somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড়গল্প: অগোচরের সুপ্ত শীতলতা ।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গভীর রাতে গ্লাসে পানি ঢালার শব্দে সায়ানের হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় । ঘুমের চোখে ডীম লাইট জ্বালানো ডাইনিং রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই ওখানে ।পাশে বড়ভাইয়ের রুম থেকেও নড়াচড়ার শব্দ আসলো । আম্মুর রুম থেকেও দীর্ঘভাবে শ্বাস নেওয়ার একটা আওয়াজ কানে ভেসে আসলো । সায়ান ভাবে তাহলে কি আমার মতো গভীর রাতের এই আওয়াজে সবাই জেগে উঠে ? সবারই কি এই গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে চোখের কোণ দিয়ে ফোটায় ফোটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ? কিন্তু আমাদের সবার তো খুশি হওয়ার কথা দীর্ঘ একটি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি । এখন আর তো কোন কিছুর জন্য দায়বদ্ধতা নেই । সকলেই স্বাধীন হয়ে গিয়েছি । মুক্তি পেয়ে গিয়েছি । তবে কেন এই গভীর রাতে অজানা দুঃখে বুক কেঁপে উঠে ?

সায়ানের বাবা দবির উল্ল্যাহ্ খালার ঘরে পালিত ছেলে কারন অতি অল্প বয়সেই উনার বাবা মা দুইজনই পরলোক গমন করেন ।আর বাবা মা তাঁর জন্য রেখে যান শুধুই দারিদ্র্যতা ।পড়ালেখায় মনযোগী হওয়ায় খালা কষ্ট করে দবিরকে পড়াশোনা করান আর সেই সুবাদেই পুলিশের চাকরিটা জোটে । এর কিছু দিনের মাথায় পুরনো ব্যারাম হাঁপানিতে খালা সজ্জ্যাশায়ী হন । উনি আর কখনো জেগে উঠেননি ।তখন দবিরের এক টুকরো খড়ের তৈরি ঘরটা ছাড়া আর কেউই ছিল না ।তিনি ঘরের ভেতর দেব কাঠের তৈরী খাটটায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে চালার ফাঁক দিয়ে অন্ধকারে ফুটে থাকা আসমানের তারাগুলো দেখছেন ।আর আনমনে আঙ্গুলের ইশারায় জপছেন, এইটা হলো বাবা, এইটা হলো মা, এইটা হলো খালা, এইটা হলো বাবা…

খালা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরে দবির সাহেব সায়ানের মা রাবেয়া বানুকে বিয়ে করেন ।রাবেয়া বানু তেমনী খাটো ছিলেন যেমনী লম্বা ছিলেন দবির সাহেব ।তবে এ নিয়ে দবির সাহেব মোটেও নাখোশ ছিলেন না । তিনি বউ হিসেবে চাইতেন একজন সহজ সরল নারীকে সেই হিসেবে রাবেয়া বানুর বেশ সুনাম আছে ।একটি ভাঙ্গাচুরা ছনের ঘর নিয়ে দুইজন মানুষ তাঁদের নতুন জীবনযাত্রা শুরু করেন ।পুলিশের সামান্য কটা বেতনের টাকা থেকে অল্প অল্প করে জমিয়ে দবির সাহেব মোটামুটি ভালোই সহায় সম্পত্তি গড়ে তুলেন ।

সায়ানদের এখন সাইড ওয়াল দেওয়া বিশাল বাড়ী রাজকীয় গেইটে বেষ্টিত । দক্ষিন এবং পশ্চিম পাশে আছে দুইটা বড় পুকুর । বাড়ির চারপাশে সবুজ অরণ্যে ঘেরা । উত্তর পাশে গোয়াল ঘর ।ওখানে দুটো বিশাল সাইজের অষ্ট্রেলিয়ান গাভী থাকে । মাঝখানে আছে বিশাল দালান ঘর আর তার মুখোমুখী পূর্বপাশে আছে কাছারি ঘর । দুই ঘরের মাঝে আছে মাঠের মত বিশাল উঠান । জমিজমার ফসলের মৌসমে উঠানবাড়ী পুরে একাকার হয়ে যায় । বলা চলে দবির সাহেব একটা স্বর্গ বানিয়েছেন । যদিও দবির সাহেবের বংশ ছিল ভূইঁয়া কিন্তু উনার পেশার সুবাদে দশ গেরামের মানুষ উনার বাড়ীকে দারোগা বাড়ী হিসেবে এক নামে চেনে ।যেমনি অর্থবিত্ত তেমনী সম্মান ।সায়ান এবং তার বড় ভাই মেশিন পার্টস এর ব্যবসা করেন তাও বাবার জমানো টাকায় গড়া । সবকিছুতেই দবির সাহেবের ছোঁয়া জড়িত । দবির সাহেবের বাবা উনাকে দিয়ে গিয়েছিলেন ‘শূন্য’ আর তিনি তাঁর সন্তাদের দিয়েছেন ‘স্বর্গ’ ।সাহানদের এই অবস্থানে আসার জন্য তাঁর বাবা দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর সখ আহ্লাদ অপূর্ন রাখার সংগ্রামের যে জটিল ধাঁধা এঁটেছিলেন সেটা সন্তানদের অজানাই রয়ে গেল ।

