বর্তমানে ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়ার অপতৎপরতায় সামাজিকভাবে ইসলাম প্রমোট করলে পাকিস্তানি রাজাকার বলে অবিহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক টিভি-সিরিয়াল ও উপন্যাসগুলোতে রাজাকারদের ইসলামী রঙ চড়িয়ে ইসলামকে জনসাধারণের কাছে বিরূপভাবে উপস্থাপন করা হয়। তবে এর বাস্তবতার দৌঁড় কতটুকু সেটাই আলোচনা করব এই নিবন্ধে।
উত্তাল শ্রোতের বিপরীতে অবস্থান:
পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা আর জুলুমের মোকাবেলায় যখন প্রায় পুরো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনে ঐক্যবদ্ধ তখন ক্ষুদ্র এক শ্রেণী শ্রোতের বিপরীতে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেন। মোটাদাগে এর তিনটি কারণ পাওয়া যায়।
১. প্রায় সবকটি ইসলামী দলের কেন্দ্রীয় দলের কর্মস্থল ছিল পাকিস্তানে। যেমন জামায়েতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়িদ আবুল আলা মওদুদি পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেন এবং সেখান থেকে দল পরিচালনা করতেন। সুতরাং সাধারণভাবেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ অগ্রাধিকার দিতেন এবং সবকিছুই সে দৃষ্টিতে দেখতেন। আর এসবই আমিরের আনুগত্যের নামে তার এদেশীয় কর্মীরা অন্ধভাবে মেনে নেওয়া স্বাভাবিক।
২. পীর-মুরিদী। যেমন নেজামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আতহার আলী ছিলেন হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ-এর বিশেষ স্নেহধন্য মুরিদ ও খলিফা। মাওলানা থানভী ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা আর মুরিদরা সাধারণত পীরের নির্দেশই পালন করে থাকে। এর একটি উদাহরণ ‘আশরাফ আলী থানভীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো।
“উপমহাদেশে দেওবন্দি ওলামাদের মধ্যে আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর ভক্ত, মুরিদ ও মুতাআল্লিকীনদের সংখ্যা লাখ লাখ। একথাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে মুরিদ ও মুতাআল্লিকীনদের কখনও পীর ও মুর্শিদের বিপরীত পক্ষে মতামত দেন না। পাকিস্তান ও অখন্ড হিন্দুস্তানের বিষয়টি কেন্দ্র করে যখন উলামাদের মধ্যে মত-বিরোধ তুঙ্গে উঠে তখন উপমহাদেশের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান, মুরিদ ও মুতাআল্লিকীন মাওলানা থানভীর কাছে রাজনৈতিক প্রশ্নে কোন পক্ষ অবলম্বন করা উচিৎ তা জানার জন্য চিঠি ও যোগাযোগ আদান-প্রদান শুরু করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাওলানা থানভী সুস্পষ্টভাবে মুসলিমলীগের পক্ষে ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য মুরিদ ও মুতাআল্লিকীনদের পরামর্শ দেন। তাঁর নির্দেশে মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী, মুফতি মোহাম্মদ শফি, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ প্রমুখ উলামায়ে কেরাম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।”একাত্তরে ঠিক এই কারণে কিছু কিছু আলেম ও তাদের ভক্ত-মুরিদরা জালেম পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে।
৩. ইসলামী হুকুমত কায়েমের অলীক কল্পনা। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কালেমার স্লোগান নিয়ে। অর্থাৎ এদেশে কুরআনের আইন চালু হবে। শুধু এই আশায়ই এদেশের অসংখ্য-অগণিত আলেম নিজদের সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠায় প্রভূত ভূমিকা রেখেছেন৷ ইসলামী রাষ্ট্র তো কায়েম হয়ই নি বরং দীর্ঘ ২৪ বছর আমাদের আমাদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ দেখেও তাদের চৈতন্যেদ্বয় হয়নি। যাদের মধ্যে ন্যূনতম মানবিকতা নেই তাদের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের আশাকরা যায় কি করে? এমনই এক স্বপ্নচারী আলেমের একটি ঘটনা 'বৃহত্তর মোমেনশাহী উলামা ও আকাবির' গ্রন্থ থেকে নেওয়া। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ইত্তেফাকুল উলামা বৃহত্তর মোমেনশাহীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী।
“১৯৭০ সন রমজান মাস। পাকিস্তান পরিষদের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন পরিষদ নির্বাচন। জোর প্রস্তুতি চলছে। ছোট বাজার ও স্বদেশী বাজার মোড়ে বিকেল বেলায় মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.-এর সাথে আমার দেখা। পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জয়েন্ট সেক্রেটারি মাওলানা আরিফ রব্বানী রহ. মোমেনশাহী সদর ও মুক্তাগাছায় সম্মিলিত আসনে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন করছেন। সেই নির্বাচনী পোস্টারের এক গাদা তাঁর কাঁধে।
