প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট এর " বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে " এই শিরোনামের প্রতিবেদন টি পড়ে নিজের শরীরের নিজেই হাত বুলিয়ে দেখে নিলাম সুস্হ্য আছি কি না! আইসিডিডিআর,বি’র কর্মকর্তা জন ক্লেমেনস এর উদ্বৃত্ত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে শুধু মাত্র আমাদের ঢাকার শহরেই নাকি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখের বেশি। যদি ঢাকাতেই এমনটি হয় তা হলে সারা বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত কত তার হিসেব মিলানো খুবই কঠিন। তবে আমাদের সরকারী হিসেবে আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্য পুরোপুরি ভিন্ন । ৯ জুনের সরকারী হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭১ হাজার ৬ শত ৭৫ জন আর মৃত্যের সংখ্যা ৯৭৫। আমাদের এই সরকারী হিসাব নিয়ে যদি ও অনেকের মনেই নানান প্রশ্ন আছে। আর এই প্রশ্ন আসা টা ও অস্বাভাবিক । আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্হ্য বিভাগে যে কি হতে পারে আর কি হতে পারে না তার আসল ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখছি দেশে করোনার থাবায়।
গত ডিসেম্বরে শেষে চায়নার উহানে প্রথম কারোনা রোগীর সনাক্তের মাত্র কিছু দিন পর ই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষনা করে । এর পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের সাধ্যমত নৈতিকতার সাথে করোনা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। আমাদের সংবাদমাধ্যম গুলি করোনার ব্যাপারে শুরু থেকেই সজাগ। তবে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকেরা করোনাকে মোটে ও গুরুত্বের সাথে নেয় নি। বরং তাদের কথা দেশের সাধারন মানুষে কছে হাঁসির খোরাকে পরিনত হয়েছে আর চিন্তাশীল মানুষদের চিন্তা অনেক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। যদি এ সব বিষয় নিয়ে অনেক তর্ক বির্তক সমালোচনা হয়ছে এবং হচ্ছে। প্রতিদিন ই নতুন নতুন কাহিনী জন্ম নিচ্ছে আমাদের স্বাস্হ্য খাতে। অনেকই বলছেন যা হবার তা তো হয়েই গেছে তা নিয়ে সময় অপচয় করে লাভ কি বরং ভবিষ্যতে কিভাবে এর সমাধান করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনাই উত্তম। যারাই এমনটি বলছেন আমার দৃষ্টিতে তারা পেছনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অঘটন, দুর্নীতি দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের অবহেলাকে ই ধামাচাপা দিতে চাচ্ছেন। এই তো সেই দিন ও দেশের কয়েকটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে। চলমান এই বৈশ্বিক মহা মানবিক দুর্যোগের সময় যেখানে চিকিৎসা সেবাকে প্রতিটি জনগনের জন্য সহজ ও গ্রহনযোগ্য করে তোলা উচিত সেখানে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতির মহোৎসব লিপ্ত। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া " করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি সহায়তা " প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সেফটি গগলস কেনা হবে। প্রতিটি সেফটি গগলসের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে প্রতিটি সেফটি গগলস বিক্রি হচ্ছে পাঁচশত থেকে এক হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই কেনা হবে। যার প্রতিটির জন্য খরচ ধরা হয়েছে চার হাজার ৭০০ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব শর্ত মেনে ওষুধ অধিদপ্তরের সব শর্ত