I am who who am i
OCT
3
একটি রোহিংগা পরিবারের বাংলাদেশে আশ্রয় নেবার ইতিকথা।
যে শিশুটি তার বোনের গলায় ঝুলে আছে সে জীবিত নাকি মৃত তা বোধ করি কাছ থেকেও ঠাহর করা যাবে না।তার বয়স দুই হয়েছে। এ বয়সী শিশুরা ভাত খায়, এটা সেটা খায় আর পেট খারাপ করে বসে। নিজের অজান্তে নিজেই নিজের ইমিউনিটি ডিভেলপ করে। এই বাবু এখনো আবু'ই আছে। দুধ ছাড়া কিছু খেতে চায় না। গত তিনদিন অবনবরত বৃষ্টিতে ভিজেছে আর বোনের ঘাড় বেয়ে নামা জল পেটে গেছে। পাচ জনের এই দলটা দলছুট হয়ে বনের আরও গভীরে হারিয়ে গিয়েছিল। পথ যখন ফিরে পেল, পথিকের দল ততক্ষনে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে। যারা নাফ পেরুতে পেরেছে তাদের প্রায় সবার সব কিছু লুটে নিয়েছে স্থানীয় বাংলাদেশী মাঝি সমাজের বিরাট একটা অংশ। সেই অংশটাই রাখাইন মেয়েদের নিয়ে বাজি ধরে ভার্জনিটির মেলা বসিয়েছে। যারা নাফ পেরিয়েছে তাদের নারী কিংবা কন্যারা ধর্ষিত হওয়া কিংবা সামান্য কিছু কয়েনের বিনিময়ে কারো সাথে কামড়াকামড়ি তে লিপ্ত হওয়াতে বিষ্মিত হয়নি। তারা যে এখনো বেঁচেবর্তে আছে, এটাই আপাতত তাদের চোখে সবচে বড় বিষ্ময়!! হায় ঈশ্বর, সৃষ্টি নিয়ে তোমার পরিহাস দেখলে আমি দীর্ঘদিন বোবা হয়ে থাকি। বিশ্বাস করো, তোমার দয়া আর নিষ্ঠুরতার কোন সীমা পরিসীমা নেই। দু'বেলা দু'মুঠো ভাত ছাড়া খুব কম মানুষই পৃথিবীতে বেশি কিছু চেয়েছিল তোমার চরনে। আত্মসমর্পণকারী এ গোষ্ঠীটাই এখনো তোমাকে বিশ্বাস করে। বুক ফুলিয়ে বলে- আমাকে বাঁচিয়ে দেবার জন্যে আমার আল্লা-ই যথেষ্ট। যারা এ স্তুতিবাক্যে সন্তুষ্ট থাকে তাদের তুমি তুলে দিয়েছ অহিংস বৌদ্ধদের হাতে। ওদের মতে যেহেতু প্রানী হত্যা মহা পাপ তাই তারা এদেরকে চোখ বন্ধ রেখে জবাই করে। আফটার অল ধর্মীয় বিধি বলে কথা!
মেয়েটি সবার বড়। বয়েসটা সবে তের। এর পরেরটা ভাই। সাত বছরের। একমাত্র সে-ই কিছু বহন করছে না। আজন্ম রোগা এই ছেলের এমন কোন অসুখ নাই যা তার গায়ে বাসা বাঁধেনি। রাতে ঘন্টা দুয়েক গাছের গুঁড়িতে হেলান দেবার সুযোগ তারা পেয়েছিল। তারপরই আবার দৌড় শুরু। রান......রান......রান...... কেউ যেন কানের কাছে চিৎকার করে বলছে, রান... রান..... দৌড়াও... বাচতে চাইলে চোখ বন্ধ রেখে দৌড়ে চলো। অহিংস সন্যাসীর দল আসছে আগুন আর বড় বড় চাপাতি নিয়ে। অহিংস শিশুদের দল ভারী চাপাতি কিংবা রাইফেল বহন করতে পারেনা। তাই তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে স্পেনিশ রিভলবার।. ২২ বোরের এসব লোহা তিনশ গ্রামের বেশি ভারী নয়। মানবিক দিক বিবেচনা করেই তাদের হাতে পলিশ করা নিখুত নিশানার এ খেলনা গুলো তুলে দেয়া হয়েছে। স্পেশাল বুলেটে সীসা কমিয়ে আর্সেনিক দেয়ার কারনে প্রতিটা বুলেটের ওজন অর্ধেক হয়ে গেছে। এসব শিশু খুনীরা জানেনা আর্সেনিক কি? উচ্চতর বিজ্ঞান জানবার প্রয়োজন তাদের নেই। গনহত্যার পরিসংখ্যান কিভাবে করা হয় তারা জানে না। UNHCR কি, তারা জানে না। তারা জানেনা, A single shot is a killing but a mass killing is a counted/uncounted /hidden number.
