somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"অসমাপ্ত ক্ষুধা"....(ক্ষুধার রকমফের নিয়ে একটি বিশ্লেষণমুলক গল্প)

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


'স্বাধীন’।
একটা কাজের ছেলে। ঢাকা- শহরের অন্যতম এক ধনীর বাসায় সে কাজ করে। বহুদূরের আত্মীয়তার সূত্র ধরে তার এখানে আসা। সে যেই বাসায় কাজ করে সেখানে তাকে ছাড়াও আরও দুজন মানুষ থাকে। তাদের কথায় পরে আসছি।
স্বাধীন খুবই ভদ্র- নম্র স্বভাবের একটা ছেলে। চুরি- ছ্যাঁচড়ামির অভ্যাস নেই। কখনো বাজার থেকে ২ টাকা ফেরত এলেও স্বাধীন সেটা মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে দেয়। ওর বয়স খুব বেশি না। ২০/২২ হবে। বাবা, মা কেউ নেই। দুইটা বোন আছে, তারাও মানুষের বাসায় কাজ করে।
স্বাধীনের কাজ হলো বাসার দেখা-শুনা করা, মাঝে- মধ্যে বাজার করা। অনেকটা কেয়ার-টেকার টাইপ। বাসার অন্য দুইজনের কেউ ই সারাদিন বাসায় থাকে না। সকালে বের হয়, রাতে ফেরে। তারা স্বামী- স্ত্রী। স্বাধীনের মালিক লোকটা প্রচুর ধনী। মাঝে মাঝেই সে ব্যাবসার কাজে দেশের বাইরে যায়। সাথে স্ত্রীকেও নিয়ে যায়। তখন পুরো বাসায় স্বাধীনকে একা থাকতে হয়।
এই জিনিষটা ওর একদম ভালো লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে তালা-বদ্ধ ঘরে। ওর মালিকের একটা খারাপ অভ্যাস আছে। সেটা হলো, প্রতিদিন রাতে বাইরে থেকে মদ খেয়ে এসে স্বাধীনকে ইচ্ছামত পেটায়। স্ত্রীকে সে বাঘের মতো ভয় পায়, তাই স্ত্রীকে না পিটিয়ে সে বাসার কাজের ছেলেকে পেটায়।
পেটানোর সঠিক কারন স্বাধীন তার স্বল্প জ্ঞান দিয়ে খুজে পায় না। অনেক দিন ধরেই এরকম চলছে। স্বাধীনও মার খেতে খেতে অভ্যাস্ত হয়ে পড়েছে।
অবশ্য প্রথম দিকে ও ব্যাপারটা একদমই সহ্য করতে পারতো না। একদিন কাজ ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো। কিন্তু ঢাকায় ওর পরিচিত কেউ নেই। কার কাছে যাবে? দুইদিন না খেয়ে থাকতে হলো তাকে। অবশেষে পেটের দায়ে ফিরে আসতে হলো কাজে। কেউ একজন ওকে বলেছিলো, ‘পেটে খেলে পিঠেও সইতে পারবি’।
কথাটা ওর ভালো লেগে যায়।
সেই থেকে ও সয়ে আসছে এই অমানুষিক অত্যাচার। মেনে নিয়েছে কঠিন বাস্তবতা। স্বাধীনের কাছে মনে হয়, পৃথিবীতে পেটের ক্ষুধার চেয়ে বড় আর কিছুই নেই।


