somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাউলের ঘর নয় এ যেন বাংগালীর সংস্কৃতি পোড়ানো।

২১ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাউল রনেশ ঠাকুরের কায়া টা ঠিকঠাক থাকলে অন্তর পুইরা আঙ্গার হইয়া গেছে। বাউল রনেশ ঠাকুর বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম শিষ্য। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজান ধল গ্রামে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের পাশের বাড়ী ই রনেশ ঠাকুরের। উজান ধল গ্রাম আজ দেশ বিদেশে অনেকের কাছে পরিচিত ও প্রিয় একটি গ্রাম শুধু মাত্র বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জন্যই। অনেক বাউল শিল্পীদের কছে এই উজান ধল গ্রাম একটি তীর্থস্থান ও বটে। গত রোরবার অর্থাৎ ১৭ মে গভীররাতে কে বা কারা বাউল রনেশ ঠাকুরের বাড়ীর গানের ঘরটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বনিয়ে দেয় । এই ঘরের দীক্ষা নিতেন দূরদূরান্ত থেকে আসা রনেশ ঠাকুরের বাউল ভক্ত ও শিষ্যরা। এখনেই থাকতো রনেশে ঠাকুরের বাউল গানে ব্যবহৃত সকল বাদ্যযন্ত্র ও গানের খাতা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে জীবনের অনেক ত্যাগের বিনিময় আগলে রেখেছিলেন এই ঘর খানা আর এই বাদ্যযন্ত্র ও গানের খাতা গুলিকে। এই ঘড়ে বাউল রনেশের বাবা বাউল রবনী মোহন চক্রবর্তী ও গানের চর্চা ও তালিম দিয়েছেন তার শিষ্যদের। বাউল রনেশের বাবা রবনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন ভাটি অঞ্চলের একজন পরিচিত কীর্তনীয়া। রবনী মোহন চক্রবর্তীর দুই ছেলে রনেশ ঠাকুর আর রুহি ঠাকুর দুই জনই ছিলেন বাউল শাহ আব্দুল করিমের শিষ্য শুধু শিষ্য বলে ভুল হবে ছিলেন পুত্র সমতুল্য । তাই গানের পরিবেশেই বেড়ে উঠা রনেশ ঠাকুর ও রুহি ঠাকুর সারাজীবনই শুদ্ধভাবে গেয়েছেন শাহ আব্দুল করিমের গান। রুহি ঠাকুর আজ আর বেঁচে নেই। তবে রণেশ ঠাকুর এখনও ভাটি অঞ্চলে গেয়ে চলেছেন শাহ আব্দুল করিম ও নিজের লেখা গান।
আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য যখন সব হারাতে বসেছি তার মধ্যে ও যুগ যুগ ধরে নানান ত্যাগের তিতিক্ষার মধ্যে বাউলেরা টিকিয়ে রেখেছেন আমাদের বাউল ঐতিহ্য কে। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন। বৈষ্ণববাদ এবং সূফীবাদের প্রভাবিত বাউল সম্প্রদায় । বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। সাধারণত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেন । তাই ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। তার পর ও কেন শকুনের কালো থাবা বার বার আঘাত করে আসছে আমাদের ক্রিস্টি ও সংস্কৃতিকে। এর আগে ২০১৬ সালে আমারা নরকীয় তান্ডব দেখেছি ব্রাহ্মনবাড়িয়া। মোবাইল ফোন কেনাকে কেন্দ্রকরে দোকানিদের সাথে সহিংসতা নিহত সহপাঠীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তান্ডব চালিয়ে আগুনে পুরিয়ে দেয় সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ও জাদুঘর। আগুনে পুরে ছাই হয়ে যায় খ্যাতনামা এই সুরসাধকের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, তাঁর লেখা চিঠি ও দুর্লভ ছবি। ২০১৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নিয়াজ মুহম্মদ স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত উন্নয়ন মেলার মঞ্চে বাউল শিল্পী শামসুল হক চিশতি ওরফে চিশতি বাউলের উপর হামলা করে উগ্র স্হানীয় মাদ্রাসার ছাত্ররা।
২০১০ সালে ও শাহ আব্দুল করিমের বাড়িতে হামলা হয়েছিল শুধু এই বাউল গানের জন্য। শাহ আব্দুল করিমকে শুধু মাত্র এই গানের জন্যই এলাকা ছাড়া করেছিল তৎকালীন ধর্মীয় উগ্রসম্প্রদায়। রাজবাড়ীর পাংশায় আমারা দেখছি ধর্মের নামে অধর্মের কাহিনী। স্হানীয় মসজিদের ইমাম মুফতি রিয়াজ নেতৃত্বে কয়েক এলাকার উস্কে দেওয়া মুসল্লীরা তওবা পড়ানোর নাম করে ২৮ লালান ভক্ত বাউলকে ধরে নিয়ে এলোমেল করে চুল দাড়ি কেটে দেয়। যশোহরে কুপিয়ে হত্যকরা হয় বাউল শিল্পীকে। