সুখী মানুষের খোঁজে -
নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের পরিবর্তে ‘রকিব উদ্দিন মার্কা নির্বাচন কমিশন’ হলে দেশ চরম অস্থিতিশীল হবে বলে মনে করছে বিএনপি। সেজন্য নতুন ইসি গঠনে নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সব দল বা জোটের সাথে আলোচনা করে সকল দল বা জোটের মহাসচিব পর্যায়ে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটা স্বাধীন,নিরপেক্ষ ইসি গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন বেগম খালেদা জিয়া, গেল ১৮ই নভেম্বর হোটেল ওয়েস্টিনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশদলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং দেশি বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথিরা। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনা শেষ হবার এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই সরকারী দল তথা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের তা নাকচ করে গনমাধ্যমে কথা বলেন। এ নিয়ে নানা নাটকীয়তা, পক্ষে বিপক্ষে বক্তৃতা বিবৃতির পরে রাষ্ট্রপতি আলোচনার উদ্দ্যোগ গ্রহন করেন। এরই অংশ হিসেবে বিএনপি, আওয়ামীলীগ সহ সর্বমোট ৩১ টি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ম্যারাথন আলোচনা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠনের ঘোষণা আসে বঙ্গভবন থেকে। কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া বাকি পাঁচজনের নামধাম, দলীয় পরিচয়, অভিজ্ঞতা এবং বলয়ের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৭ শে জানুয়ারি রোজ শুক্রবার দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্যের সাতকাহন তুলে ধরেন।
বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সংবাদ সম্মেলনে জনাব ফখরুল ইসলাম আলমগির বলেন-‘ঘোষিত সার্চ কমিটি কোন নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না’। তিনি বলেন- ইতিপূর্বে গত ১৮ই নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ ইসি গঠনে যে প্রস্তাব রেখেছিলেন, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেটাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। দলীয় অনুগত লোকের সমন্বয়ে গঠিত সার্চ কমিটি একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে কিভাবে আমরা তা প্রত্যাশা করব? সাধারন জনগনই করে না। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের একজন মাননীয় বিচারপতিকে প্রধান করে ছয় সদস্যের যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে, আগেরবারের অনুসন্ধান কমিটিরও প্রধান ছিলেন ওই একই লোক। যাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই রকিব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে অযোগ্য, মেরুদণ্ডহীন এবং বিতর্কিত কমিটি গঠিত হয়। একই ব্যাক্তিকেই যেখন দ্বিতীয়বারের মত সার্চ কমিটির প্রধান করা হয় তখন আরেকটি রাকিবুদ্দিন মার্কা ইসি গঠিত হবে বলেই মনে হয়।
অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা ছিলেন, তাঁর ছোট ভাই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য সরকারী কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব ছিলেন। বিতর্কিত সেই নির্বাচনকে নিয়মসিদ্ধ করার পুরস্কার হিসেবে তিনি অবসরের পরেও পিএসসি’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি সরকারের ইচ্ছা পুরনে সচেষ্ট থাকবেন তা-ই স্বাভাবিক। কমিটির একমাত্র নারী সদস্য চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরিন আখতার। মির্জা ফখরুল বলেন, শিরিন আখতার চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী শিক্ষক হিসেবে বহুল পরিচিত। তাঁর বাবা কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। শিরিন আখতার নিজে কক্সবাজার জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের নেত্রী ছিলেন। অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য জনাব মাসুদ আহমেদ একজন সরকারী কর্মকর্তা। তিনি সরকারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন ছয় সদস্যের মধ্যে পাঁচজনের-ই নামধাম, দলীয় পদ, পরিচয় তুলে ধরলেন তখনো সরকারী দল এসব অভিযোগকে আমলে না নিয়ে বরং উড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে অবস্থান করেন এবং সরকারে প্রভাব রাখেন এমন সব কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অতীতে সব সময়ই সরব ছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পরে তাঁদের ভুমিকা অনেকটাই গৌণ হয়ে আসে সরকারের কঠোর ভারতঘেঁষা নীতি এবং ভারতীয় কূটনীতিতে বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে রাখার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারনে। কিন্তু সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী তারা আবার পর্দার সামনে এসেছেন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির সময় প্রার্থনা করে চিঠি দিয়ে। অবশ্য বঙ্গভবন এ বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি এবং তাঁদের যে এ বিষয়ে কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নেই সেই ইংগিতই যেন পাওয়া গেল আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের কথায়। কূটনীতিকদের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বলেন,-সার্চ কমিটির বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। বিএনপি’র কথায় প্রেসিডেন্টকে বিদেশিদের সঙ্গে বসতে হবে ? আমরা কি মেরুদণ্ডহীন জাতি? ঐ দিন চলে গেছে। