- এই জ্যাক, থার্ড ইয়ারে উঠিছিস নাকি উঠবি ? পিচ্চি মিলনের কথায় গায়ে আগুন ধরে যাবার যোগাড়। আমাকে দেখলেই কোন না কোন প্রশ্ন করবে। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমার প্রায়ই ইচ্ছে করে ৪১৪ থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দেই। সে যে কখন কোথা থেকে ভুতের মত সামনে এসে জুটে তা আগে থেকে ঠাহর করা মুশকিল। সে হাসি মুখে তাকিয়েই আছে। এই হারামী সময় অসময় বুঝে না। মাত্র রেজাল্ট নিয়ে ফিরে এসেছি। যার যেমন ফল হবার কথা তার তেমন ফলই হয়েছে। আমি দুই সাবজেক্টে পাশ করেছি। একটায় ফেল। এই দু:সময়ে তার মুখে হাসি। সহ্য হয়
-এক বিষয়ে ফেল। আমাদের ক্লাসে মাত্র তিন চারজন আছে যারা নিয়মিত ফেল করে। কোন ইয়ারেই একবারে পাশ করেনা। আমি তাদের একজন। প্রথম প্রথম ভাব মারতাম এক্সিডেন্টাল ফেল হিসেবে। এখন আর সে সুযোগও নেই। ফেল করতে করতে এটা নিয়তি হয়ে গেছে। ফলে আমি সহ্য করি। সহ্য আমাকে করতে হয়।
-এই, তুই ত দেখছি সেকেন্ড ইয়ার পাশের আগেই ইয়ার লস খেয়ে গেলি…….. তার মুখে চাপা হাসি। সে আর হেলাল রুম পার্টনার। হেলাল সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু বছর শেষে পাশ করে যায়। অথচ আমি মাঝে মাঝে কলেজে গিয়েছি, কয়েকটা ক্লাসও করেছি। ফল শুন্য। চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে এসে ফেলের চক্করে একবার পড়লে, ফেল তার জীবনের মৌলিক অংশে পরিনত হয়। আমার ব্যাপারটাও তেমনই, গা সওয়া হয়ে গেছে।
-এখনো ইয়ার লস হয়নি। আরেকবার ফেল করলে সেটা হবে… কটকট করে উত্তর দিলাম। আর যেন কথা বলতে না পারে, ইচ্ছে হল এখনই সুই সুতা দিয়ে তার ঠোট দুইটা সেলাই করে দেই।
-তা থার্ড ইয়ার যদি কপালে আসে কখনো, একটা কথা বলে দেই আগেভাগে। জোয়ারদার স্যারের সাথে চালাকি করবি না কিন্তু। নিয়মিত ক্লাস করবি, পরীক্ষা দিবি। পড়ালেখা সেই রকম না করলে স্যার কিন্তু সুন্দর চেহারা দেখে পাশ করাবে না। কথাটা মনে রাখিস।
পিচ্চি মিলন। ব্যাচ ৩৪ ঢাডেক। শুকনো, পাতলা, ছোটখাটো গড়নের একজন যুবক। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল। গায়ের রঙ শ্যামলা, চকচকে। সবসময় হাসে। কারনে হাসে, অকারনে হাসে। তার মুখোমুখি হওয়াটা ইদানিং আমার একটা প্যানিকে পরিনত হয়েছে। কোন না কোন প্রশ্ন সে করবেই, আমাকে সে প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে যেতে হবে। তেহারির দোকানে গেলে তার সাথে দেখা হয়, শুক্রাবাদের ঘুপসি হোটেলে তেলাপিয়া মাছ দিয়ে ভাত খেতে গেলে দেখা যায় এক কোনে বসে ঝোল দিয়ে পুরি খাচ্ছে। কাচা বাজারে পিচ্চি মিলন কোন বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে। পান্থপথ, রাজা বাজার, শুক্রাবাদ, ৩২ নাম্বার, ২৭ নাম্বার কিংবা ধানমন্ডি লেকে সন্ধ্যার পরে গিয়েও তার সাথেই দেখা হয়েছে বারবার। নিজেকে শান্তনা দিয়েছি । নিয়তিকে মেনে নিয়েছি। কত বছর আগের কথা। অথচ মনে হয় এইত সেদিনের কথোপকথন ছিল সেটা। পিচ্চি মিলন পিচ্চি আয়ু নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিল। কয়েক বছর আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার মৃত্যু সংবাদ আমার বুকে পাথরের মত ভারী ধাক্কা দিয়েছিল।
