দেশের বাইরে থেকে ব্লগ লিখি কথা ঠিক আছে, কিন্তু শয়নে স্বপনে প্রতি নিয়ত দেশটার কথাই ভাবি। এটা কিন্তু এই জন্য না যে আমি খুব বড় মাপের মানুষ, আর খুব যে দেশপ্রেম থেকে কথাটা বললাম তাও কিন্ত নয়। আমি দেশ ভালোবাসি কারণ এই দেশেই রেখে এসেছি আমার শিকড়, আমার ভালোবাসা, ফেলে আসা লাল-নীল সংসার আর আমার অতি আপনজনদের। জীবন ঘিরে, জীবনকে নিয়ে আমার সংগাগুলি অত্যন্ত সরল আর খুবই সাধারন। পেশাগত কারনে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশে গিয়েছি, দেখেছি তাদের যাপিত জীবন। সেই অভিগ্গতা থেকে আমার প্রায়ই কিছু সরল সোজা কথা মাথায় আসে। এই কথাগুলো শুধু আমাদের বিগত কয়েক বছরের তথ্য উপাত্ত অথবা কোন জরীপ এর ফলাফল নয়। বরং বলা যেতে পারে দেশ নিয়ে আমার হাস্যকর একটা হাইপোথিসিস।
খুব ছোটোবেলায় দেখতাম, শীত এলে পাড়ায় মহল্লায় কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলার মরশুম শুরু হতো। সাধারণত এলাকার বড়ভাইরা থাকতেন কোর্ট কাটা থেকে শুরু করে আলোকসজ্জা, বৈদ্যুতিক সংযোগসহ জটিল কর্ম গুলোর জামিনদার। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পর ঐ কোর্ট গুলোতে খেলার সুযোগ না পেলেও পড়ন্ত দুপুর থেকে সন্ধ্যা অব্দি তা থাকত আমাদের মত ক্লাস ফোর-ফাইভ বয়স গ্রুপের ছেলে মেয়েদের হাতে । সেইসময়ে একটা ভালো স্টেইনলেস স্টীল এর র্যাকেট যার হাতে ছিলো, তার ছিলো রাজপুত্রের স্ট্যাটাস। কারন বাদবাকি সবার ছিলো কাঠের অতি সাধারন মানের কমদামি র্যাকেট। পড়াশুনায় ভালো থাকার সুবাদে দ্বিবার্ষিক পরীক্ষার পর বাবা কিনে দিলেন একটা স্টেইনলেস স্টীল এর র্যাকেট। সকলের ঈর্ষার পাত্র হয়ে বড়জোড় ৩ দিন খেলতে পারলাম ঐ বস্তু দিয়ে। এলাকার সমবয়সী "লোকাল" এক ছেলেকে খেলতে না দেয়ার অপরাধে ঐ ছেলে আমার অমুল্য র্যাকেট মাটিতে পা দিয়ে দাবিয়ে ধরে ভেংগে দিলো। প্রতিবাদ করতে গেলে শারিরীক লান্ছনার শিকার হলাম। জীবনে প্রথম পরিচয় পেলাম, ভিন্ন নতুন এক জগৎবাসীর সংগে। খেয়াল করে দেখলাম এরা আমাদের আশে পাশেই থাকে, এদের বাবা চাচা মামা খালুরা আমাদের বাবা চাচা মামা খালু দের সাথেই চা এর দোকানে আড্ডা দেন অথবা ব্যবসা বানিজ্য করেন। আমার টিনটিন-চাচা চৌধুরী কমিকস, সত্যজিৎ রায় রকিব হাসান এর গল্পের বই, রেনবো থেকে রেকর্ড করে আনা আনকোরা টি ডি কে ক্যাসেট এর গান - এসব কিছু দিয়ে গড়া স্বপ্নের জগৎ টা মুহুর্তের মাঝেই ভেংগে চৌচির। অবাক হয়ে দেখতাম, বড়দের কাছে নালিশ জানালে উলটো নিজেরাই দোষী সাব্যস্ত হতাম এই বলে, " আর তো কারও কিছু হলোনা, খালি তোমাকেই পায় ওরা ?" কথা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ মনে হওয়ায় আর আগে পিছে কিছু না বলে লেজ গুটানো পরাজিত কুকুরের মত পিছিয়ে এলাম। এরপরে আর কোনদিন ঐ ছেলেদের সাথে সামনাসামনি মোকাবেলার সুযোগ আর অবস্থা কোনদিনই আসেনি। কিন্তু আমি কেন জানি ওদেরকে চিনে রাখলাম। না রাখলেই মনে হয় শান্তিতে থাকতাম। এরপর যত