* স্বাধীনের মালিক ‘আনিস সাহেব’।
দেশের অন্যতম একজন শিল্পপতি। গুলশানের এক আলিশান ফ্ল্যাটে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। কোন সন্তান- সন্ততি নেই। কখনো হবেও না। ডাক্তার অন্তত তা-ই মনে করেন।
যা হোক, তার সম্পত্তি প্রচুর। বেশিরভাগ সে একাই ভোগ করতে চায়। নিজের স্ত্রীকেও ভোগ করতে দেয় না। দিন দিন তার সম্পত্তির পরিমান বেড়েই চলেছে। কমার কোন নাম নেই। ব্যাবসার এমন কোন ক্ষেত্র বাকি নেই যেখানে সে টাকা খাটায়নি।
প্রতিমাসে তার যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে অন্তত ২০/২৫টা পরিবার খুব ভালো ভাবে চলতে পারবে। তার এই আয়ের মূল উৎস হলো ‘চোরাকারবারি’ আর ‘স্মাগলিং। ব্যাপারটা আর কেউ না জানলেও স্বাধীন খুব ভালো করেই জানে। ব্যাবসার আড়ালে লুকিয়ে এই কাজগুলো করে থাকেন আনিস সাহেব।
কাউকে ভুল করেও সে কোনদিন একটা টাকা দান করে না। নিজের স্বার্থ ছাড়া সে কখনোই কাউকে সাহায্য করে না। নিজের স্ত্রীকেও না। প্রতিদিন রাতে মদ খেয়ে বাসায় আসে আর কাজের ছেলেকে ইচ্ছামত মার-ধর করে। থামানোর কেউ নেই।
স্ত্রী বুঝতে পারে, সন্তান না হওয়ার কারনেই তার এই মানসিক বিপর্যয়। তাই সে ও তখন বাধা দেয় না তাকে। কাজের লোকেরা তো মানুষের জাতের মধ্যে পড়েনা। মরে গেলেই কি আসে যায়!
যখন সে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন নিজেই থেমে যায়।
একবার গাড়ী নষ্ট থাকায় আনিস সাহেবকে সি.এন.জি দিয়ে এক জায়গায় যেতে হয়েছিলো।
সেখানে গিয়ে সি.এন.জি চালক ভাড়া ১০ টাকা বেশি চাওয়ায় তার সাথে আনিস সাহেব মারামারি শুরু করে দেন। বিচ্ছিরি অবস্থা! পরে মানুষজন এসে তাদেরকে থামায়। অনেকে চিনতে পারে আনিস সাহেবকে, আর এটা ভেবে অবাকও হয় যে উনার মতো মানুষের ১০ টাকা বেশি দিলে কি আসে যায়! কিন্তু কেউ কিছু বলে না বা বলার সাহস পায় না। তার অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, 'যতো পায়-আরও চায়'।
নিজের সম্পদে সে সন্তুষ্ট না। সারাদিন সে চিন্তা করতে থাকে যে, কিভাবে এটা বাড়ানো যায়। তার দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনগুলো মনে পরে- “এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি-ভুরি; রাজার হস্ত, করে সমস্ত, কাঙালের ধন চুরি”।
স্বাধীন তার স্বল্প জ্ঞানে বুঝতে পারে, এটাও এক ধরনের ক্ষুধা। যে ক্ষুধা সহজে মেটে না। কেবল বাড়তেই থাকে। এর নাম ‘অর্থ-ক্ষুধা'।