যে জোয়ারদার স্যার’কে নিয়ে পুরো কলেজ তটস্থ থাকত সেই জোয়ারদার স্যারকে আমি দেখেছিলাম এক অনন্য সাধারন মানুষ হিসেবে। ছাত্রদের মধ্যে তার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া কিন্তু অনিয়ম করে পার পাওয়া যাবে না- এ বিষয়ে কখনো কাউকে দ্বিমত করতে দেখিনি। স্যার একদিন আমাদের ১৪ জনকে ডেকে বললেন- তোমরা যারা চারমাস পরে এপিয়ার করবে তারা প্রতিদিন আমার রুমে আসবে। যে দেশের শিক্ষকেরা নিয়মিত ক্লাসই নেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন গড় হাজির, স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান উচ্চ শিক্ষার্থে এবং বছরের পর বছর নিয়মিত বেতন তুলে নেন অথচ সকল শর্ত ভংগ করে আর দেশে ফেরেন না, যে দেশের শিক্ষকদের মানসিকতা এমন লেভেলের সেখানে শিক্ষা ব্যাবস্থাপনা কোন পর্যায়ের এবং ছাত্রদের নৈতিক মানদন্ড কিরুপ তা অনুমান করতে সার্ভে করার প্রয়োজন নেই। স্যারের কথামত সাড়ে এগারোটার দিকে তার রুমে ঢুকলাম। স্পঞ্জের চপ্পল পরে স্যার পায়চারী করছেন। আমাদের দেখেই তাড়াতাড়ি নিজেই ১৪ টা ফোল্ডিং টুল পেতে দিলেন এই প্রফেসর, সেও নিজ হাতে। আমি তার কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছিলাম এক মনে। প্রথম লেকচারেই স্যার স্পষ্ট বলে দিলেন- দিন সব সমান নয়, আবহাওয়াও প্রতিদিন একই রপের হবে না। এপ্রিল, মে, জুনের এই তপ্ত তাপ উপেক্ষা করে, কিংবা ঝড় বৃষ্টি বন্যা হলেও যারা যারা প্রতিদিন আসবে তাদের প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। তার স্পষ্ট এই উচ্চারন বিনা দ্বিধায় আমি বিশ্বাস করলাম। নিয়মিত ক্লাস করতে করতে এক সময় জানলাম, আপ্যায়ন বাবদ বছরে তিনি চার হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। এইসব টুল, টেবিল, মার্কার, বোর্ড সহ যাবতীয় কেনাকাটা তিনি করেন সে টাকায়। একজন প্রফেসর তার বৈধ উৎসের টাকা কিভাবে ব্যায় করেন, কোন ছাত্র যদি এর নৈতিক দিকটা একবারও ভাবে তবে এ জাতীয় ভাবনা তার মন:জগতে কোন না কোন গুনগত পরিবর্তন আনবেই।
দেখতে দেখতে তিনমাস কেটে গেল স্যারের রুমে কথা শুনে শুনে। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এ কি? স্যার রিটেন এক্সামের জন্য যে প্রশ্ন করেছেন তার বাংলা তর্জমা-ই ত বুঝিনা, উত্তর লিখব কি? সাদা খাতা নিয়ে বসে আছি চল্লিশ মিনিট। এ সময় স্যার এলেন। সানগ্লাস পরে বাবু সাহেব হয়ে এসেছেন। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। তিনি সোজা আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন-প্রশ্নের বাংলা তর্জমা আমি বুঝেছি কিনা? তাকে সাদা খাতা দেখিয়ে এক ধরনের মৌন উত্তর দিলাম। তিনি আশ্বস্ত করে বলেছিলেন- লিখ। যা বুঝ তাই লিখ। প্রাইভেটের একদল শিক্ষার্থী বই খুলে লিখে। এবার বুঝবে মজা। হাহ!! কিছু বুঝি না বুঝি কোন রকমে আড়াই পৃষ্ঠা লিখে চলে এলাম। রেজাল্ট শেষে দেখা গেল দুইজন ছাড়া সবাই পাশ। মনে পড়ল, এই দু’জনকেই স্যার তার রুমে বারবার সতর্ক করেছিলেন। তার এই নীতিবোধের জন্য জীবনে বহুবার লাঞ্চিত হয়েছেন নিজের ছাত্রদের দ্বারাই। এ নিয়ে কখনো কোনদিন মনে কোন ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন বলে আমি অন্তত দেখিনি। তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে। প্রায় এক যুগ। স্যারকে একবারও দেখিনি। ফেসবুক চালু হবার পর স্যারকে খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি চিটাগাং একটা প্রাইভেট কলেজে চাকরি করছেন। যিনি নিজেকে বিলিয়ে দেন, তার জীবনে বুঝি অবসরের ছাপ পড়েনা। সারাজীবন সাধনা করা মানুষ তৈরীর এই কারিগর বুঝি সব অর্থ সম্পদই কোন না কোন কল্যানে ব্যায় করে গেছেন।