সায়ানের এখন খুব মনে পড়ে তার বাবাকে । আমরা ছোটকাল থেকেই বাবার উপর বিরক্তই ছিলাম আর বিরক্ত থাকারই কথা । বাবা সবকিছুতেই শুধু হিসেব খুঁজতো । আমরা তিন ভাইবোন যখন স্কুল কলেজে পড়েছি মেপে মেপে টাকা দিতেন যাওয়া আসার ভাড়া দশটাকা আর টিফিন তিন টাকা মোট তের টাকা । এর থেকে একটাকাও কখনও বেশী দিতেন না । আমরা রাগারাগি করে বলতাম এমন মাইপা টাকাও দাও কেন পথে বিপদ আপদও তো হতে পারে । আব্বা উত্তরে বলতেন, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো আর বিপদ আসার হলে টাকা বেশি থাকলেও আসবে ।তখন আব্বার উপর আমাদের মেজাজ আরও খারাপ হত ।

আবার খেলনা কিনে দেওয়ার সময়ও এমন খেলনা কিনে দিতেন যেন সহজে তা নষ্ট না হয় । আর বেশী দামি খেলনা কখনোই কিনে দিতেন না । একবার মনে আছে বড় ভাইয়া একটা দামি খেলনা গাড়ির জন্য অনেক কান্না করেছিল কিন্তু আব্বা কিনে দেন নাই । আম্মা অনেক রাগারাগি করেছিল আব্বার সাথে । আব্বা বলেছিল যেখানে ওদের সমান বাচ্চারা টাকার অভাবে দুধ খেতে পায় না সেখানে সামান্য মনপ্রশান্তির জন্য এত দামী খেলনা গাড়ী কেনার কোন অর্থ হয় না ।এইসব কথা শুনে আমাদের আরও গা জ্বলতো । কিন্তু আব্বা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন এই কারনে আমাদের আরও রাগ হতো । মনে মনে আব্বারে গালিও ছুড়তাম ।

আমাদের জামা কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল কঠিন হিসেব । দুই সেট জামা তোলা থাকতো বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের জন্য আর পাঁচটা জামা থাকতো পুরো বছর পরার জন্য । আবার জামা ব্যবহারেও যত্নশীল হওয়া বাঞ্চনীয় । তবে জামা ছিঁড়ে গেলে নতুন জামা কিনে দিতেন । আব্বা ছেঁড়া জামা পড়া একদমই পছন্দ করতেন না । তাই আমরাও এর সুবিধা নিতাম ইচ্ছে করে জামা ছিঁড়ে ফেলতাম ।কিন্তু একদিন আপু আব্বার হাতে ধরা খেয়ে গিয়েছিল সেইদিন আমাদের তিন ভাইবোনকে অনেক বকা দিয়েছিলেন । আমরা তিন ভাইবোন একসুরে সারারাত কেঁদেছিলাম । তবে আব্বা কখনো আমাদের গায়ে হাত তুলতেন না ।আর এই বকা খাওয়ার একটা সুফলও ছিল ।পরদিন আব্বা তিনজনকে নিয়ে মিষ্টি দোকানে মিষ্টি খেতে যেতেন ।

