আকাশ কালো করে আছে। খুব কালো। মনে হচ্ছে ঝুম একটা বৃষ্টি হবে। এরকম আবহাওয়া খুব ঝামেলা সৃষ্টি করে। মানুষ যা প্রাণপণে ভুলে থাকতে চায় তা মনে করিয়ে দেয় এরকম কালো করে থাকা আকাশ। নিজের সাথে সাথে যেন সে বাকি সবাইকেও কাঁদাতে চায়। তাও মানুষ কাঁদে না। বিষণ্ণ হয়। যেমন রীতার মনটা এই কালো করে আকাশটা দেখে বিষণ্ণ হয়ে গেল।
যতক্ষণ অফিস করে কোন অসুবিধা হয় না। অফিস থেকে বের হলেই মনটা যেন একটু ভার ভার ঠেকে। সেটাকেও না হয় পাত্তা না দিয়ে থাকা যায়। কিন্তু এরকম কালো করে আসা আকাশকে ঠিক কীভাবে অগ্রাহ্য করা যায় তা জানে না রীতা।
রীতা তাঁর জীবনটায় কোন ফাঁকা জায়গা রাখতে চায়নি। সবসময় যেন কিছু না কিছুতে ব্যস্ত থাকা যায়। যেন কখনো নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে না হয়। কখনো যেন ভুলেও নিজেকে প্রশ্ন না করে ফেলে, “কেমন আছ রীতা?” এই প্রশ্নকে সে ভয় পায়। মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তরটা তাঁকে ভোগাবে। সে ভুগতে চায় না। সে পালাতে চায়। কিন্তু নিজের থেকে পালানো কি এতই সোজা? সোজা না। বরং বলা যায়। অসম্ভব। তারপরো দৌড়াতে থাকে রীতা। এই দৌড়ে তাঁর অফিস তাঁকে অনেক সাহায্য করে।
রীতার অফিসটা বেশ মজার। একই বয়সের অনেক লোক। অনেকগুলা গ্রুপ করা আছে। রীতার গ্রুপে লায়লা, রিয়ন, রাইয়ান আর তানিহা। এক এক গ্রুপের এক এক আসাইনমেন্ট। যার যার কাজের জন্য বাজেট জমা দিতে হয়। বাজেট এর মধ্যে করে যদি টাকা বাঁচে তাহলে সে টাকায় ধুমসে খাওয়া দাওয়া হয়। এক এক কাজের পর এক এক জায়গায় তারা খেতে যায়। খুব হাসে রীতা। যেন অনেক হাসলে ভিতরের যে আরেক রীতা থাকে সেও খুশি হয়ে যাবে। কত ছবি ওঠে তাঁর। তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবি ট্যাগ হতে হতে ভরে গেছে। সবগুলো ছবিতে তাঁর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত থাকে।
গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সে পুলককে খোঁজে। ফেসবুকে। কোথাও পায় না। পুলক তাঁকে ব্লক করে দিয়েছে। তারপরো খোঁজে। কেন যে খোঁজে তা নিজেও জানে না রীতা। এই মানুষটাকে ভুলে যেতে পারলেই সবদিক থেকে শান্তি।
কিন্তু কিভাবে ভুলবে রীতা!! তাঁর জীবনের প্রত্যেকটা পরতে পরতে পুলকের কোন ছোঁয়া আছে। তাঁর প্রথম প্রেমিক পুলক। তাঁর একমাত্র আত্মার বন্ধু পুলক। তাঁর সব দুঃখ কষ্টের একমাত্র যে সাক্ষী সে পুলক। কিন্তু তারপরো সে পুলককে অপমান করেছে। দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিটা রাতে তাঁর এই কথা মনে হয়। বুকটা গ্লানিতে ভেঙ্গে যায়। কেউ জানবে না এই কষ্ট। পুলকও না। যে পুলক তাঁকে এত বুঝে সেও জানবে না যে এই রাত তাঁকে কত অসহায় করে তোলে। এই কষ্টের কোন যুক্তি নেই। এই কষ্টের কোন আশ্রয় নেই। অপরাধীর কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করায় সে। কেউ তাঁকে নিরপরাধ বলে না। সবাই যেন তাঁর দিকে আঙ্গুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে সে কিচ্ছু বলতে পারে না। তাঁর কী বলার কিছু আছে!! নাকি থাকা উচিৎ!! আচ্ছা!! পুলকের কী ওঁর কথা মনে হয়!! ও কী একবারো রীতার কথা ভাবে? পুলক কী রীতাকে ঘেন্না করে!! ভাবতে ভাবতে যেন বুকের মধ্যে পাথর জমা হয়। এই পাথর নিয়েই শুয়ে পড়ে রীতা।