দিনএগিয়ে গেলো, ওরা আর আমরা বড় হতে লাগলাম যেন দুটি প্যরালাল জগৎ এর মধ্যে। স্কুল জীবনে নিজে খুব যে ধোয়া তুলসী ছিলাম বলবো না। কিন্তু কখনই ওদের মত অন্যের টিফিন কেড়ে নেয়া, ভাল একটা গল্পের বই অথবা কলম মেরে দেয়া বা স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখার জন্য নিরীহ ছাত্রদের উপর চাঁদাবাজী করিনি। ছেলে হিসাবে বোধহয় একটু হাবা ধরনেরই ছিলাম, বোতাম টিপ দিলে যে চাকুর ফলা আপনা থেকে বের হয় ঐ টেকনোলজী ওদের কাছেই প্রথম দেখলাম ক্লাস এইট এ উঠার পর। একই ধারাবাহিকতায় ওদের কাছেই দেখলাম পর্ণ ম্যাগাজিন, ফেন্সিডিল এর বোতল, এক্স-রেটেড বই সহ অনেক 'আধুনিক' উপাদান। স্কুলের গন্ডী ছাড়িয়ে কলেজে উঠার পর বিপ্লবী ঐ বাহিনীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হারাই।কারণ আমার স্কুলটি সরকারী হলেও কলেজটি ছিলো দেশের একটি খ্যাতনামা কলেজ। কলেজে দেখা না হলেও ওদেরকে এলাকায় দেখতাম। দেখতাম ওদের মোড়ের দোকানে চিরস্থায়ী বাকীতে বিড়ি-সিগারেট নেয়া, এলাকায় নতুন কোন ভাড়াটিয়া এলে কার কয়টা স্কুল কলেজগামী মেয়ে রয়েছে তা খুঁজে বের করা ও স্কুল কলেজ যাবার পথে ওদের উত্যক্ত করা, শবে বরাতের সন্ধ্যায় পটকাবাজী, ঈদের দিনে রাস্তায় অস্থায়ী দোকান করে এলাকায় আগত নতুন মানুষজনকে তাদের দোকানের সামগ্রী গলাকাটা দাম এ কিনতে বাধ্য করার মত অজস্র ছোট এবং বড় ঘটনা। এইচ এস সির পর এলাকা ছেড়ে চলে যাই।
বহুবছর পর কোন এক ঘটনার প্রেক্ষিতে ফিরে যাই আমার শৈশবের সেই বহুপুরাতন এলাকাটিতে। সবকিছু অনেক পরিবর্তিত, অনেক আধুনিক। স্মৃতিতে থাকা আগের ছেলেবেলার পাড়াটির সাথে মিল পেলাম যৎসামান্যই। একদিন সিগারেট টানার সময় পাড়ার মুরুব্বীদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার জন্য বাসা থেকে বেশ দুরে দাঁড়িয়ে আছি। কাছেই রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সিমেন্ট বালি মেশানোর কাজে শ্রমিকদল ব্যবহার করছে নর্দমার পানি, ম্যানহোল থেকে পাইপ দিয়ে সরাসরি তা চলে যাচ্ছে মিকচার মেশিনের মধ্যে। বাঁধা দেয়ার জন্য এগিয়ে যাবো কিনা ভাবনা চিন্তা করছি, এর মাঝেই উপস্থিত হলেন ঐ কাজের লোকাল কনট্রাকটার। দেখেই চিনতে পারলাম আর কেন যেন খুব অবাকও হলাম না। খুব স্বাভাবিক ভাবে সিগারেট শেষ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম।কারন, আমার রক্তে মিশে আছে ওদেরকে সহ্য করে যাওয়ার বীজ। আমাদের বড়রা আমাকে এভাবেই বুঝতে শিখিয়েছেন যে,
"ওরা যাই করুক না কেন, আমরা আমজনতা কিছু করার ক্ষমতা রাখিনা। আমরা শুধু দেখে যাবো কিভাবে আমাদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রু, মৌলিক চাহিদা গুলো ওদের মাধ্যমে লুন্ঠিত হবে, টার্মিনালের চাঁদাবাজী, কালোবাজারী সবকিছুই ওরা করে যাবে----আমরা খালি দেখবো, কিছু বলতে বা করতে যাবোনা। আমাদের যে কারও সাতে পাঁচে থাকতে নেই" !!!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৫০