সিমির চারুকলায় শিক্ষা গ্রহণ ও এর অনুষঙ্গ হিসেবে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাওয়ার মতো ব্যয় বহন করা তাঁর অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মা-বাবা বক্তব্য অনুয়ায়ী, সিমি এজন্য তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকা ও সাজসজ্জার কাজ করতেন। বাড়তি এসব কাজের জন্য মাঝেমধ্যে বাসায় ফিরতে রাত হতো তাঁর। এ রকম পরিস্থিতিতেই উত্ত্যক্ত করার ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। বাসায় ফেরার পথে 'তন্বী জেনারেল স্টোর' থেকে মহল্লার মোফাজ্জল, দোয়েল, খলিলসহ আরো কয়েকজন রাতে বাসায় ফেরার সময় প্রায় উত্ত্যক্ত করত সিমিকে।
'রাত কইরা আসে ক্যান? সাথে পোলাপান লইয়া আসে, করে কী মাইয়াটা'_এ ধরনের টিজ করতে থাকে। একদিন ওড়না ধরেও টান দেয়। এসব ঘটনার কথা সিমি প্রায় বাসায় এসে বলতেন। সিমির বাবা সব শুনে বলতেন, 'ওদের জন্য তো পড়াশোনার কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। তুমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিও না।' কখনো আবার সিমির বাবা উত্তেজিত হয়ে ওদের মুখোমুখি হতে চাইলে সিমিই বাধা দিয়ে বলতেন, 'থাক, ওদের ঘাঁটিয়ে লাভ নেই।'
এভাবে দীর্ঘদিন সিমির ওপর বখাটেদের ওই আচরণ অব্যাহত থাকে। ২০০১ সালের ২১ ডিসেম্বর শুক্রবার পুরোদিন বাসাতেই ছিলেন সিমি। রাত ৮টার দিকে মাথাব্যথার জন্য তিনি নিজেই রাস্তার পাশের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে বের হন। তাঁকে দেখেই তন্বী জেনারেল স্টোরে বসে মোফাজ্জল ও আরো কয়েকজন টিজ করতে শুরু করে। মোফাজ্জল বলে, 'এত্তো স্বাধীনতা কই পাইছস? রাইতে ঘোরাফেরা করতে ডর লাগে না?' এ কথার উত্তর না পেয়ে মোফাজ্জল আবারও বলে, 'উত্তর নাই ক্যান? এই মহিলার মাইর খাওনের ইচ্ছা হইছে।' সিমি ওদের ওই আচরণের কথা বাসায় জানালে তাঁরউদ্বিগ্ন বাবা ঘটনাস্থলে যান। সঙ্গে সিমি ও সিমির ছোট ভাই সুমন। সেখানে তখনও ওরা ছিল। সুমন বলে, 'এই দোকানে কারা থাকে?' এ কথায় ওরা মারমুখী হয়ে ওঠে। সুমনকে মারতে উদ্যত হয়। সিমিকে লক্ষ্য করে বলে, 'ওকে ধর। বাজে মেয়ে। ওর চুল কেটে দে।' ওরা সিমিকে মারতে উদ্যত হয়। এ অবস্থায় আতঙ্কিত সিমির বাবা ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন এবং খুব মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। রাতে গোড়ানে এক অসুস্থ আত্দীয়কে তাঁর দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজে না গিয়ে সেখানে সুমনকে পাঠিয়ে দেন। সুমন বাড়ি থেকে গোড়ানের উদ্দেশে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসে কাপড়চোপড় ভেজা অবস্থায়। সে জানায়, তাকে ওরা মারধর করে পাশের ডোবায় ফেলে দিয়েছে। সিমির বাবা ওই রাতেই বখাটেদের অভিভাবকদের কাছে গিয়ে এর প্রতিকার দাবি করেন। থানায়ও যান। থানা থেকে পরামর্শ দেয়া হয়, 'পাড়ার বিষয়, বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই। মিটমাট করে ফেলেন।' পরদিন ২২ ডিসেম্বর সকালে দোয়েল আর খলিল বাসার নিচে এসে সুমনকে ডাক দেয়। খলিলের হাতে ছুরি আর দোয়েলের হাতে পিস্তলসদৃশ কিছু। সিমির বাবা তাদের দেখে প্রশ্ন করেন, 'তোমরা কি আজও আমার ছেলেকে মারতে এসেছো?' এ প্রশ্নের পর তারা সিমির উদ্দেশে নোংরা গালাগাল শুরু করে। সিমি এ গালাগাল সহ্য করতে না পেরে ছুটে যান এবং চড় মারেন দোয়েলকে। সিমির বাবা এ সময় ফিরিয়ে আনেন সিমিকে। ওরা ফিরে যাওয়ার সময় সিমির মুখে এসিড মারার হুমকি দিয়ে যায়। এরপর বেলা ৩টার দিকে সিমি তাঁর এক বান্ধবীর সঙ্গে বের হলে রাস্তায় মেডিপ্লাস ওষুধের দোকানের সামনে গিয়ে দেখেন, সেখানে