খুব মিস করি ছেলেবেলা। ঠিকমতো বলা গেল না কথাটা। আসলে ছেলেবেলার একটা বিশেষ অংশই বোধহয় বোঝাতে চাচ্ছি। সেই ৯২ বা তার ২/১ বছর আগে পরে হবে সময়টা। যেহেতু আমার জন্ম জানুয়ারীর শেষের দিকটায়, প্রত্যেক বছর শীতকালটা আসলেই বয়সে জুড়ে যেত একটা বছর, যেন নতুন একটা পালক। শীতের আমেজটা মাখানো থাকতো জীবনে চলে আসা অনেকগুলো নতুন ভালোলাগায়, প্রতিটি বিকেলই মনের মধ্যে বাজিয়ে যেত এক নতুন সুর। বিকেলের হালকা মরে আসা তেরছা আলোটা দেখে ১২/১৩ বয়সী আমি পুলকিত হতাম খুব। শীতের ঐ রোদটার মধ্যে একটা জাদুকরী আকর্ষন থাকতো।স্কুল থেকে ফিরে মায়ের হাজার বকুনি উপেক্ষা করে কিভাবে যেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতাম। ঘড়িতে তখন আর কয়টা, বড়জোর পৌনে চার বা চার। বিকেলের আলোটা কিন্তু তার সেই নিদ্রালু সোনালী আভা নিয়ে কানে কানে বলে যাচ্ছে, "আয় বাছা....আয়"। সারাটা বিকেল দাবড়ে বেড়িয়ে মাগরিবের আজান শুনে ঘরে ফেরা পাখির মত হাত পা ধুয়ে যখন পড়তে বসতাম , আফ্রিকার কোন উপকূলে রয়েছে টিনের খনি, বার্ষিক গতি কি, বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল অথবা ইসলামিয়াত বইয়ের কোন একটা চ্যাপটার। পাড়ার বড়ভাইরা ততক্ষনে জ্বেলে দিয়েছে ব্যাডমিন্টন কোর্ট এর সবগুলো বাতি। তাদের হইচই, রংগীন পোষাক পরা ঝালমুড়ি ওয়ালার ফানেল আকৃতির চোং থেকে আসা "চা..না..চ্চু..রররররররর" হাঁক, হিন্দুবাড়ি থেকে আসা ধুপ ধুয়োর গন্ধ, কাঁচা চুলায় বসানো লাকড়ী পোড়ার গন্ধ , চটপটিওলার চার চাকার গাড়িতে বসানো হ্যাজাক বাতির কেরোসিন পোড়া গন্ধ, পিঠাওলার ভাপ ওঠা ভাপা পিঠার গন্ধ, বাজারে নতুন ওঠা টমেটো বাঁধাকপি দিয়ে করা রুই মাছের তরকারির গন্ধ সব মিলে শীতের সেই সন্ধ্যাগুলোকে মনে হতো অচেনা একটা উৎসবের মতো। শীতের হিমহিম ভাবটা অনুভব করতাম সাদা কভার দেয়া লেপের মধ্যে মুড়ি দিয়ে শুয়ে, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আরামদায়ক একটা আলস্যে দুচোখ বেয়ে নেমে আসতো শান্তির ঘুম। দিন গুলো ছিলো কেমন শান্তিতে ভরা, ভাবনাহীন। কত সহজ ছিল জীবন, কত নির্লোভ ছিলো মন, কত নির্মোহ ছিলাম মানুষ হিসাবে।
আজ এতদিন পরে কেন জানি সরলসুখের সেই দিন গুলোর কথা মনে পড়ে। সেই দিন গুলো কেন জানি অন্য এক পৃথিবীর বলে মনে হয়। কত বদলে গেছি তাও ভাবি। কোন এক জাদুবলে কেমন করে জানি একদিন একটা লোভী, পরশ্রীকাতর, স্বার্থপর একটা জন্তু বাসা বাঁধলো নিজের মধ্যে। জন্তুটা আমাকে নাচায়.....আমি নাচি। জন্তু আমাকে বলে, টাকা..টাকা...শুধুই টাকা.....শুধু ছুটে চলা...বস্তুবাদী অন্তবিহীন এক অজানার উদ্দেশ্যে। আমার ফেলে আসা ছেলেবেলার সেই ছোট্ট আমি টি যা যা ঘৃনা করতাম, যেসব থেকে দুরে থাকার জন্য প্রতিগ্ঝাবদ্ধ ছিলাম, দিনে দিনে কেমন করে জানি সেই সেই সমস্ত কিছুই জুড়ে গেলো এই জীবনে। ইদানিং খুব ভ্য় হয়, পথ হারিয়ে যদি কোনভাবে সেই ছোট্ট আমিটা আমার সামনে চলে আসে ! ঘৃনাভরে একদলা থু থু ছিটিয়ে যদি বলে ওঠে....."ছি: ....."
কেউ কি বলতে পারেন ? আমাদের ভালো সময়গুলো কোথায় চলে যায় ? কোথায় গিয়ে জমা হয় সোনালী সেই সময়গুলো ???
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:২২