জিজ্ঞাস করলাম, 'মিয়া ভাই! এই বুড়ো বয়সে এত বড় বোঝা বইছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, 'বিজয়ের সম্ভাবনা দিয়ে কি করি। আল্লাহর দীন কায়েমের অঙ্গীকার নিয়ে যে পাকিস্তানের জন্ম হলো তার বাস্তবায়ন আজও হয় নি; এর জন্য কোশেশকারীদের অংশীদার হবার জন্যই এ বোঝা বহন করছি। বিজয়ী হলাম কি হলাম না, হাশরের ময়দানে নিশ্চয় এ প্রশ্ন করা হবে না। কোশেশ করে যাচ্ছি। এতটুকুই কি আমার জন্য যথেষ্ট নয়।' যুক্তির ক্ষেত্রে তিনি পরপারে চলে গেছেন বুঝতে পেরে কেটে পড়লাম। সামনে প্রশ্ন করার আর কোনো সুযোগ ছিল না বলে চুপ করে গেলাম।”
ইসলাম সব সময়ই মজলুমের পক্ষে:
মানবতার ধর্ম, সাম্যের ধর্ম ইসলাম সবসময়ই মানবতার পক্ষে থেকেছে। একাত্তরে আমরা ছিলাম মজলুম আর পাকিস্তানীরা ছিল জালেম। ত্রিশ ভাগ ইসলামপন্থী সেদিন জালেমের পক্ষাবলম্বন করলেও বাকি সত্তর ভাগই মজলুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী যেমন তার পশ্চিম পাকিস্তানী গুরু আবুল আলা মওদুদীর নির্দেশে জালেমের পক্ষ নিয়েছিল। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মত সংগঠনের মত সংগঠন পশ্চিম পাকিস্তানের হাই কমান্ডের নির্দেশে মজলুমের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। ইতিহাস থেকে এ সত্য কি মুছে ফেলা যাবে? পশ্চিম পাকিস্তান জমিয়তের সেক্রেটারি মুফতি মাহমুদ ২৬ শে মার্চের আগে স্বয়ং ঢাকা এসে এ অংশের নেতৃবৃন্দদের বলে গিয়েছিলেন, 'আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলুন, দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করুন।'
অপরদিকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ-এর বিশেষ খলিফা মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর একাত্তরে মাতৃভূমির পক্ষেই ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তার ভক্ত ও মুরিদদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আলেম মুক্তিযোদ্ধা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারী বলেন, "আমি হাফেজ্জী হুজুরের খুব ভক্ত ছিলাম। যুদ্ধ চলাকালীন অনেক ছাত্র ট্রেনিং নিচ্ছিল। আমি হাফেজ্জী হুজুরের কাছে পরামর্শ চাইলাম। আমিও ট্রেনিংয়ে যাবো কিনা? তিনি আমাকে বললেন, "পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর অত্যাচার করছে। সুতরাং তারা জালেম। জুলুম আর ইসলাম কখনো এক হতে পারে না। তুমি যদি খাঁটি মুসলমান হও, ইসলাম মানো তবে পাকিস্তানিদের পক্ষে যাও কীভাবে? এটা তো ইসলামের সাথে কুফরের যুদ্ধ নয় বরং এটা হলো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। বাঙালিরা মজলুম সুতরাং বাঙালিদের পক্ষে কাজ কর।' আমার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার পেছনে এটা মূল উৎস-প্রেরণা।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে:
একাত্তরে কি শুধু ইসলামপন্থীরাই রাজাকার ছিল— এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দুইটি গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে— ১. ড. আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ্জামান ও শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত 'মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র' থেকে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' এবং ২. রমেন বিশ্বাস সংকলিত নাইমুল ইসলাম খান সম্পাদিত দৈনিক আজকের কাগজে প্রকাশিত 'ঘাতকের দিনলিপি'(পরে এই নামেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত)। 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' গ্রন্থের ৮৫-৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে,
“আমাদের জাতি সত্তার উন্মেষে যে দুইজনকে স্থপতি বলে ধরা হয় তারা হচ্ছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। এদের সন্তানরাও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহনীর গণহত্যাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী কন্যা আখতার সোলায়মান একজন মুখ্য স্বাধীনতাবিরোধী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সক্রিয় সহায়তা প্রদান ছাড়াও তিনি আওয়ামীলীগের বিশ্বাস ঘাতক নেতৃবৃন্দ নিয়ে একটি নতুন দল এবং রাজাকার বাহিনীর অনুরূপ একটি সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