এরপর আবার সকাল হয়। একটা নতুন দিন। সবকিছু নতুন করে শুরু করার আরেকটা সুযোগ। শুধু এই সুযোগ রীতার নেই। তাঁকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে পাথর সমান বোঝা। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয়-তাহলে কী তাঁর মায়ের তাবিজই কাজ করল। পুলক আর রীতার এক হওয়া তো হল না।
মিতাকে স্কুলে নামিয়ে রীতা অফিসে চলে যায়। স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যায় মা। নাজমা হক ছেলের খোঁজে আছেন রীতার জন্যে। ছেলে পাওয়া এক বিশাল ঝামেলার ব্যাপার। মিতাকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় সব মেয়েদের মায়েদের সাথে তাঁর আলাপ হয়। গৃহিণীদের জন্য এই সময়টা যে কত আনন্দের তা পৃথিবীর আর কেউ মনে হয় বুঝবে না। এর বাড়ির গল্প। ওঁর বাড়ির গল্প। কার মেয়ে কোথায় কোচিং করছে। কার কাছে কোন স্যারের নোটটা পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল বাসায় দেখা ইন্ডিয়ান সিরিয়ালগুলোর অ্যানালাইসিস এখানে বিশদভাবে হয়। কোন ভাবী যদি বাই চান্স কোন একটা পর্ব মিস করেও থাকে। কোন সমস্যা নেই। আশেপাশের ভাবীরা যে বর্ণনা দিবে তা সিরিয়াল দেখার চেয়ে কম লোমহর্ষক হয় না।
এছাড়াও আরো কিছু আলাপ হয়। এই ভাবীদের মধ্যে কেউ খাবারের ব্যবসা করে। কেউ বুটিক চালায়। কেউবা এর ওঁর বাড়ীর সুযোগ্য পাত্র-পাত্রীর খোঁজ রাখে। এরকমই একজন হলেন গুলশান আরা। তাঁর মেয়ে ক্লাস টু তে পড়ে। কিন্তু তিনি সব নাইন টেনে পড়া মেয়েদের মায়েদের কাছে সুযোগ্য পাত্রের খোঁজ নিয়ে যায়। সবার কাছে তিনি যায় না। যেসব বাড়ির মায়েরা মেয়েরা একটু রক্ষণশীল। তাঁদের কাছে তিনি যায়। এদের সাথে কথা বলেই তিনি মজা পান। এদের বাসার পুরুষরাই হয় বাড়ীর নীতিনির্ধারক। তাঁরা খুব ধর্মভীরুও হন। মেয়ে নাইনে উঠল কী উঠল না আশেপাশে ছেলে দেখা শুরু করে।
রীতা মিতার মা নাজমা হক গুলশান আরার সাথে কথা বলবেন ঠিক করলেন। বিয়ে অনেক ঝামেলার ব্যাপার। অনেক জায়গায় বলে রাখা হলে তারপর কিছু ভালো পাত্র কপালে জোটে। এখনো নাজমা হকের টাঙ্গাইলের সেই ডাক্তার পাত্রের জন্য মনটা হু হু করে ওঠে। কোথাকার কোন এক ফালতু ছেলের সাথে ঘুরার জন্য ওই রকম একটা ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেল। কী আর করা যাবে!! যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে তো বসে থাকলে তো হবে না। চেষ্টা করে যেতে হবে।
তিনি গুলশান আরার কাছে গেলেন।
-কেমন আছেন আপা?