তবে আব্বার উপর পরিবারের সবাই বেশী মেজাজ খারাপ করেছিল আপুর বিয়ের সময় । স্বয়ং আপুও অনেক কেঁদেছিল । তখনকার সময় সাধারনত সকল বাবাই চাইতেন পয়সাওয়ালা ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিতে । ছেলে কি করে তা ব্যাপার ছিল না বরং ছেলের আব্বার কি আছে তাই ব্যাপার ছিল । অথচ আব্বা এমন এক ছেলেকে আপুর জন্য ঠিক করলেন যাদের চালচুলো কিছুই নেই । ছেলের যোগ্যতা বলতে আছে শুধু এম এ পাস কয়দিন পর চাকরীতে ঢুকবে ।এই নিয়ে আম্মার সাথেও আব্বার কয়েক দফা রাগারাগি হয় আর গেরামের মানুষও অনেক কানাখোসা করতো । কিন্তু আব্বার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই ছিল না । অন্যের কথায় কান দেওয়ার মত লোক উনি কখনোই ছিলেন না । এমনকি আব্বা কখনো কারো ব্যাপারে বদনামও রটাতেন না যা বলার সামনা সামনিই বলে দিতেন সেটা শুনতে তিতা হোক আর মিঠা হোক । আর তিনিও চাইতেন তাঁর বদনাম আড়ালে না করে তাঁর সামনে যেন করে । আব্বা দ্বিমুখীতা খুবই ঘৃণা করতেন ।এইসব কারনে সমাজে মানুষ আব্বাকে একটু কটু চোখেই দেখতেন । আপুর বিয়ের বিষয়ে আব্বার একটাই যুক্তি ছিল, আমার মেয়ে যার সাথে ঘর করবে তার কি আছে সেটা আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় । ছেলে এখন খারাপ অবস্থানে থাকলেও শিক্ষিত ছেলে যেহেতো সম্মানজনক একটা চাকরি অবশ্যই পাবে । আর আমি যদি পয়সাওয়ালা কোন অশিক্ষিত বেকার ছেলের কাছে আমার মেয়েকে তুলে দেই ওই ছেলে যে সারাজীবন পয়সাওয়ালা থাকবে তার গ্যারান্টি কি ? দশ বছর পরে যদি তার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায় তখন তো তার কামলা খাটা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা । তখন তো আমার মেয়েকে না খেয়ে মরতে হবে ।আর যদি ছেলে শিক্ষিত হয় সে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় সম্মানের সাথে কোন না কোন চাকরি জোগাড় করতে পারবেই । অন্তত মেয়েকে না খেয়ে মরতে হবে না । আম্মা আর আপুর এইসব কথা শুনে গা আরও জ্বালা দিচ্ছে । কিন্তু আব্বার কথা মতই আপুর বিয়ে হয় । একটা আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার হচ্ছে আজ পর্যন্ত আপুর মুখে জামাইয়ের সুনাম ছাড়া কখনো কোন দুর্নাম শুনিনি ।অনেক পরে দুলাভাই থেকে জানতে পারি আব্বা নাকি বিয়ের আগে উনাকে শুধু একটা প্রশ্ন করেছিলেন আর তা হলো তোমার সাথে আমার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিতে চাই তুমি আর কি কি চাও ? দুলাভাই নাকি উত্তর দিয়েছিল আমি শুধু আপনার মেয়েকে চাই আর আমার কোন কিছু লাগবেনা ।আব্বা তার শুধু এই উত্তরটি শুনেই তার কাছে নিজের একমাত্র মেয়েকে তুলে দেন ।

ভাইয়ার বিয়ের পরে শশুর বাড়ি থেকে আমরা তেমন কোন কিছুই পাইনি । এ নিয়ে আমাদের সবার ভেতর মন কালাকালি হতো স্বয়ং আপুও বলতো কি ঘরে ছেলে বিয়ে করাইছেন পুরাই ফকিরনীর জাত । আসলে বড় ভাইয়ের শশুর বাড়ি বড়লোকই কিন্তু অত্যন্ত কৃপন প্রকৃতির । উনাদের কেউ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলেও নাস্তা হিসেবে আনতেন শুধু এক ডজন কলা আর না হয় ডজনখানেক আঁখ শুতলি দিয়ে বাঁধা । অথচ আব্বা কিছুই বলতো না উল্টো আম্মুকে বলতো ভালো করে তাদেরকে সমাদর করতে । কোন এক অজানা কারনে আব্বাকে দেখেছি তিনি কারো কাছ থেকে কোন কিছু আশা করতেন না । তিনি নিজেরটা নিয়ে নিজেই থাকতে চাইতেন ।এমনকি আব্বাকে কখনো কারো কাছে ধার চাইতেও দেখিনি । আব্বা আমাদেরকে বলে একটা জলজ্যান্ত মেয়ে তার প্রিয় পরিবারকে ছেড়ে আমাদের ঘরে এসেছে এর থেকে আর কি কিছু পাওয়ার আছে ? আর আমাদের বিধান মতে মেয়েটির সকল দায়িত্ব তো আমাদের । সে তো আমাদের ঘরেরই সদস্য তাহলে আমরা তার পরিবার থেকে কি চাইবো ?মেয়েটিকে যেহেতো তারা ভরসা করে আমাদের কাছে তুলে দিয়েছে এখন সেই ভরসা রক্ষার দায়িত্বতো আমাদেরই । আমরা কেন তাদের কাছে দায়িত্বের কথা বলবো । ছেলে বৌ হিসেবে আমরা একটা মেয়ে চেয়েছি সেটা আমরা পেয়েছি । এইসব কথা বলে আব্বা আমাদের কখনো খুশি করতে পারেনি উল্টো আমাদের আরও বেশী রাগ হতো আমাদের ।কিন্তু আমাদের কিছুই করার নাই । আব্বার সিদ্ধান্তই ফাইনাল থাকতো ।