অনুসরণ করে বিভিন্ন কম্পানির তৈরি ভালো মানের পিপিই বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় ৭৬ হাজার ৬০০ জোড়া বুট শু কেনা হবে। প্রতিটি শুর খরচ দেখানো হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। দেশে বর্তমান বাজারে বুট শু ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় মিলছে। এর আগে এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে কি নিলজ্জ কান্ডই না করলো আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ।
করোনা মোকাবেলায় যথেষ্ট সময় পাওয়ার পর ও আমাদের কর্তাব্যক্তিদের তথাকথিত যথেষ্ট প্রস্তুতি আমরা যা দেখেছি এর বোঝা আমাদের কত দিন বইতে হবে তা বিধাতাই ভাল জানেন । করোনার চেয়ে আমাদের শক্তিশালী ভেবে ও করোনার কাছে ধরাসাই হয়ে অনেক চিকিৎসক চিকিৎসা কর্মী পুলিশ শিক্ষক শিল্পপতি সহ অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরন করছেন আবার কেউ কেউ করোনার হাত থেকে জীবন রক্ষার জন্য বিমান ভাড়া করে গোপনে দেশ ত্যাগ ও করেছেন। করোনা যুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিক আমাদের ডাক্তার নার্স সহ সকল স্বাস্হ্য কর্মীরা যথাযথ পিপিই অভাবে আজো চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। আবার স্বাস্হ্য খাতে কারো কারো দায়িত্ব অবহেলায় কারনে হাসপাতালে পর হাসপাতাল ঘুরে ও বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু বরন করতে করতে হয়েছে অনেক অভাগা বাংলাদেশীকে। আজো দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগী নির্নয়ে পরীক্ষার তেমন কোন ব্যবস্হা করা হয় নি। দিনের পর দিন লাইনে থেকে ও পীরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে বাড়ী ফিরে করোনা উপসর্গ নিয়েই মরতে হচ্ছে। আর যারা ও পরীক্ষা করাতে সক্ষম হয়েছেন তাদের রিপোর্ট ও অনেকে যথাসময়ে হাতে পানি আবার একই ব্যক্তির ই দুই রকম রিপোর্টের কথাও আমরা সংবাদমাধ্যম দেখেছি। এর মাঝে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গনস্বাস্হ্যের কিট নিয়ে কি না নাস্তানাবুদ অবস্হা দেখলাম।
আমাদের দেশে গত মার্চের ৮ তারিখে প্রথম করোনা রোগী সনাক্তের পর সরকার খুব দ্রুতই করোনা প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্হা মানুষকে ঘরে রাখা সেই ব্যবস্হার দিকে এগিয়েছিলেন। তবে সেখানে ও একটা বড় ভুল হয়ে গেছে ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস থেকেই শুরু হয় করোনার মোকাবেলার সেই বন্ধ সরকার এটা কে সাধারন ছুটি ঘোষনা করায় আমাদের সাধারন মানুষ ও তা সাধারন ভাবে নিয়ে বেরিয়ে পরে প্রমোদ ভ্রমণে। এই প্রমোদ ভ্রমণ ঠেকাতে সরকার হুটকরে গনপরিবহন বন্ধকরে ভ্রমান পিপাসুদের মাছ সব্জি বা ফলের ট্রাকে বাড়ী ফেরার ব্যবস্হা করলেন। যাই হউক তখনও দেশে করোনার পরস্হিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। এর পর আমারা পোশাক শিল্পের মালিকদের কান্ডও দেখলাম। গাজীপুরের পুলিশ সুপার তো তার এলাকায় করোনা বিস্তারের জন্য পোশাক শিল্পের মালিকদের উপর ই দোষ চাপিয়েছিলেন। অবশ্য ওরা চাপানো বললে ভুল হবে সত্যিই বলেছিলেন। পোকাশ শিল্পের মালিকরা অনেক তালবাহানা করে সরকারের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা হাসিল করে এখন আবার তারা শ্রমিক ছাটাইয়ের হুংকার দিচ্ছেন। যা সত্যিকারে আমাদের দেশ ও দেশের অর্থনীতির জন্য অশিন সংকেত। সরকার করোনা রোধে মানুষকে ঘরের রাখার যে দীর্ঘ ছুটি দিয়েছিলেন তা যদি ও ছিল যথাযথ পদক্ষেপ তার পর পেটের ক্ষুধায় কি মৃত্যুকে ভয় করে ঘরে থাকা যায়? আমাদের কর্মজীবী মানুষ পেটের জ্বালায় রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে। সরকার যতটুকু ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তার অধিকাংশই চুরি করে তাদের দলীয় নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের পকেট ভরতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। ত্রান সহযোগিতা নামে চললো হরিলুটের মহোৎসব।
