।
দখলদারিত্বের এই দীর্ঘ সময়ে বিপ্লব-বিদ্রোহ ঠেকাতে এই পরাধীন জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সময়ে উপভোগ করতে দেয়া হয়েছে সীমিত আকারের প্যাকেজ স্বাধীনতা। এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এদের কাছে স্বাধীনতার মানে দাঁড়িয়েছে, স্রেফ একটি নতুন ভূখন্ড, একটি নতুন পতাকা।
জ্ঞানহীন এই বিশাল মৃত জনগোষ্ঠীর মাঝ থেকে যখনই কেউ চেষ্টা করেছেন এই জনপদের ভাগ্যোন্নোয়নের, সাথে সাথে অপর প্রান্তে সমগোত্রীয় একদল দাঁড়িয়ে গেছে সর্বান্তকরনে বাঁধা দিতে। এই বাঁধাদানের বিনিময়ে তারা পেয়েছে ব্যক্তিগত সীমিত কিছু সুযোগ-সুবিধা।
আজ ভূখন্ডের নাম বদলেছে, পতাকার রং বদলেছে, জাতীয় সংগীতের সুর বদলেছে কিন্তু বদলায়নি সমগোত্রীয় বাধাদানকারীদের চরিত্র। ব্যক্তিগত সীমিত সুযোগ-সুবিধা পাবার লোভে এরা পদদলিত করে পুরো জনগোষ্ঠীর ভাগ্যকে। ফলে এই হতভাগা বিশাল জনগোষ্ঠী আজও বঞ্চিত, শোষিত এবং অবহেলিত। যদিও পরিবর্তন হয়েছে ভূখন্ডের নামকরনের, পরিবর্তিত হয়েছে পতাকার রং, পরিবর্তন হয়েছে স্বাধীনতার সংজ্ঞার, কিন্তু শোষন বন্ধ হয়নি। কেবলমাত্র পরিবর্তন হয়েছে শাসকের আর শোষন পদ্ধতির।
কোন জনগোষ্ঠী নিজে যদি তার ভাগ্য বদলের চেষ্টা না করে তবে অন্য কারো পক্ষে তাদের ভাগ্য বদল করা সম্ভব নয়। তাই এই জনপদের অধিবাসীদের নিজেদেরকেই চেষ্টা করতে হবে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে।
এই উপমহাদেশের লোকেরা স্বাধীনতা অর্জন করেছে নাকি ইংরেজরা তাদেরকে স্বাধীনতার মোড়কে নব-পরাধীনতা উপহার দিয়ে গেছে সেটা তর্কসাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখন বহিরাগতরা নেই। অতএব, এখনই সময় আমাদের পূর্বপুরুষদের অজ্ঞতার প্রায়শ্চিত্য করার। এবার উপমহাদেশ থেকে নজর ফেরানো যাক বাংলাদেশের দিকে।
স্বাধীনতা অর্জনের পরে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষার জন্যে প্রণয়ন করা হয়েছে সংবিধান। সংবিধানই হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এখানে লেখা থাকে একজন নাগরিকের জন্যে রাষ্ট্র কর্তৃক কি কি সুবিধা এবং সম্মান প্রাপ্য। সংবিধানের নাগরিক অধিকারগুলোর ব্যাপারে ৯৯ ভাগ মানুষই অবহিত নন। এই অজ্ঞতার ফলে তারা জানেন না রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে কি কি সুবিধা এবং সম্মান দেয়া হয়েছে। অথচ সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারলেই উপলব্ধি করা যাবে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ। সংবিধানে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সমগোত্রীয় মুষ্টিমেয় কিছু লোক নেতা সেজে শোষন করছে পুরো জনগোষ্ঠীকে।
স্বাধীনতা মানে নতুন ভূখন্ড, নতুন পতাকা আর নতুন সুর নয়। স্বাধীনতা মানে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকা। সময় এসেছে সংবিধান পড়ে দেখার, সময় এসেছে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের।
ঢাকা থেকে
০৪.১০.০৭