আব্বা অবসরে এসেছিলেন দীর্ঘ ৩৫ বছর চাকরি জীবন শেষে । অবসরে আসার কয়েক মাসের মাথায় হঠাৎ তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন ।ডাক্তার বলেন আব্বার নাকি মগজের আংশিক অংশ গলে পানি হয়ে গেছে ।আর এর তেমন কোন চিকিৎসা নেই তবে গলে যাওয়াটা ধীর গতি করার জন্য কিছু ঔষধ নিয়মিত খেতে হবে ।এরপর থেকে আব্বা আর কখনো স্বরুপে ফেরেননি ।সারাক্ষন সবার সাথে উল্টোপাল্টা বকতেন যাকে দেখতেন তার সাথেই কথা বলা শুরু করে দিতেন । কিছু সময় মনে হতো ভালো আছেন আবার কিছু সময় মনে হতো খারাপ । খাওয়াতে হতো অনেক কৌশল করে । আলো ছাড়া থাকতে পারতেন না তাই সবসময়ই আব্বার রুমে লাইট জ্বলতো । পায়খানা প্রশ্রাবের কোন নিয়ম কানুন ছিল না ।সবকিছুই ভুলে যেতেন ।হাঁটতে হাঁটতেই অথবা বসা থাকতেই যেখানে সেখানে টয়লেট করে দিতেন ।জোর করে গোসল করানো লাগতো । কাছের কাউকে চিনতেও কষ্ট হতো আব্বার ।এমনকি আমাদের দিকেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো যেন আমাদের নতুন দেখছে । ঘুম খুবই কম ছিল সারাদিন রাত ঘরে ঘরে পায়চারি করতেন ।রাতভর আব্বার হাঁটার শব্দ না হয় কাশির শব্দ অথবা গ্লাসে পানি ঢালার শব্দ শোনা যেত । কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে আব্বা গ্লাসে শুধু পানি ঢালতেন তা আর খেতেন না । মনে হয় যেন পানি ঢেলেছেন ঠিকই কিন্তু খেতে ভুলে গেছেন । সকালে উঠে দেখতাম সব গ্লাস পানিতে ভর্তি ।পুরো টেবিল পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ।ডাক্তারের কাছে নেওয়া যেত না । অনেক ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে সিএনজিতে উঠাতে হতো আবার ডাক্তার খানার সামনে পৌঁছালে সিএনজি থেকে নামতে চাইতো না । অনেক কসরত করে নামাতে হতো ।আব্বার অসুস্থতার ভারে আমাদের পুরো পরিবারই সারাক্ষন যন্ত্রনায় ভুগতো । এমনও হয়েছে আমরা চাইতাম এইভাবে বেঁচে থাকার চাইতে আব্বা মরে গেলেইতো ভালো ।

আব্বাকে শেষ যেইবার ডাক্তার খানায় নিয়ে এসেছিলাম তিনি তখন অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছিল ।একদিন হসপিটালের বেড থেকে আব্বা আমাকে ডেকে বললেন দেখতো সায়ান পুরো দেওয়ালে এইসব আরবি লেখাগুলো কি ? অথচ আমি দেখছি পুরো দেয়ালই সাদা । আমি আব্বাকে বললাম কই আব্বা এখানে তো কিছু লেখা নেই । আব্বা বলে তুই দেখছিস না তোর চোখে সমস্যা আছে । তখন আবার ডাক্তার এসে আমাকে ডাকলেন তার রুমে । ডাক্তার বললেন, রিপোর্ট দেখে যা মনে হলো আর আশা নেই । উনাকে বাড়ি নিয়ে যান । তারপর আব্বাকে বাড়িতে নিয়ে আসি । বাড়িতে আনার দুইদিনের মাথায় প্রায় দুপুরের সময় আব্বা হঠাৎ অনেক সুস্থভাব দেখালেন । আপুর হাতে অনেক খেলেন ।তারপর সুস্থ মানুষের মত ঘুমাতে গেলেন । আমরা আব্বাকে এমন দেখে অনেক খুশী হয়েছিলাম কিন্তু এটা যে আব্বার সারাজীবনের ঘুম হবে তা বুঝতে পারিনি । আব্বা আর জেগে উঠেননি ।