শেরে বাংলার ছেলে প্রাক্তন মন্ত্রী একে ফায়েজুল হকও ছিলেন একজন মুখ্য স্বাধীনতা বিরোধী। স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস তিনি পাকবাহিনীর গণহত্যার সমর্থন সংগ্রহের জন্য সারাদেশে সফর করে বেড়িয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকার প্রমাণ দেবার জন্য ১১ ই এপ্রিলে তার দেওয়া বিবৃতির অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো,
' আমি পূর্ব পাকিস্তানি ভাইদের আমাদের উপর এবং প্রশাসন যন্ত্রের উপর আস্থা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। যারা এখনো কোনো কারণবশত কিংবা কোনোমহে পড়ে কাজে যোগদান করেননি, তাদের আমি শুধু বলবো সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে এবং আমরা যদি আমাদের নিজেদের সঠিক পথে ফিরে যাই তাহলে প্রত্যেকটি মিনিটের নিজেস্ব একটি মূল্য রয়েছে।'
শেরে বাংলা কন্যা রইসী বেগমও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছেন। সে সময় প্রদত্ত বহু সংখ্যক বিবৃতির একটির অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধৃত হল। এই বিবৃতিটি তিনি ২ মে তারিখে দেন—
'১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের ৭ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির জন্য মুক্তির দিন। এদিনে আমরা এক উগ্র মতবাদ থেকে মুক্তিলাভ করেছি। এই মতবাদ ইসলাম ও পাকিস্তানি আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে— পাক সীমান্তের অপর পারে সংঘবদ্ধ সাহায্য পুষ্ট ও প্ররোচিত মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহীর দ্বারা আমরা সন্ত্রস্ত ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিলাম, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ নির্যাতিত অসংখ্য মুসলমানদের প্রার্থনা আল্লাহ শুনেছেন এবং পাকিস্তানের আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি আমাদের অদম্য সশস্ত্র সেনানীদের সালাম জানাই।'
একই গ্রন্থে ৮৩ পৃষ্ঠায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা বিশুদ্ধনান্দ মহাথেরা সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে,
“প্রেম ও অহিংসার বাণী নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন মহামানব গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মে অহিংস হলো পরম ধর্ম অথচ বাংলাদেশের গনহত্যার সমর্থনে দালার মওলানাদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা বিশুদ্ধনান্দ মহাথেরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস বিশুদ্ধনান্দ মহাথেরা পাক সেনাদের কার্যকলাপকে অভিনন্দন জানিয়ে বহু বিবৃতি দিয়েছেন। পাকসেনার জন্য সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান সফর করেছেন। ৬ মে তারিখে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান ও লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ”
১৩৯-৪০ পৃষ্ঠায় 'দালাল বুদ্ধিজীবীদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন' এই শিরোনামে উল্লেখিত হয়েছে— ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মীর ফখরুজ্জামান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নায়ক জেনারেল রাও ফরমান আলীর মেয়ে তার বিভাগের ছাত্রী ছিল। সেই সূত্রে রাও ফরমান আলীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার মুখ্য সহচর হিসেবে কাজ করেন।’
১২১ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে— ‘বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের একশ্রেণীর শিক্ষকও পাক বাহিনীর দালালিতে তৎপর ছিল। তেজগাঁও কলেজের অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী এধরনের স্বাধীনতাবিরোধী শিক্ষকদের একটি দৃষ্টান্ত হতে পারেন।’
১৪২ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে—
‘একশ্রেণীর সাংবাদিকও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এদের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক খোন্দকার আব্দুল হামিদ উল্লেখযোগ্য। ’