* আনিস সাহেবের স্ত্রী, ‘মিসেস আনিস’।
সঙ্গত কারনে তার আসল নামটা বলা হলো না। তার কথা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। তবু বলতে হবে, না হলে ভদ্র, এবং অভিজাত সমাজ তথা, সুশীল সমাজের কিছু কর্মকাণ্ড মানুষের চোখের আড়ালেই রয়ে যাবে। মিসেস আনিসকে সরাসরি একজন ‘পতিতা’ বললে ভুল হবে না।
ঘরে স্বামী থাকা সত্ত্বেও তাকে এইরুপ সম্বোধন করাটা নিতান্তই বাধ্যতার খাতিরে। তবে, সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ বলে তার এই ব্যাপারটা চাপা পড়ে রয়েছে। পড়ে থাকবে হয়তো এভাবেই।
আনিস সাহেবের কাছে তার সবকিছু হচ্ছে তার ‘সম্পদ’।
সে এটাকে বাড়ানোর চিন্তায় সারাদিন ব্যাস্ত থাকে। স্ত্রী কি করলো না করলো তাতে তার কিছুই আসে যায় না। আর তার স্ত্রীও এই সুযোগটাই কাজে লাগান।
সকালে দুজন একসাথেই বের হন। আনিস সাহেব চলে যান অফিসে আর তার স্ত্রী চলে যান ‘সোশ্যাল-এ্যাক্টিভিটি’ নামক কোনো এক ক্লাবে। যেই ক্লাবের মালিক মিসেস আনিস নিজেই। যাই হোক, মাঝে মধ্যেই বের হবার ১০ মিনিটের মাথায় বাসায় ফিরে আসেন মিসেস আনিস। আর প্রত্যেকবারই তার সাথে থাকে নতুন কোনো ভদ্রলোক। স্বাধীনকে তখন পাঠিয়ে দেয়া হয় বাজারে। বের হবার সময় পুরো ব্যাপারটা ধরতে স্বাধীনের বেশি বেগ পেতে হয় না। বাজারের ভিড়ে দাড়িয়ে স্বাধীন নিজেকে প্রশ্ন করে-
"এগুলোর মানে কি? উনার তো কোন কিছুর অভাব নেই। না টাকার অভাব, না খাবারের অভাব, না কাপড়ের অভাব। তারপরও এমন কেনো"?
সমাজের সাধারন পতিতারা যেখানে নিজেদের পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য অভাবের তাড়নায় এই কাজে লিপ্ত, সেখানে মিসেস আনিসের মতো মহিলারা কোনো কিছুর অভাব না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিজেদের ফুর্তির জন্য এ ধরনের কাজে লিপ্ত। স্বাধীনের মাথায় আরও একটা প্রশ্ন প্রায়ই উঁকি দেয়- একই কাজ মিসেস আনিসও করছে, আবার রাস্তার একটা খারাপ মেয়েও করছে। রাস্তার মেয়েটাকে এই কাজের জন্য আলাদা একটা নামকরন করা হয়েছে অথচ মিসেস আনিসকে তা করা হয়নি। কেনো???
স্বাধীন কোনো উত্তর খুজে পায় না। পাবে বলে মনেও হয় না। তাই সে হাল ছেড়ে দেয়। তবে এটুকু বুঝতে পারে যে, এটাও এক ধরনের ক্ষুধা।
স্বামীর মতো অর্থের ক্ষুধা না থাকলেও মিসেস আনিসের ক্ষুধা কোন পর্যায়ের তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে স্বাধীন, তার স্বল্প জ্ঞানে। ভদ্র সমাজে এর নাম ‘যৌন-ক্ষুধা’।

** একসময় স্বাধীনের মনে হতো, পৃথিবীতে পেটের ক্ষুধার চেয়ে বড় কোনো ক্ষুধা নেই। থাকতেও পারে না। অথচ দিন দিন তার ধারনার পরিবর্তন হচ্ছে। কারন পেটের ক্ষুধার কথা সে চিন্তা করেছিলো নিজের দিকে তাকিয়ে।
বাসার অন্য দুইজনের দিকে তাকিয়ে সে এখন বুঝতে পারছে যে আরও অনেক ধরনের ক্ষুধাই পৃথিবীতে রয়েছে। একই পরিবারের তিনটি মানুষ। অথচ তিনজনের ক্ষুধা তিনরকম।
স্বাধীনের ক্ষুধা আর তাদের ক্ষুধার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। স্বাধীন বুঝতে পারে ধনী- গরীবের পার্থক্যটা হয়তো এই ক্ষুধার কারনেই তৈরি। কি আজব এই দুনিয়া!
ধনী- গরীবের ক্ষুধার মাঝেও রয়েছে পার্থক্য আর ক্ষুধার কারনে সৃষ্ট এই পার্থক্য এভাবেই হয়তো চলতে থাকবে, আজীবন। আরও একটা প্রশ্নের উত্তর স্বাধীন ইদানীং খুজে বেড়ায়। তা হলো, আনিস সাহেব বা তার স্ত্রী যদি স্বাধীনের মতো পেটের দায়ে আঁটকা পড়তো তখনও কি তাদের মধ্যে এরকম ক্ষুধা থাকতো কিনা।।
.............................................. :) ...................................................
“A hungry man is not a free man.”_ E. Stevenson
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৪৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×