আব্বার জানাজায় অনেক মানুষ হয়েছিল । জানা অজানা এত মানুষ আসবে তা কখনো কল্পনা করেনি । সবার চোখ দিয়েই পানি পড়েছিল । আব্বা জীবিত থাকাকালীন তেমন কোন মানুষের সাথে আব্বাকে কখনোই দেখিনি কিন্তু জানাজায় এত অচেনা মানুষ কোথা থেকে আসলো তা বুঝতে কষ্ট হয় ।এমনকি মাটি দেওয়া শেষ হওয়ার পরেও আব্বার কবরের কাছে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো । আব্বার বানানো পারিবারিক কবরস্থানে আব্বাই প্রথম পাঁ রাখলেন ।

আজ পনের দিন হয় আব্বা মারা গেছেন ।এই পনের দিনে প্রতিদিন রাতেই আব্বার পায়চারির শব্দ শুনে আসছি । কখনো পাঁয়ের আওয়াজ, কখনো পানি ঢালার আওয়াজ কখনোবা কাশির শব্দ মনে হয় যেন আব্বা এখনো আমাদের ছায়া হয়ে আছেন ।পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যাদের চিন্তা ভাবনাগুলো অন্য সকলের উর্ধে থাকে । যাদেরকে বোঝা অনেক কঠিন । আব্বা সেইরকমই একজন ছিলেন । জীবিত থাকতে আমরা আব্বাকে কখনোই বুঝিনি । আমরা আব্বার অন্তর আত্মাকে কখনোই উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি ।এখন বুঝতে পারি আসলে আমরা কি হারিয়েছি ।আমরা শুধু বাবাকে ভুলভাবেই বিচার করেছি অথচ আব্বা সবকিছুই তো আমাদেরকে দিয়ে গেছেন ।যা করেছেন সবকিছুই তো আমাদের জন্যই করেছেন । আব্বাকে আমরা যেভাবে ভেবেছি আব্বা আসলে সেই রকম ছিলেন না । এখন আমরা যদি হিসেব মেলাতে বসি আব্বার থেকে আমরা সারাজীবন কি পেয়েছি তখন দেখতে পাই আব্বা আমাদের সকল প্রয়োজনই মিটিয়েছেন যা আমরা আগে কখনোই বুঝতাম না । আমরা ভাবতাম আব্বা কৃপণ । অথচ তিনি ছিলেন হিসেবী, মিতব্যয়ী এবং দূরদর্শী একজন মানুষ । যখন যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই করছেন । তিনি আসলে অতিরঞ্জিত কোন কিছুই পছন্দ করতেন না আর আমরা সেটাকে ভাবতাম কৃপণতা ।

এইসব ভাবতে ভাবতে সায়ানের কানে ফজরের আযানের শব্দ আসে । সায়ান বিছানা ছেড়ে উঠে নামাজ পড়তে যায় । নামাজ শেষে বাবার কবরের দিকে যেতেই দেখে ওখানে আম্মা, বড়ভাই আর আপু দাঁড়িয়ে আছে ।আপুও এত ভোরে শশুর বাড়ী থেকে চলে এসেছে ।তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে । তাহলে কি সবার অবস্থা আমার মতই ? বাড়িতে আসার পথে বাবার পুরনো বন্ধু আক্কাছ চাচার সাথে দেখা হয় আমাদের । চাচা আমাদেরকে বলে তোমাগো আব্বারে তো রাতে স্বপ্নে দেখছি । বড় ভাই জিজ্ঞেস করে কি দেখেছেন চাচা ? চাচা বলে আমি তোমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করি, কিরে দবির কেমন আছোছ? তোমার আব্বা হাসি দিয়ে বলে, আমি তো খুব ভালো আছি তোদের কি খবর ? তখনই ঘুমটা ভেঙ্গে যায় ।

স্বপ্নের কথা শুনে সবার অন্তর অপরাধীর মত হোঁ হোঁ করে কেঁদে উঠে….




সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ২:১৫
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×