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া তে লালনের আখড়ায় ও হামলার দৃশ্য আমরা দেখেছি। এসব প্রত্যেক ঘটনার প্রতিবাদেই রাস্তায় নেমে এসেছে আমাদের সাংস্কৃতি মনা প্রগতিশীল সমাজ প্রতিবাদ করেছে ক্ষোভ জানিয়েছে কিন্তু সেই ক্ষোভ আর প্রতিবাদ কখনোই আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের দৃষ্টিগোচর হয় নি। বরং কিছু দিন আগেই ধর্ম অবমাননার অযুহাতে ডিটজিটাল নিরপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল টাঙ্গাইলের বাউলশিল্পী শরিয়ত বয়াতিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময় অবশ্য সংসদে বলেছিলেন, বাউল ঐতিহ্য যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। চুল কাটা বা বাউলদের প্রতি যেকোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য নয় বলেমও জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কথার জায়গায় কথা থাকে কাজের বেলায় উল্টা।
বাউলরা ও একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তারা প্রগতিশীল ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং কুসংস্কার থেকে অনেক দুরে তাই কোন প্রচলিত ধর্মে ই তাদের স্হান হয় নি। বাউলদের ভাবতত্ত্ব গান অনেক সময় ধর্মীয় গোঁড়ামী মুখোশ উন্মোচন করতে স্বার্থক বলেই সব সময় ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীদের আক্রমনের শিকার আমাদের বাউল সম্প্রদায় । তারা কোন জাত ধর্মের সংস্পর্শে নাই তাইতো ফকির লালন শাই বলে ছিলেন, " সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন কয় জাতের কি রূপ আমি দেখলাম না দুই নজরে। " তাইতো আমারে দেখেছি ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বিনা বাধায় বিমানবন্দরের প্রবেশপথের লালন ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছিল। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্হায় অস্প্রদায়িক চেতনার কথা উল্লেখ থাকলে ও তা শুধুই মাত্র কাগজে কলমে। তাই যদি না হত এত অঘটনের পর ও কি ভাবে একজন বাউল শিল্পীর চিরকালের আশা আকাংখা মুহুর্তে ই জ্বালিয়ে পুরিয়ে ছাই করে দিতে পারে? এর আগে ও ২০১৩ সালে ৫ মে আমরা দেখেছি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নারকীয় তান্ডব। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানুল কারিম ও তাদের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। ইসলাম ধর্মকে রক্ষার নাম করে তারা পবিত্র কোরানুল কারিমকে আগুন পোড়াতে কুন্ঠাবোধ করে নি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন যারা নিজেদের হীনস্বার্থ হীনমতবাদ রক্ষায় পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে আগুন দিতে পারে তাদের কাছে বাউল রনেশ ঠাকুরের গানের ঘড়ে আগুন দেওয়া তো সাধারন ব্যাপার। আমরা মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা প্রানী হিসেবে আল্লাহ আমাদের এই দুনিয়ার প্রেরন করেছেন জাত ধর্ম বর্নের উর্দ্ধে উঠে এটাই আমাদের আসল পরিচয়। তার পর ও আমরা নানা ভাগে বিভক্ত। কেউ কারো মতবাদ বা বিশ্বাসের ভিন্নতা পোষণ করলে চলে চাপাতির কোপ। তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন কেন বার বার আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি ? ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আজো সত্যিকারের মানবিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এসেও আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনায় গড়েতুলতে ব্যর্থ। এর জন্য তথাকথিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নিলজ্জ ক্ষমতার লোভ ক্ষমতার স্বার্থে বার বার ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সাথে আতাত ই মুল কারন।
যদি আমাদের দেশে সত্যিকারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তা হলে অবশ্যই আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেদিন ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা করতেও কেউ আর সাহস পাবে না। রনেশ ঠাকুরদের স্বপ্নে আর কেউ আগুন দিতে সাহস পাবে না।




৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×