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারণ আমরা-ই করব।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত সার্চ কমিটি। এ বৈঠকের পরেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ম্যারাথন আলোচনায় থাকা দল গুলোর কাছ থেকে পাঁচ সদস্যের নাম চাওয়া হয়েছে। আবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নাম প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শ নিতে সোমবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে সার্চ কমিটি।
প্রেসিডেন্ট জনাব আব্দুল হামিদ গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিকে আগামী দশ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম প্রস্তাবের দায়িত্ব দেন। সার্চ কমিটির সুপারিশ থেকেই অনধিক পাঁচ সদস্যের নতুন ইসি নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট। রকিব উদ্দিন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারি, নির্বাচন কমিশনার এ কে এম শাহনেওয়াজের মেয়াদ আছে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এখন সদ্য গঠিত সার্চ কমিটির ছয় জনের মধ্যে একজন বাদে বাকি পাঁচজনের দলীয় পরিচয় এবং বিএনপি’র আস্থাহীনতা, অন্যদিকে কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের অন্য এক আইনজীবী। শনিবার সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন জমা দেয়ার পর আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ বলেন- সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে একটি আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেই আইন প্রনয়ন করা হয়নি। একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংবিধানের বাইরে চলতে পারেনা। আর আইনে সার্চ কমিটির কথা নেই। তাই সার্চ কমিটি গঠন করে যে গেজেট জারি করা হয়েছে তাঁর বৈধতা -ই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে উক্ত আবেদনে।
এত আপত্তি, এত প্রশ্ন, এত কেন’র পরেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, সার্চ কমিটির কাছে বিএনপি তাঁদের প্রস্তাব পেশ করবে। সে অনুযায়ী বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জনাব রুহুল কবির রিজভি এবং একই দিনে ক্ষমতাসীন দলের দপ্তর সম্পাদক জনাব আব্দুস সোবহান গোলাপ তাঁদের নিজ নিজ দলের পক্ষে পাঁচ জনের তালিকা নিয়ে যান মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে জমা দিতে যান। মঙ্গলবার বেলা ২টা পর্যন্ত ২৭টি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবকৃত নাম জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি) আব্দুল ওয়াদুদ।
আপাতত রাষ্ট্রপতি নির্দেশিত দশ কার্যদিবস শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া রাজনৈতিক ভাবে কারো করনীয় কিছু আছে বলে মনে হয় না। আমাদেরকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আওয়ামীলীগ ও তাঁদের সরকার নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনা করতে নেমেছে নাকি জাতির ভাগ্য রেখাকে পরিনতির দিকে নিয়ে যাবে তা বলে দিতে পারে একমাত্র ভবিষ্যৎ। বিএনপি কোন বলে বলীয়ান হয়ে ক্ষনে ক্ষনে মত বদলায় সেসব বুঝতেও হয়ত অপেক্ষার প্রয়োজন। সবচে বড় কথা, আমরা জানি না বিচারপতি সাঈদের মত আরেকজন সৎ এবং যোগ্য লোক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে আরেকবার পাব কিনা!! আমার মনে আছে, সাঈদ সাহেব কতটা নিভৃতে মারা গেলেন !! পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপার জায়গা হল এক কলাম ইঞ্চি, মানে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবির সমান জায়গায়। তাও সেটা ছাপা হল যেসব পৃষ্ঠায় হারবালের বিজ্ঞাপন ছাপা হয় সেখানে, একেবারে কোনার দিকে। রাষ্ট্র বলুন, বিএনপি কিংবা আওয়ামীলীগ যাদের কথা-ই বলুন না কেন, এই বীর পুরুষকে কেউ মনে রাখেনি। এখন তাকিয়ে আছি এমন আরেকজনের আশায়। যিনি দেশের হাল ধরবেন। দেশটাকে বাঁচিয়ে দেবেন। এমন একজন মানুষ যিনি অকপটে বলতে পারেন-‘আমি সুখী কিনা জানিনা কিন্তু আমার কোন দুঃখ নেই। সারাদিন আমি নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে করি, রাতে ঘুমাই’। বাস্তবতা হল, এদেশে বীরের স্থান নেই। এখানে তাই বীরের জন্ম হয় না। আমাদেরকে শতশত বছর ধরে সয়ে যেতে হয় নন রেসিং স্টেট এর খেতাব।
লালপুর,
নাটোর থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:০৭