এবার 'ঘাতকের দিনলিপি' থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেখে নেওয়া যাক— “২৫ জুলাই সোমবার: আওয়ামীলীগের টিকেটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এস বি জামান আজ পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদ সম্মেলনে বলে, '৬ দফা বর্তমানে কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদীর মাথায় রয়েছে।' তিনি তিনি দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী সদস্য এবং ভাসানী, আতাউর রাহমান ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'এরা পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। নকশালপন্থীরাও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি এসব 'তথাকথিত বাংলাদেশ' সমর্থকদের বিচার দাবি করেন।
এস বি জামান জানান, 'বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ১০৯ এমপিএ এবং ৭০ জন এমএনএ জহিরুদ্দীনের নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে একটি নতুন দল গঠন অথবা পিপলস পার্টিতে যোগ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।' তিনি এ সফর কালে ভূট্টোর সঙ্গে দু'দফা সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে জহিরুদ্দীনের একটি পত্র দেন বলে জানান। -১৩৩ পৃষ্ঠা (সূত্র:দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ, পূর্বদেশ ও সংগ্রাম ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই ১৯৭১)
“২ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার: এদিন আওয়ামীলীগের হালুয়াঘাট থানার ভাইস প্রেসিডেন্ট এডভোকেট হাকিম আলী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে যারা নিরীহ জনগণের শান্তি ভঙ্গ করেছে তাদের কার্যকলাপে নিন্দা করেন।”- ১৭১ পৃষ্ঠা (সূত্র:দৈনিক পাকিস্তান ও সংগ্রাম ৩ এবং ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)
“৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার: নেত্রকোনার ৪ জন আওয়ামীলীগ নেতা এ সময় দল ত্যাগ করে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগীর খাতায় নাম লেখায়। এরা হলেন নেত্রকোনা থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম খান, কালিয়ালাত ইউনিয়ন শাখার সেক্রেটারি ডা. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, শহর শাখার সদস্য সোহরাব হোসেন ও মহকুমা আওয়ামীলীগের সদস্য এমদাদুল হক।” -১৭৮ পৃষ্ঠা (সূত্র:দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ ও সংগ্রাম ৯, ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)
প্রদত্ত তথ্যগুলো জামায়াতপন্থী বা ইসলামপন্থী লেখকের ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন যুদ্ধের অবস্থা। জামায়াতের সল্প সংখ্যক মানুষের পাকিস্তান প্রবনতা ছিল তাদের দল প্রীতির দরুন। কিন্তু বাঙালি জাতি সত্তার স্থপতির সন্তানরা যখন পাকিস্তানপন্থী তখন তাদের ব্যাপারে কোনো আলোচনাই নেই। খোদ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামীলীগের বহু নেতা পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে নিরীহ বাঙালিদের উপর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে মিডিয়াতে তার কোনো আলোচনা নেই কেন? মিডিয়ার এমন দ্বৈতনীতি রীতিমতো হাস্যকর। এত করে খুব ভালোই বোঝা যায় যে ইসলামপন্থীদের জামায়াতি, পাকিস্তানি ও রাজাকার ট্যাগ দেওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয়।
'আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক শাকের হোসাইন শিবলি বলেন, 'অনেকটা কৌতূহল নিয়েই দৈনিকগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম রাজাকার বলে কথিত মোল্লা-মৌলভিদের মধ্যে যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা থেকে থাকে তারা যেন যোগাযোগ করেন। সারা দেশে এমন বিপুল সংখ্যক আলেম মুক্তিযোদ্ধা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। আমার কল্পনাকেও তা হার মানিয়েছে। গেরিলা কমান্ডার, মুজিব বাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডার, গেরিলা যোদ্ধা, সশস্ত্র যোদ্ধা, গোয়েন্দা মুক্তি যোদ্ধা, বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তিযোদ্ধা সবই আছেন এই তালিকায়। সেদিন বহু পীর-মাশায়েখ, মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, তাবলীগ আমীর সাধারণ তাবলিগি হাফেজে কুরআন শুধু মাতৃভূমির টানে নরপশু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।'
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২১ রাত ৮:৪০