২৯ মার্চ ১৯৮৪ সালে তিউনিসিয়ার কোনো এক অঞ্চলে মুহাম্মদ বুআজিজির জন্ম। ৩ বছর বয়সে বাবা মারা যান। ১০ বছর বয়সে বালক অবস্থায় তিনি ফুটপাতে ফলমূল ও শাক-সবজি বিক্রি করতেন। বাকি দশ জন যুবকের মত তারও স্বপ্ন ছিল সামান্য চাকরি, রুটিরুজির ন্যূনতম অবলম্বন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরির আশায় ঘুরে বেড়িয়েছেন দ্বারে দ্বারে। ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় মাস ও বছর পেরিয়ে দেখা পাননি চাকরি নামের সোনার হরিণের। শেষপর্যন্ত তিনি আবার পথে নামেন। সামান্য পুঁজি ধার করে স্থানীয় বাজারে ও অলিতে-গলিতে কখনো সবজি আবার কখনো ফল বিক্রি করতেন। এতে যৎসামান্য উপার্জন হতো, বৃদ্ধা মায়ের মুখে তুলে দিতে পারতেন দু'মুঠো আহার। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তিউনিসিয়ায় ফুটপাত হোক বা কর্পোরেট— সব ব্যবসায় সরকারের অনুমোদন লাগে। বুআজিজির এ ধরনের কোনো অনুমোদন বা ট্রেড লাইসেন্স ছিল না। সরকারি দফতরে ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স তৈরির সামর্থ্যও ছিল না।
১৭ ই ডিসেম্বর ২০১০ সালে বুআজিজি তিউনিসিয়ার সিদি বুজিদ শহরে ফল বিক্রি করছিলেন। এমন সময় ঘুষের জন্য পৌরসভার নারী পুলিশ ইন্সপেক্টর ফাইদা হামদি সাথে কথা কাটাকাটি বেধে যায়। একপর্যায়ে ইন্সপেক্টর বুআজিজির সকল পণ্যসহ ঠেলাগাড়িটি আটক করে নিয়ে যায়। বুআজিজি তার পণ্যসহ গাড়িটি ফিরে পেতে অনেক অনুনয় বিনয় করে। কিন্তু তাতেও মন গলে না নগর কর্তৃপক্ষের। ঋণ করে যা যোগার করেছিলেন পুলিশ তার সবটুকুই কেড়ে নিল। বেঁচে থাকার সবকটি পথ তারা বন্ধ করে দিল।
নানা লাঞ্ছনা বয়ে নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করা ২৬ বছর বয়সী বুআজিজি বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। বাজার থেকে পেট্রোল এনে নিজেকে জ্বালিয়ে দেন সরকারি ভবনের সামনে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে এরচে জোরালো প্রতিবাদের ভাষা আর তার জানা ছিল না বুঝি! সিদি বুজিদের এই আগুন শুধু আজিজির দেহই পুড়িয়ে দেয় নি। তার শরীরের সেই আগুনের খবর দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে সেই আগুনের আঁচ লাগে সবার আগে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে আরব বিশ্বসহ সমগ্র বিশ্বে। ইতিহাসের পাতায় এই দাবানলের নাম হয়ে দাঁড়ালো 'আরব বসন্ত'। তিউনিস জনতার হৃদয়েও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছিল মুহুর্তে। চাপা ক্ষোভ-ক্রোধ আর পুঞ্জিভূত ঘৃণার দাবানল সহসা জাগিয়ে তুলছিল তিউনিসবাসীকে। ইতিহাসের নতুন যাত্রার সেই শুরু মানুষের পৃথিবীকে এক নতুন গন্তব্যের ঠিকানা চিনিয়ে দিলেন একদিন আগেও অপরিচিত একজন আজিজি।
এখানে আজিজি গায়ে আগুন লাগিয়েছিলেন
আজিজির মত একই শহরের অন্য এক যুবক বৈদ্যুতিক তার গায়ে পেঁচিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার পর পুরো তিউনিসিয়া আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে। বাঁচা-মরা কবুল করে স্বৈরাচারী নিপীড়কের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে জনগণ। ২০১০ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর গায়ে আগুন দেন আজিজি। আগুনে ঝলসে গেলেও তাৎক্ষণিক মারা যাননি তিনি। ১৮ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ৪ জানুয়ারি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আজিজি। এর দশ দিনের মাথায় তিউনিসিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায় নিপীড়ক-শাসক বিন আলি।
আরব বিশ্বকে জাগিয়ে তোলার মহানায়ক বুআজিজিকে হারিয়ে কাতর নন তার মা মানুবিয়া আজিজি। তিনি মনে করেন তার ছেলে তাবৎ বিশ্বের সন্তান। আজিজির এই আত্মহনন শুধু আরব নয়; বরং সারাবিশ্বে ধাক্কা লাগে। তিউনিসিয়ার বিপ্লবের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মিশরে। গনআন্দোলের তীব্র প্রবাহ আঘাত হানে লিবিয়া ও ইয়েমেনে।বর্তমানে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম চলছে সিরিয়ায়। আজিজির মা 'দ্যা সান' পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ছেলের জন্যে আমি গর্বিত, এখন আরও বেশি গর্ব অনুভব করছি। মুহাম্মদ বুআজিজি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে গোটা আরববিশ্বে স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজিজি আমাদের জাতি ও গোটা বিশ্বকে জাগিয়ে তুলেছে। সে আমার একার সন্তান নয়; গোটা বিশ্বের সন্তান।’
পৈতৃক সিভি সালার মাটিতে চিরশয্যায় শায়িত আছেন আজিজি। এই মহানায়কের কবরের পাশে উড়ছে তিউনিসিয়ার লাল পতাকা।
তথ্যসূত্র:
–সাঈদ মুহাম্মদ আবরার, শ্বেত সন্ত্রাসের এই সময়
–https://www.britannica.com › Moha...
Mohamed Bouazizi | Tunisian street vendor and protester | Britannica
–www.middleeastmonitor.com
Remembering Mohamed Bouazizi and the start of the Arab Spring
–www.middleeasteye.net
'He achieved nothing': Bitter legacy of Tunisian vendor who sparked uprising
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:০২