গুলশান আরা পান খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মুখে পান ঢুকিয়ে চাবাতে চাবাতে বলল,
-আসসালামু আলাইকুম আপা। আল্লাহ যেরকম রাখসে আপা।
একটু অবাক হয়েছে গুলশান আরা। নাজমা হক তাঁর কাছে কী চায় ঠিক বুঝতে পারছেন না। এদের মেয়ে মিতা এবার টেনে উঠেছে। দেখতে সুন্দরী। একটু দুরন্ত। কিন্তু এই পরিবারের তো এত জলদি মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বলতে আসার কথা না!! তাও মুখে কোন অবাক ভাব দেখায় না সে। বিগলিত ভঙ্গিতে বলে,
-তা আপা আপনি বলেন কেমন আসেন!! মিতার কী অবস্থা!! মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল আপা।
-হ্যাঁ। তা তো ঠিকই।
অনেক রোদ উঠেছে। কিছুক্ষণ পরেই ছুটি হয়ে যাবে। তখন একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তিনি গুলশান আরাকে আলাদা নিয়ে যায়। রীতার কথা বলে। এমনকি তিনি এও বলেন যে আগেরবার এক বাজে পাত্রের পাল্লায় পড়ে তাঁকে অনেক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এবার তিনি সেরকম ঝামেলা চান না। এতক্ষনে গুলশান আরা আশ্বস্ত হয়। যাক!! বড় মেয়ের কথা বলতে আসছে। মানুষ চিনাতে তাঁর ভুল হলে খুব অশান্তি হয় গুলশান আরার। এখানে যে ভুল হয় নাই এটা প্রমাণ হয়াতেই তাঁর শান্তি লাগছে।
-আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাবি। আমি কালকেই আপনার বড় মেয়ের জন্য পাত্রের বায়োডাটা নিয়ে আসব। তবে আপনার মেয়ের যে একটা ছবি লাগবে। আর ওঁর বায়োডাটা টাও হলে ভালো হয়। কালকে নিয়ে আসেন।
কিন্তু নাজমা হক বায়োডাটা সাথে করেই নিয়ে আসছেন। এই বছরে রীতার বিয়ে না দিলেই না।
ছুটির দিনে মাঝে মাঝে মিতা বান্ধবীদের বাসায় বেড়াতে যায়। তখন মিতাকে আনা নেয়ার দায়িত্ব রীতাকেই নিতে হয়। মিতার বান্ধবী তানিশাদের বাসা ধানমন্ডির দিকে। পার্কটার সাথে লাগানো। খুলে দিল তানিশার বড় বোন। মেয়েটা খুব ফ্যাসনেবল। এক এক দিন এক এক রকম চুলের স্টাইল। অঙ্গভঙ্গিতেও ন্যাকা ন্যাকা ভাব প্রবল। এর কাছ থেকেই মিতা Pout ভঙ্গিতে ছবি তোলা শিখেছে। তার খারাপ লাগে না এসব ন্যাকামি। মিতার পাগলামি তার ভালোই লাগে। হয়তো নিজে যা করেনি তাই মিতার মধ্যে দেখে খুশি হয় রীতা।
তানিশার বড় বোনের নাম প্রিয়াঙ্কা। প্রিয়াঙ্কার ঘরে গিয়ে বসল রীতা। মিতা তানিশার রুমে। রুম আটকিয়ে ওরা গল্প করছে। প্রিয়াঙ্কা ওঁদের ডাকতে গেল। ওঁদের খুব গোপন কথা থাকে। রুম না আটকালে হয় না।
প্রিয়াঙ্কার ঘরে পিঙ্ক কালারটার প্রাধান্য বেশি। পুরা ঘরের বেডশিট, পর্দা, কার্পেট সব কিছুর মধ্যেই পিঙ্কের কোন না কোন শেড আছে। ওঁর কম্পিউটারটা খোলা। ফেসবুক এর পেজ ওপেন করা। কৌতূহলবশত রীতা উঠে একটু দেখতে গেল। কাউকে মেসেজ পাঠাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা।
রীতা চমকে তাকাল। পুলক।
প্রিয়াঙ্কা পুলককে মেসেজ করছে।
-পুল!! Why don’t you answer me!! I want to meet you.
পুলকের প্রোফাইল পিকচার টার দিকে তাকিয়ে আছে রীতা। কতদিন পুলককে দেখেনি সে। তৃষিত নয়নে সে তাকিয়ে রইল।
কোথা থেকে প্রিয়াঙ্কা দৌড়ে এসে উইন্ডোটা মিনিমাইজ করে দিয়ে বিরক্ত চোখে রীতার দিকে তাকাল।
রীতা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সাথে সাথে তার প্রিয়াঙ্কা নামের এই মেয়েটাকে অসহ্য লাগতে শুরু করল।
পর্ব-১ Click This Link পর্ব-২ Click This Link পর্ব-৩ Click This Link পর্ব-৪ Click This Link পর্ব-৫ Click This Link পর্ব-৬ Click This Link পর্ব-৭ Click This Link পর্ব-৮ Click This Link পর্ব-৯ Click This Link পর্ব-১০ Click This Link পর্ব-১১ Click This Link পর্ব-১২ Click This Link পর্ব-১৩ Click This Link পর্ব-১৪ Click This Link পর্ব-১৫ Click This Link পর্ব-১৬ Click This Link পর্ব-১৭ Click This Link পর্ব-১৮ Click This Link পর্ব-১৯ Click This Link পর্ব-২০ Click This Link পর্ব-২১ Click This Link পর্ব-২২ Click This Link পর্ব-২৩ Click This Link পর্ব-২৪ Click This Link পর্ব-২৫ Click This Link পর্ব-২৬ Click This Link পর্ব-২৭ Click This Link