গত বছরের শেষের দিকে দেশের রাজনৈতিক অসহিঞ্চুতা তখন চরমে পৌঁছেছে। দিনেরবেলা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদল উভয়ের শক্তির মহরা এবং শেষ বিকেলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া অত্যন্ত জাকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সন্ধ্যের দিকে বাসা থেকে বের হলাম, উদ্দেশ্য সংবিধানের সর্বশেষ সংস্করণটি ক্রয় করা। পুরো শহর থমথম করছে। দোকানপাট বেশীরভাগই বন্ধ। দু'একজন অতি সাহসী ব্যবসায়ী দোকান খুলেছে তবে শাটার অর্ধেকেরও বেশী নামানো। স্বল্প সময়ের নোটিশে তালা লাগিয়ে দৌড় দেয়ার জন্যে প্রস্তুত।
বইয়ের মার্কেটে গিয়ে দেখি অনেক দোকানই খোলা রয়েছে। কিন্তু কোন দোকানেই বাংলাদেশের সংবিধান পাচ্ছি না। অনেক ঘুরে অবশেষে একটা বড় দোকানের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। দোকানের একটা বাদে সব শাটার বন্ধ। একটি ১৮/২০ বছরের ছেলে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। "বাংলাদেশের সংবিধান আছে?" ছেলেটির কাছে জানতে চাইলাম। মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো নেই। কি মনে হতে দোকানের ভিতরে ঢুকে পুনরায় জীজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশের সংবিধান আছে কিনা। একটি ছেলে জানালো পকেট সাইজেরটি আছে। বললাম, তাতেই হবে। ৫০ টাকা থেকে দর কষাকষি করে ৪৫ টাকায় কিনে পকেটে পুরলাম গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। এ সময় দোকানের সামনের পাহারারত ছেলেটি ভেতরে এসে অন্য ছেলেটিকে বললো, সংবিধান বিক্রি করেছ কেন? "অমুক" ভাই যে কারো কাছে সংবিধান বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। ছেলেটিকে বললাম, "দেখ সংবিধান লুকিয়ে রাখার কোন জিনিষ নয়, এটা সকল নাগরিকের অবশ্য পাঠ্য।"
সংবিধান আসলে কি?
সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি এবং নির্দেশনাসমূহ। রাষ্ট্র কি নামে পরিচিত হবে, এর সীমানা, পতাকা, জাতীয় সংগীত, প্রতীক, নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে সংসদ, আইন, বানিজ্য, যুদ্ধ সবকিছুর নির্দেশনা রয়েছে সংবিধানে। সংবিধানই হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কখনো যদি এমন কোন আইন প্রণয়ন করা হয় যা সংবিধানের যে কোন অনুচ্ছেদের পরিপন্থী কিংবা সাংঘর্ষিক, সেক্ষেত্রে নতুন আইনটি বাতিল বলে গন্য হবে এবং সংবিধানের নির্দেশ বহাল থাকবে।
সংবিধানের একদম শুরুতেই বলা হয়েছে,
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
(দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)
আমরা, বাংলাদেশের জনগন, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষনা করিয়া জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।"
উপরোক্ত ঘোষনার মাধ্যমে সকল প্রকারের রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র আর পরিবারতন্ত্রকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে একথাই স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, এই দেশ প্রতিটি বাংলাদেশী নাগরিকের নিজস্ব¡ সম্পদ। বলা হয়েছেঃ আমরা, বাংলাদেশের জনগন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা দল নয়। সংবিধান শুরুতেই ব্যক্তি আর দলপুজার পথকে নির্মূল করে দিয়েছে। অথচ গত ৩৫ বছরের অধিক সময় ধরে এদেশে দল আর ব্যক্তির আরাধনা অঘোষিত আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনগনের নিকট থেকে এই সংবিধান শুধুমাত্র একারনেই দুরে রাখা হচেছ যে, সাধারন মানুষ এটি পাঠ করলে তারা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠবে। আর কেউ যদি একবার নিজ অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে তবে সেই অধিকার থেকে তাকে আর বেশীদিন বঞ্চিত রাখা সম্ভব নয়।
সংবিধানে নাগরিকের জন্যে কিছু মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। যা কখনোই কোন আইন কিংবা আদালতের নির্দেশ দ্বারা রহিত করা যাবে না। সাধারন মানুষ জানেনা রাষ্ট্র কর্তৃক কি কি অধিকার এবং সম্মান তাদের প্রাপ্য। এই অজ্ঞতার সুযোগে রাজনীতিবীদ নামের একশ্রেনীর লম্পট সাধারন মানুষকে ভেড়ার মতো যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে পরিচালিত করছে। অথচ প্রতিটি নাগরিকের উচিত সংবিধানের নাগরিক অধিকারগুলোর ব্যাপারে অবহিত হওয়া। তবেই কেবলমাত্র এর প্রয়োগ এবং অধিকার রক্ষার পথ উন্মুক্ত হবে।
ঢাকা থেকে
০৫.১০.০৭