গত কয় বছর অনলাইনে তার সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ। রাজনীতি নিয়ে পারত পক্ষে আলোচনা করতে পছন্দ করতেন না। আমি যা কিছুই লিখি, যত ছাইপাশই লিখি তিনি তা পরম আগ্রহ আর মনোযোগ সহকারে পড়েন। সেখানে প্রাসংগিক কমেন্ট করেন, উপদেশ দেন, অপরিচিত পথে কিভাবে পথ চিনে বের হয়ে আসতে হয়ে তার উপায় বাতলে দেন। সবচে বড় যেসব ঘটনা আমার আমিকে জানতে ভুমিকা রেখে গেছে, সে হচ্ছে আমাকে নিয়ে তার উচ্ছাস, আন্তরিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং আমার ব্যাপারে তার এক ধরনের প্রচ্ছন্ন অহংকার। আগে আমাকে সম্বোধন করতেন, আমাদের জাকাচৌ বলে। পরে সেটাকে আরও সংক্ষিপ্ত করে বলতেন ‘আমার জাকাচৌ’। আহা! তার এসব কথায় নিজের কলিজাটা বিশাল বড় হয়ে যেত।
জাকা’র মত করে তোমরা দেশপ্রেম শেখ।
জাকা দেখি শুধু রাজনীতিবিদই নয় কবিও।
কবি আর কবিতাতেই সীমাবদ্ধ নেই, সে আজকে একজন লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকও।
কবি, নিজের মাটি আর মাতৃ ঋনে কোন তফাৎ নেই। তোমার হাতে যেন ময়লা না লাগে।
এমন কতশত কথা ….!!!
সেই জোয়ারদার স্যারের কিডনি গুলো বিকল হয়ে গেছে। সপ্তাহে কমপক্ষে দুইবার তাকে ডায়ালাইসিস করতে হয়। এমন অসুখ যে কারোরই হতে পারে। অবাক হবার কি আছে? অথচ একজন ডাক্তার, ফুল প্রফেসব হয়ে যিনি অবসরে গিয়েছিলেন, অন্যত্র চাকরি করে সংসারের ঘানি টেনে গেছেন চিরকাল, সেই মহামানব মহাত্মা জোয়ারদারকে সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। ডায়ালাইসিস কন্টিনিউ করার মত পর্যাপ্ত পয়সা তার নেই। ভাবা যায় ? সবাই গ্রুপে গ্রুপে এক হাজার টাকা করে গোপন তহবিলে জমা করে চিকিৎসায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ আমি ভাবতাম, স্যারের হাজারো স্টুডেন্ট আছে যাদের অনেকেরে-ই দৈনিক আয় পঞ্চাশ হাজার টাকার উপরে। তারা যদি প্রত্যেকেই এক লক্ষ টাকা করে গোপন তাহবিলে জমা রাখত তবে এতদিনে স্যারের টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন আশংকা করতে হত না। যারা এই টাকা যোগান দিত, তাদের কিছুই আসত যেত না। মানুষ কি সত্যিই জানেনা, যে পয়সার পাহাড় সে রেখে যাচ্ছে তার জন্য আখিরাতের বিচার তারচেও জটিলাকার ধারন করবে? কষ্ট হয় খুব। স্যারকে দেয়ার সামর্থ আল্লাহ আমাকে দেন নাই। যদি দিতেন তবে আমি নিশচয়ই তার পাশে বসার সুযোগ করে নিতাম। দু:র্ভাগ্য আমার, স্যারের সামনে নিজের চেহারা নিয়ে যাবার সাহস অতীতে ছিল না আর তার নৈতিকতার ভয়ে। আর এখন যেতে পারিনা অর্থ সংকটে।
ভগবান আমায় ক্ষমা কর। আমি নিশ্চিত সে তোমার অবতার হয়েই দুনিয়ায় এসেছে। অথচ তার সাথে দেখা করার সাহস সৌভাগ্য কোনটাই ছিল না আমার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:১৭