মাদারীপুরে শিবচরের কথা আমাদের মনে আছে ওখানে যখন বেশ কিছু করোনা রোগী সনাক্ত হলো সাথে সাথে স্হানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা মিলে বেশ কিছু এলকার লোকচলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। আমার জানা মতে শিবচরের করোনা পরস্হিতি মোটানুটি ভাল পর্যায়েই আছে। নারায়নগঞ্জে একের পর এক করোনা রোগী যখন সনাক্ত হতে শুরু করলো তখন নারায়নগঞ্জের মেয়র কঠোর ব্যবস্হা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন। তার সেই কথায় সরকার তেমন কর্নপাত না করায় নারায়ণগঞ্জের পাশ্ববর্তী জেলা গুলিতে ও আজ করোনা ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পরেছে। আজ শুধু ঢাকা নারায়ণগঞ্জ বা তার আশেপাশে ই না টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সমগ্র বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত। কক্সবাজার শহরকে রেডজোন ঘোষনা করে ইতো মধ্যে আবার ও লকডাউন ঘোষনা করেছে স্হানীয় প্রশাসন। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা। ঠিক এমন সময় ই তথাকথিত সীমিত পরিসরে সাধারন ছুটি তুলে নিয়ে সব কিছু খুলে দিতে হলো সরকারকে। আর না খুলেই বা উপায় কি? আমাদের রাজনীতির অতিউৎসাহীরা দেশের অর্থনীতি নিয়ে যাই বলুক সাধারন মানুষ ভাল ভাবেই বুঝেন তথাকথিত কিছু রাজনীতিজীবি ও তাদের আশেপাশে থাকা চোর চাটুকারদের ছাড়া এ দেশের সাধারন মানুষের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয় নাই। তাই তাদেরকে জীবন বাজি রেখেই খেটে খেতে হবে। জীবিকার প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে সাধারন মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। সরকার এখন মহামরি ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকাকে তিনটি জোনে ভাগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত এলাকা গুলি নতুন করে লকডাউনের আওতায় আনা শুরু করেছেন সরকার। জানিনা সরকারের এই পরিকল্পনা ই বা কত টুকু কর্যকর হবে? তবে বিক্ষিপ্ত এলাকা ভিত্তিক লকডাউন করোনা প্রতিরোধে মনে হয় না তেমন কোনো সুফল বয়ে আনবে।
সরকারকে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে যেই ভাবেই হউক প্রথত মানুষকে পুরোপুরি স্বাস্থ্য বিধি মানতে বাধ্যকরতে হবে। এর পর ও যদি মানুষকে জীবন রক্ষায় ঘরে রাখতে হয় তা হলে ঘরে রাখার রসদের ব্যবস্হা করতে হবে। শুধু আইন প্রনয়ন কারেই নয় আইনের যথাযত প্রয়োগ করতে হবে। স্বভাবসুলভ ভাবেই মানুষ আইন ভাংগতে পছন্দ করে। তাই আইন মানার জন্য সেনাবাহিনীকে যথাযথ ক্ষমতা দিয়ে কিছু দিনের জন্য রাস্তায় নামাতে হবে। কারন আমাদের সাধারন মানুষের একটি বড় আস্হার জায়গা এখনো আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই করোনার এই ভয়াবহ থাপা থেকে দেশের মানুষ জীবন ও অর্থনীতিকে রক্ষাকরতে হলে অবশ্যই সরকার কে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্হা গ্রহন করতে পারলেই এই বৈশ্বিক বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।