১. মেহমান আসলে আনন্দ ও বন্ধুত্ব প্রকাশ করবে আর অত্যন্ত সন্তুষ্টির সাথে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে, সংকীর্ণমনা, অবহেলা, অন্যমনষ্কতা ও বিষন্নতা প্রকাশ করবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তারা যেন তাদের মেহমানের আতিথেয়তা যথোপযুক্তভাবে সম্পন্ন করে।
(বুখারী, মুসলিম)
রাসূল (সাঃ)-এর নিকট যখন কোন সম্মানিত মেহমান আসতেন তখন তিনি নিজেই তার আতিথেয়তা করতেন।
রাসূল (সাঃ) যখন মেহমানকে নিজের দস্তরখানে খাবার খাওয়াতেন তখন বারবার বলতেন, “আরো খান, আরো খান”। মেহমান যখন পরিতৃপ্ত হয়ে যেতেন এবং আর খেতে অস্বীকার করতেন কেবল তখনই তিনি বিরত হতেন।
২. মেহমান আসার পর সর্বপ্রথম সালাম ও দোআ করবে এবং কুশলাদি জেনে নেবে।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
“আপনার নিকট কি ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্মানিত মেহমানদের কাহিনী পৌঁছেছে? তারা যখন তাঁর নিকট আসল তখন আসা মাত্রই সালাম দিল, ইবরাহীম (আঃ) সালামের উত্তর দিলেন”।
৩. অন্তর খুলে মেহমানের আতিথেয়তা করবে আর যথাসাধ্য উত্তম বস্তু পরিবেশন করবে। হযরত ইবরাহিম (আঃ)-এর মেহমান আসলে ইবরাহিম (আঃ) সত্ত্বর তাদের পানাহারের বন্দোবস্তে লেগে যেতেন এবং ভাল ভাল খাদ্য মেহমানদের সামনে পরিবেশন করতেন।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
তখন ঘরে গিয়ে এক মোটা তাজা গোশাবক (যবেহ করে ভাজি করে) তাদের সামনে পেশ করলেন।
(সূরা যারিয়াহ)
আরবি
এর অর্থ ইহাও যে, তিনি গোপনে ঘরে মেহমানদের আতিথেয়তার ব্যবস্থার জন্য চলে গেলেন, কেননা, মেহমানদের দেখিয়ে ও সংবাদ দিয়ে এদের পানাহার ও আহিথেয়তার জন্য পরিশ্রম করলে তা লজ্জা ও মেজবানের কষ্টের কারণে নিষেধ করবেন এবং পছন্দ করবে না যে, মেজবান তাদের কারণে অসাধারণ কষ্ট করবে। অতঃপর মেজবানের জন্য ইচ্ছামত আতিথেয়তা করার সুযোগ হবেন।
রাসূল (সাঃ) মেহমানের আতিথেয়তার ব্যাপারে যেভাবে উৎসাহিত করেছেন তার চিত্র তুলে ধরে হযরত আবু শোরাহই (রাঃ) বলেছেন-
“আমার এ দুটি চোখ দেখেছে আর এ দুটি কান শুনেছে যখন রাসূল (সাঃ) এ হেদায়েত দিচ্ছিলেন “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে, তাদের উচিত নিজেদের মেহমানদের আতিথেয়তা করা। মেহমানের পুরষ্কারের সুযোগ হলো প্রথম দিন ও রাত।
(বুখারী মুসলিম)
প্রথম দিন রাতের আতিথেয়তাকে পুরস্কারের সাথে তুলনা করার অর্থ এই যে, পুরস্কার দাতা যে ভাবে বন্ধুত্বের সাথে পুরস্কার দিতে গিয়ে আত্মিক
আনন্দ অনুভব করে, ঠিক এমনি অবস্থা প্রথম রাত ও দিনে মেজবানের হওয়া উচিৎ। আর যেভাবে পুরষ্কার গ্রহীতা খুশীতে আবেগ বিহবল হয়ে পুরষ্কার গ্রহণ করে ঠিক মেহমানকেও প্রথম দিন ও রাত তদ্রূপ অবস্থা দেখানো উচিৎ এবং নিজের অধিকার মনে করে আনন্দ ও নৈকট্যের আবেগের সাথে মেজবানের দেওয়া হাদিয়া নিঃসংকোচে গ্রহণ করা উচিৎ।
৪. মেহমান আসা মাত্রই তার প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য করবে, পায়খানা-প্রস্রাবের জরূরত আছে কিনা জিজ্ঞেস করবে। মুখ-হাত ধৌত করার ব্যবস্থা করে দেবে, প্রয়োজন গোসলের ব্যবস্থাও করে দেবে, পানাহারের সময় না হলেও অত্যন্ত সুন্দর নিয়মে (যেভাবে মেহমান লজ্জা না পায় সেভাবে) পানাহারের কথা জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। যে কামরায় মেহমানের শোয়া ও অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা মেহমানকে জানিয়ে দেবে।