সামনেই নাফ নদী। নদীর ওপারে ঈশ্বর তোমাদের জন্যে স্বর্গ বানিয়ে রেখেছেন, আছে স্বর্ন তোরন, আর আছে সোনার হরিন। সুতরাং, এগিয়ে যাও যে যত দ্রত পারো এগিয়ে যাও। কেউ পরে গেলে কিংবা পিছিয়ে পড়লে তাকে ফেলে এসো। সবচে ভালো হয়, তাকে মেরে ফেলতে পারলে। এতে পুরো দলটা ধরা খেয়ে যাবার সম্ভাবনা কমে যায়। রাতের শেষ প্রহরে তারা যখন আবার পাহাড় ডিংগিয়ে ছুটতে শুরু করে তখনই কিছু একটা ঘটে গেছে বলে মনে হল। মেয়েটি বুঝতে পারছে না, তার বুক আর কাধে দড়ির মত পরে থাকা ন্যাতানো শরীরটি জীবিত নাকি মৃত। সে এখন সেসব ভাববে না, ভাববার সময় এটা নয়। এক হাতে সে শিশু ভাইটিকে ধরে রেখেছে, অন্য হাতে প্রচন্ড ভারী একটা ব্যাগ বইছে শুরু থেকেই। মায়ের দু'হাতে আরও দুই ব্যাগ। বাবার মাথায় প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। বাড়ি ছাড়বার আগে তাদের যেন কোন কিছুই ফেলে আসতে ইচ্ছে করেনি। এ যেন ১৯৪৭ সালের সেই মনোমাজরা গ্রাম। এক রাতের নোটিশে যেসব মুসলিমকে ভারত ছাড়তে হয়েছিল তারা বুঝতে পারেনি তাদের গৃহপালিত পশুগুলোর কি হবে? বাড়িঘর কি তালা দিয়ে যাবে নাকি খোলা-ই পরে থাকবে। ভারতে এমন অনেক গ্রাম ছিল যাদের কেহই কোনদিন বাপুজি'র নামও শুনেনি। দেশভাগ তো বহু দুর কি বাত। সেসব গ্রামের মানুষেরাও তাদের পড়শিদের গরু বাছুর, মহিষ, হাস মুরগি নিয়ে চিন্তিত ছিল।
--আবু'টাকে খালের পানিতে ফেলে দে।
কথাটা বললেন কাঁধে ঝুলে ঝুলে লাশ হয়ে যাওয়া শিশুটির মা। তার মুখে শোকের কোন চিহ্ন নেই। যেন এটাই হবার কথা ছিল। কারো মুখেই কোন কথা নেই। বাবা মাথার ঝাকিটা এক পাশে রেখে আলতো করে আবু'কে বুকে নিয়ে পানিতে নেমে গেলেন। মিনিট দুই পরে একজন কমে চারজনে পরিনত হওয়া দলটাকে দেখা গেল কোমর সমান পানি কেটে বিশাল একটা নালা পার হচ্ছে। সকাল হয়েছে কয়েক ঘন্টা আগেই। ঝড়, বাদল আর বৃষ্টির কারনেই কিনা কে জানে,বেলা বুঝা যায় না। নালার শেষ মাথায় দশ বারোজনের একটা জটলা মত আবছা দেখা যাচ্ছে। দুর্গম এই পথে একমাত্র রোহিংগারাই কোন কারনে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া আর কোন কারন নেই। এদিকে স্থল কিংবা জলপথে যোগাযোগের কোন ব্যাবস্থাই নেই। ফলে সেনাবাহিনী কিংবা অহিংস সন্যাসীদের দল এদিকে পা মাড়াবে বলে মনে হচ্ছে না। ওই তো, সামনের কুড়ে ঘর থেকে ধোয়ামত কিছু একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। তারা সম্ভবত যাত্রা বিরতির ফাকে একটা কিছু খেয়ে নেবার চেষ্টা করছে। তাদের চলার গতি আপনা আপনিতেই বেড়ে গেল। শেষ কবে যে পেট ভরে ভাত খেয়েছে তারা কেউই মনে করতে পারবে না নিশ্চিত। তারা যত