খিলগাঁও থানার দারোগা বাশার বখাটে ওই সব ছেলেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মেডিপ্লাসের রিপনও ওদের সঙ্গে ছিল। ওরা সিমিকে দেখিয়ে দিলে দারোগা বাশার ধমক দিয়ে বলেন, 'এই মেয়ে তোমার বাসা কোথায়? তোমার ভাই সুমন আর তুমি খলিলকে কেন মেরেছ? খলিলের সাড়ে তিন হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে কোথায় রেখেছ?' দারোগা বাশার বখাটে ওই সব ছেলেসহ সিমিকে তাঁদের বাসায় নিয়ে আসেন। সিমির বাবা, মা ও বোনের বক্তব্য, ওই সময় দারোগা বাশার বাসায় এসে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন অবমাননাকর মন্তব্য করেন। বলেন, 'রাস্তায় বের হলে ছেলেরা মেয়েদের ওরকম কথা বলবেই। এতে প্রতিবাদ করা উচিত নয়। প্রতিবাদ করলেই বোঝা যায় মেয়েটি ছেলেটির প্রতি দুর্বল।' দারোগা বাশার সিমির বাবা-মাকে বলেন, 'ঘটনা মিটমাট করে ফেলুন। তা না হলে আপনার মেয়েকে হাতকড়া পরিয়ে সবার সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে থানায় নিয়ে যাবো।' দারোগা বাশার সেখানে উপস্থিত দোয়েলকে বলেন, 'আপনার অভিযোগটা সবার সামনে বলেন।' দোয়েলের অভিযোগ শুনে সিমি বলেন, 'চড় মেরেছি এটা অসত্য নয়। কিন্তু কখন একটা ছেলেকে একটা মেয়ে চড় মারতে বাধ্য হয়?' সিমির এ প্রশ্নে দারোগা বাশার বলেন, 'একটা ছেলে একটা মেয়েকে কিছু বলতেই পারে; কিন্তু মেয়েটি যখন ওই ছেলের গায়ে হাত তুলবে তখন বুঝতে হবে ওই ছেলের পুরুষত্বই নেই। এ ধরনের ঘটনা আমার ক্ষেত্রে ঘটলে আমি আত্দহত্যা করতাম।'
দারোগা বাশার সিমিকে পরামর্শ দিয়ে আরো বলেন, 'মেয়ে মানুষ যতই শিক্ষিত হোক, যতই পাওয়ারফুল হোক, তাকে একসময় পুরুষ মানুষের কাছে নত হতেই হবে। স্বামীর পায়ের নিচেই স্ত্রীর বেহেশত_এ কথাটা মনে রাখবা।' এসব কথা বলার পর দারোগা বাশার মহল্লার মুরবি্বদের মাধ্যমে বিষয়টি মিটমাট করে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে ফিরে যান। তিনি চলে যাওয়ার পর সিমি 'সমাহার' নামে একটি সমাজকল্যাণ সংস্থার কাছে ছুটে যান। সংস্থার প্রধান সালেহা বেগমকে সবকিছু জানিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করেন।
পরদিন ২৩ ডিসেম্বর মিটমাটের জন্য পাড়ার কথিত মুরবি্ব এনায়েত চৌধুরীসহ কয়েকজন সিমিদের বাসায় হাজির হন। তাঁরা ঘটনার জন্য সিমিকেই দায়ী করে সন্ধ্যার পর তাঁকে আর বাসার বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিলে সিমি বলেছিলেন, 'আপনারা বুঝতে চাচ্ছেন না চারুকলায় পড়তে হলে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর কী পরিমাণ টাকা লাগে। ঠিক আছে, আপনাদের আপত্তি থাকলে আমি ঘরেই থাকব। আমাকে মাসে ১০ হাজার করে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। পড়ার খরচ জোগানোর জন্য আর কোনো কাজে যাব না।' সিমির এ কথায় কথিত মুরবি্ব এনায়েত চৌধুরী ধমকে বলেছিলেন, 'এই মেয়ে, আমাদের ঘরে কি মেয়ে নেই? তাদের সম্পর্কে তো কোনো কথা হয় না! শুধু তোমাকে নিয়েই এত কথা কেন?' এনায়েত চৌধুরীর এ ধমকে থেমে যান সিমি। কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলেন, 'তাহলে আর কোনো বিচারের প্রয়োজন নেই। সবাইকে আমি শান্তি দিয়ে যাব। কারো মাথাব্যথার কারণ হবো না।' এ কথা বলেই নিজের রুমে চলে যান সিমি। রুমের দরজা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর তাঁর রুম থেকে যখন বমির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, বিষের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল, তখন মহল্লার কথিত মুরবি্বদের হন্তদন্ত অবস্থা। 'গেট খুলে দাও, আমাদের যেতে দাও' বলে তারা পালাতে থাকেন।