৫. সব সময় মেহমানের কাছে বসে থাকবে না। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট যখন মেহমান আসতো তখন তিনি তাদের পানাহারের ব্যবস্থা করার জন্য মেহমানদের কাছ থেকে কিছুক্ষণ দূরে সরে যেতেন।
৬. মেহমানদের পানাহারে আনন্দ অনুভব করবে, মনোকষ্ট ও দুছখ অনুভব করবে না। মেহমান দুঃখ-কষ্ট নয়, আল্লাহর অনুগ্রহ এবং ভাল ও প্রাচুর্যের উপকরণ। আল্লাহ যাকে মেহমান হিসেবে আপনার নিকট প্রেরণ করেন তার রিযিকও পাঠিয়ে দেন। সে তোমার ভাগ্যের অংশ খায় না বরং তার ভাগ্যের অংশই সে খায়। সে তোমার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হয়।
৭. মেহমানের মান-সম্মাননের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে। তার মান সম্মানকে নিজের মান-সম্মান মনে করবে। কেউ মেহমানের মান-সম্মান এর ব্যঘাত ঘটালে তাকে তোমার মর্যাদা ও লজ্জাবোধের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ মনে করবে।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
“লুত (আঃ) বলেছেন, ভাইসব! এ সব লোক আমার মেহমান সুতরাং তোমরা আমাকে অপমান করোনা। আল্লাহকে ভয় কর আর আমাকে অসম্মান করা থেকে বিরত থাক”।
(সূরায়ে আল হাজ্বার)
৮. অন্তত তিন দিন পর্যন্ত আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে আতিথেয়তা করবে। তিন দিন পর্যন্ত আতিথেয়তা মেহমানের হক আর এ হক আদায়ে মুমিনের অত্যন্ত প্রশস্ত অন্তর হওয়া উচিৎ। প্রথম দিন বিশেষ আতিথেয়তার দিন। সুতরাং এদিন আতিথেয়তার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করবে। পরবর্তী দুদিন অসাধারণ ব্যবস্থা না করতে পারলেও কোন ক্ষতি নেই। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
আরবি
আতিয়েতা হলো তিন দিন, তার পর যা কিছু করবে তা হবে তার জন্য সদকাহ”।
(বুখারী, মুসলিম)
৯. মেহমারে খেদমতকে নিজের চারিত্রিক কর্তব্য মনে করবে এবং মেহমানকে কর্মচারী ও শিশুদের স্থলে নিজেই তার খেদমত ও আরামের ব্যবস্থা করে দেবে। রাসূল (সাঃ) মেহমানদের অতিথেয়তা নিজে নিজেই করতেন। হযরত ইমাম সাফেয়ী (রহ) যখন হযরত ইমাম মালেক (রহ)-এর ঘরে মেহমান হিসেবে গেলেন তখন তিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে এক কামরায় শোয়ালেন। সাহরীর সময় ইমাম শাফেয়ী (রহ) শুনতে পেলেন যে কেউ দরজা খটখটায়ে অত্যন্ত স্নেহমাখা সুরে বলছেন, “আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক! নামাযের সময় হয়ে গেছে”। ইমাম শাফেয়ী (রহ) তাড়াতাড়ি উঠে দেখলেন যে, ইমাম মালেক (রহ) লোটা হাতে দাঁড়িয়ে! ইমাম শাফেয়ী (রহ) কিছুটা লজ্জা পেলেন। ইমাম মালেক এটা বুঝে মহব্বতের সাথে বললেন, ভাই! তুমি কিছু মনে করবে না। মেহমানের খেদমত করা উচিৎ।
১০. মেহমানকে বসার ব্যবস্থা করার পর পায়খানা দেখিয়ে দেবে। পানির লোটা এগিয়ে দেবে এবং কেবলার দিক দেখিয়ে দেবে। নামাযের স্থান ও মোছল্লা ইত্যাদি সরবরাহ করবে। ইমাম শাফেয়ীকে ইমাম মালেকের খাদেম এক কামরায় অবস্থান করানোর পর বিনয়ীভাবে বলল, “হযরত! কেবলা এদিকে, পানির পাত্র এখানে রাখা আছে, পায়খানা ঐদিকে”।
১১. খাওয়ার জন্য যখন হাত ধোয়াবে তখন প্রথমে নিজে হাত ধুয়ে দস্তর খানে পৌঁছাবে তারপর মেহমানের হাত ধোয়াবে। ইমাম মালেক (রহ) যখন এ কাজ করলেন তখন ইমাম শাফেয়ী (রহ) এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তখন তিনি বললেন, খাওয়ার আগে প্রথমে মেজবানের হাত ধোয়া উচিৎ এবং দস্তরখানে এসে মেহমানকে স্বাগত জানান উচিৎ। খাবার পর মেহমানদের হাত ধোয়ান তারপর মেজবানকে হাত ধুতে হবে কারণ খাবার থেকে উঠার সময় কেউ এসে পড়তে পারে।