দ্রুত নালা ছেড়ে কুড়ে ঘরের দিকে এগিয়ে এলো ততোটাই ধীরেসুস্থে আট জনের সন্যাসীদের দলটা হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। যে দলটাকে দেখে তারা এগিয়ে এসেছিল, তারাও রোহিংগা। সবার পায়েই কাফ লাগানো। তাদেরকে এমনভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, দুর থেকে দেখলে যেন মনে হয় - একদল লোক খোশ গল্পে মত্ত। এখানে কাফ লাগানো প্রায় প্রত্যেকেই একই ভুল করে ধরা দিয়েছে। মানুষ সবাই তো আর এক্সট্রা অর্ডিনারী জেমসবন্ড নয় যে ঘড়ি'র ডায়ালকে ম্যাননিফাইং গ্লাস বানিয়ে সব দেখে ফেলবে ! অহিংস দলটাতে দু'জন আছে যাদের বয়স কখনো-ই দশ হবে না। তারা এসেছে, হাতে কলমে বুনিয়াদি প্রশিক্ষন নিতে। তাদেরই সবচে ছোট ন্যাড়া মাথার হাসিখুশি পবিত্র শিশুটি, আলখেল্লায় যাকে দেব দুতের মত লাগছে। সব গুলো দাত এখনো পড়েনি, ফোকলা দাতে তাকে আসলেই তাকে ভবিষ্যত লামা মনে হচ্ছে। সেই এগিয়ে এসে মেয়েটির ভাইটিকে জড়িয়ে ধরল। তারা একে অপরের পরিচিত। ছ'মাস আগেও একই মাঠে দু'জনে ফুটবল খেলেছে।
তের বছরের সদ্য যৌবনে পা রাখার স্বপ্নে বিভোর মেয়েটি ঝোপঝাড় পেড়িয়ে পাগলের মত ছুটছে। তার ভাইয়ের পেটটা ছোট ব্লেড দিয়ে চিড়ে দিয়েছিল। বাচ্চাটা এক ঘন্টায়ও মরেনি। পানি চাইছিল। আকাশ চৌচিড় হয়ে বৃষ্টি ঝড়ছে তবু রোগাভোগা ছেলেটি দিদির কাছে পানির আবদার করেই যাচ্ছে। সারা জাহানের সকল সুপেয় জলেও তার তৃষা মিটবে না জানা কথা। অল্প অল্প রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পানির সাথে মিশছে, আর সেই পানি নালার প্রানীদের প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে। তার চোখের সামনে একে একে সবাইকে জবাই দেয়া হয়েছে। মেয়েটির ধারনা ছিল, কণ্ঠনালী কাটলেই বুঝি গড়গড় করে রক্ত পড়তে শুরু করে। সে তার বাবার জবাই দেখেছে এক হাত দুর থেকে। কণ্ঠনালী কাটার পরেও লোকটা গোঁ গোঁ করে কিছু যেন বলার চেষ্টা করছিল। তারপর অপেক্ষাকৃত অহিংস এক মং এসে দেখিয়ে দেয় কিভাবে এক্সটারনাল ক্যারোটিড আর্টারি কাটতে হয় এবং তখনই প্রবল বেগে রক্তের ধারা জন্মভুমির মাটিকে মুহুর্তেই কলংকিত করে দেয়। পিতার রক্ত স্রোতে স্নাত হয়েছে কিশোরী কন্যা। একজন কন্যার জীবনে এরচে বড় বেদনার আর কি হতে পারে? কন্যা জানেনা বেদনা সবে শুরু। তার মা ধর্ষিত হবার মত আকর্ষনীয়া নারী ছিল কিনা সে জানে না। তবে নারী কিভাবে ধর্ষিত হয় তা সে প্রত্যক্ষ করেছে স্বচক্ষে; সেও নিজের মায়ের ধর্ষন.............. এসবের মাঝেই অসীম শক্ত মহিলা চিৎকার করে স্পষ্ট বাংলায় মেয়েকে বলেছে- পালা। যেভাবে পারিস পালিয়ে যা......