১২. দস্তরখানায় খাবার ও পাত্র মেহমানদের সংখ্যা থেকে কিছু বেশী রাখবে। হতে পারে যে, খাবার সময় আরো কোন ব্যক্তি এসে পড়বে, আবার তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হতে হবে। এমতাবস্থায় পাত্র ও সাজসরঞ্জাম যদি আগে থেকে প্রস্তুত থাকে তা হলে আগন্তুক ব্যক্তিও অপমানের স্থলে আনন্দ ও সম্মান অনুভব করবে।
১৩. মেহমানের জন্য প্রয়োজনবোধে নিজে কষ্ট করে তাকে আরাম দেবে। একবার রাসূল (সাঃ) এর দরবারে এক লোক এসে বলল, হুজুর! আমি ক্ষুধায় অস্থির! তিনি তার কোন এক বিবির ঘরে বলে পাঠালেন, খাবার যা কিছু আছে পাঠিয়ে দাও! উত্তর আসল, এখানে পানি ব্যতীত আর কিছু নেই। আবার অন্য এক বিবির ঘরে পাঠালেন ওখান থেকে এই জবাবই আসলো, এমনকি তিনি এক এক করে সকল বিবির ঘরে বলে পাঠালেন এবং সকল বিবির ঘর থেকেই এক জবাব আসলো। তখন তিনি নিজের সাহাবীদের দিকে মনোযোগী তলেন এবং বললেন, আজ রাতের জন্য এ মেহমানকে দিকে মনোযোগী হলেন এবং বললেন,আজ রাতের জন্য এ মেহমানকে কে কবুল করতে পার? এক আনসারী সাহাবী বললেনঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কবুল করতে পারি!
আনছারী মেহমানকে বাড়ী নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে বিবিকে বললেন, আমার সাথে রাসূলাল্লাহ (সাঃ)-এর এক মেহমান আছে, তার আতিথেয়তা কর। বিবি বলল, “আমার নিকট শুধু শিশুদের উপযোগী সামান্য খাদ্য আছে”। সাহাবী বললেন শিশুদেরকে কোন রকম ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে চেরাগ নিভিয়ে দেবে এবং মেহমানদের সাথে খেতে বসে যাবে সে যেন বুঝতে পারে যে, আমরাও তার সাথে খাবারে শরীক আছি।
এভাবে মেহমান পেট ভরে খেয়ে নিলেন আর পরিবারের লোকেরা সারা রাত উপবাসে কাটালেন। ভোরে এ সাহাবী যখন রাসূল-এর দরবারে হাযির হলেন এবং তিনি দেখেই বললেন, তোমরা উভয়েই রাতের বেলায় তোমাদের মেহমানের সাথে যে সৎ ব্যবহার করছো ত আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।
(বুখারী, মুসলিম)
১৪. তোমার মেহমান যদি কখনো তোমার সাথে অমানবিক ও রুক্ষ্মতা সুলভ ব্যবহার করে তবুও তুমি তার সাথে অত্যন্ত প্রশস্ত হৃদয়, বুদ্ধিমত্তার সাথে ভাল ব্যবহার করবে।
হযরত আবুল আহওয়াস জাশমী (রাঃ)-তার পিতা সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, একবার তিনি রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, কারো নিকট যদি আমি অতিথি হই আর সে যদি আতিথেয়তার হক আদায় না করে এবং আবার কিছুদিন পর আমার কাছে আসে তা হলে আমি কি তার আতিথেয়তার হক আদায় করব? নাকি তার অমানবিকতা ও অমনোযোগিতার প্রতিশোধ নেবো? রাসূল (সাঃ) বললেন, না বরং যে ভাবেই হোক তার আতিথেয়তার হক আদায় করবে।
(মেশকাত)
১৫. মেহমানের খায়ের ও বরকতের জন্য হযরত আবদুল্লাহ বিন বসর (রাঃ) বলেছেন যে, একদা রাসূল (সাঃ) আমার পিতার নিকট মেহমান হলেন, এবং আমরা তার সামনে খাদ্য হিসেবে হারিসা পরিবেশন করলাম, তিনি সামান্য কিছু গ্রহণ করলেন, তারপর আমরা খেজুর পরিবেশন করলাম। তিনি খেজুর খাচ্ছিলেন তারপর কিছু পানীয় পেশ করা হলো, তিনি পান করলেন এবং তার ডানে বসা ব্যক্তির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি যখন চলে যেতে উদ্যত হলেন তখন সম্মানিত পিতা তার সওয়ারীর লাগাম ধরে আবেদন করলেন যে, হুযুর! আমাদের জন্য দোয়া করুন! রাসূল (সাঃ) দোআ করলেন-
আরবি
“আয় আল্লাহ!আপনি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছেন তাতে প্রাচুর্য ও বরকত দান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের প্রতি রহমত করুন!