কাদা, পানি,,মাটি, সাপখোপ, জোক থেকে শুরু করে সব বাধা-ই তার শেষ হয়েছে। সে এখন নাফ নদীর তীরে। সম্ভবত ঘাট থেকে বহু দুরে। কারন, এখানে দ্বিতীয় কোন শরণার্থী নেই। ইঞ্জিন চালিত একটা ট্রলার এগিয়ে আসছে। তাকে দেখেছে সম্ভবত। জনা তিন ষন্ডা প্রকৃতির লোক অলস বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। ট্রলারের ঠিক মাঝখানে মাস্তুলের মত লম্বা কিছু একটা আছে। তার মাথায় পতপত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। হ্যা, এটি বাংলাদেশের ট্রলার এবং এরাই সেই সব লোক যারা তাদের বুকের কলিজাটা কেটে দিতে চেয়েছে অসহায় রোহিংগাদের জন্যে। সে জানে সেসব কথা। সত্য গোপন থাকে না। এদেশের মুসলিমেরা বার্মার বাস্তুহারাদের জন্য কি করছে তা সে যেমন টিভিতে দেখেছে, তেমনি দেখেছে বিশ্ব। মাগরেবের ওয়াক্তে সময় বড় কম। সে কি পবিত্র আছে? তবু সে প্রার্থনা করবে। পাচজনের একটা সুখী সুন্দর পরিবার একদা প্রান বাচানোর তাগিদে জংগলে ঢুকে পরেছিল। একজন মাত্র বেচে যাওয়ার সীমান্তে পৌছে গেছে। সেও কম নয়। হাজার হাজার পরিবার লাপাত্তা হয়ে গেছে। আল্লাহ তাকে আগুন ও পানিতে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে বাচিয়েছেন সম্ভ্রম সহ। আল্লাহর কাছে এই শোকরের কোন শেষ নেই। ছেড়া ফাড়া ওড়নাটা দিয়েই কোন রকমে সে তার চুলগুলো ঢেকে নিয়ে দু'হাত তুলল। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষন অথচ তার চোখেই কিনা প্লাবন শুরু হলো এই এখন- ' ওগো প্রভু, দয়াময়। তোমার কাছে এই বান্দির শোকরের কোন সীমা পরিসীমা নেই। বাচানোর মালিক একমাত্র তুমি। আমার পরিবারের সবাই চলে গেছে। এটা হয়ত তোমারই ইচ্ছা ছিল। তুমি আমাকে প্রানে বাঁচিয়েছ, ইজ্জত রক্ষা করেছ। তোমার প্রতি, আমার লাখো কোটি সেলাম। আমিন'।
অন্ধকার কেটে ট্রলার এগিয়ে চলছে। সাগরের ট্রলার গুলোতে সাধারনত কোন না কোন ধরনের চিমনির আলো থাকে। এখানে নেই অথবা জ্বালানো হয়নি। ট্রলারে উঠার বেশ কিছুক্ষন পর সে দেখেছে হাজার হাজার মানুষের আহাজারি। অথচ সেদিকে এই লোকগুলোর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মাঝ দরিয়ায় ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে মাঝি পিশাচের হাসি দিয়ে বলল- আম্মাজান, ইঞ্জিল ফেইল। সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হইবে। আমি আমার আম্মাজানের দুদু খাব......ঝুট ঝামেলা না কইরা চলেন চাইরজনে মিল্লা ফুর্তি করি!! কি কন ? দলের সবচে কম বয়সী ছেলেটা বলল- ওস্তাদ, আমি এর ফদ্দা ফাটামু। জীবনে কুনু মাইয়ার ফদ্দা ফাডাই নাই হি.. হি হি... হি হি হি.....
( কাল্পনিক )
কবিতালয়।