‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ এই দুইটা জিনিস যে ঠিক এক না, এটা বুঝা খুব জটিল ব্যাপার। এছাড়া ‘ভালোবাসা’ বলে আসলে কিছু আছে কিনা!! তা অন্য আরেক তর্ক। আপাতত আমরা কথা বলছি ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ নিয়ে। ইংরেজিতে ‘ভালো লাগা’-কে বলা হয় ‘Infatuation’। ‘ভালো লাগা’-র মধ্যে থাকে শুধু আকর্ষণ আর মুগ্ধতা। যা সম্পর্কের প্রাথমিক স্তরের পরও যদি টিকে থাকে এবং আরো দুএকটি বৈশিষ্ট্য যেমন ‘শ্রদ্ধাবোধ’ এবং ‘বোঝাপড়া’ যোগ হয়, তবেই আমরা তাঁকে ‘ভালোবাসা’ বলতে পারি। কিন্তু শুরুর দিকের অনুভূতি এত তীব্র থাকে যে ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’-র পার্থক্য ঠিক বোঝা যায় না। অনেকে আবার ‘অভ্যস্ততা’-কেও ‘ভালোবাসা’ বলে ভুল করে।
যাইহোক!! পুলক এখন আটকে আছে ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ এর মাঝে।
সেইদিন প্রিয়াঙ্কার চলে যাওয়ার পরও পার্কে কিছুক্ষণ বসে ছিল পুলক। বসে বসে ভাবছে যে এটা আবার কী হল!! এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। তবে এটা খুব পাত্তা দেওয়ার মত ঘটনাও না। প্রিয়াঙ্কা বাচ্চা মেয়ে। ‘Calf love’ বলে একটা ব্যাপার আছে। যেটা এরকম বাচ্চাদের বেলায়-ই ঘটে। এরা প্রাথমিক আকর্ষণকে ‘ভালোবাসা’ বলে ধরে নেয়। এই আকর্ষণ বা মুগ্ধতা কেটে গেলেই আর পুলককে এই মেয়ের ভালো লাগবে না। পুলকের পক্ষেও এত দেমাগী মেয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা কখনোই সম্ভব হবে না। আর তাছাড়াও, সেই জায়গাটা কি কাউকে দেয়া সম্ভব যেখানে রীতা ছিল!! আসলে ওই জায়গাটার কোন অস্তিত্বই ছিল না কখনো। ওটা ছিল একটা জাদু। জাদু সত্যি হয় না। তবে জাদুর রেশ থেকে যায়। যেমন পুলকের জীবনে ‘রীতা’ নামক জাদুর রেশ থেকে গেছে। কিন্তু তারপরেও কেন জানি পুলক ভাবে যে জাদুটা যদি সত্যি হত। ওইরকম সত্যি-ই যদি কেউ থাকে!!
এরকম আবোল তাবোল কত কী-ই না ভাবছিল পুলক। এই সময় সে শুনতে পেল-
-সরি!!
পুলক ফিরে তাকাল। ওই মেয়েটা যে একটু আগেই তাঁর ‘হেলো’ এর জবাব না দিয়েই চলে গিয়েছিল।
মেয়েটা বলল-
-আসলে আপনি যে আমাকে হেলো বলেছেন এটা আমি তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। আপনাকে পাস করার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল যে আপনি হয়তো আমাকে হাই বা হেলো জাতীয় কিছু বলেছেন। পরের রাউন্ডে আপনি ব্যস্ত ছিলেন বলে আপনাকে আর ডিস্টার্ব করিনি। I hope you understand।
পুলক হাসল। বলল,
-ইটস ওকে!! আজকে যাই। অফিস এর দেরী হয়ে যাচ্ছে।
-চলুন। আমিও যাবো। একসাথে বের হই।
-আপনার নামটা?
-আমি ইতি
-আমি পুলক
-আমি একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীতে আছি।
-ও আচ্ছা।
রীতার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। রীতার কোম্পানীও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করে।
-কী নাম আপনার কোম্পানীর?
নাম বলল ইতি। নাহ!! মেলেনি।
পুলক নিজে কোথায় কাজ করে তাও বলল।
এভাবে তাঁরা ওইদিনের মত বিদায় নিল।
পরের কয়েকদিন পুলক হাঁটতে বের হয়নি। প্রিয়াঙ্কা খুব ফোন করেছে এই কয়দিন। পুলক মনে মনে খুব বিরক্ত হয়েছে। এই মেয়েকে তো সে কখনো কোন কথা দেয় নাই। পরক্ষনেই আবার তাঁর এও মনে হয় যে মনের উপর তো কারো জোর থাকে না। প্রিয়াঙ্কা তো নেহাতই বাচ্চা মেয়ে। ওঁর তো আরো থাকার কথা না। মন বড়ই অদ্ভুত। কিন্তু তাই বলে তো আর জোর করে কাউকে পছন্দ করা যায় না। ঠিকও না করা। আর পুলক এও জানে এই মেয়ে তাঁকে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করবে না। কোন এক দিন এও তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে। মুগ্ধতা শেষ হয়ে গেলে কেউ দাঁড়ায় না। তাই প্রিয়াঙ্কার ভালোর জন্যেই পুলককে খারাপ হতে হবে।
কয়েকদিন পর আবার যখন পার্কে গেল পুলক, ইতির সাথে দেখা হয়ে গেল। তাঁদের একসাথেই দৌড়াতে দেখা গেল। অনেক কথা-বার্তাও হল। জানা গেল ইতি পুলকের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। রেগুলার দৌড়ানোর কারণে উনাকে দেখে বোঝা যায় না। ডিভোর্সি। পার্কের কাছেই তাঁর বাসা। একাই থাকেন।
‘একা’, ‘সুন্দরী’, ‘ডিভোর্সি’। শব্দগুলো যেন একটা আরেকটার সাথে জড়িত। নিতান্ত ভদ্র মানুষের মনেও শব্দগুলো অন্যরকম আলোড়ন তৈরি করবে। পুলকের মাথাতেও শব্দগুলো এসেছে। পুরুষ তো!! কিন্তু সে ওইভাবে পাত্তা দেয়নি। বরং ইতির সাথে কথা বলে তাঁর ভালোই লেগেছে। পুলকের নিজের মা একা হাতে ছেলেকে মানুষ করেছে। শুধু ছেলে মানুষ-ই না। আর দশটা পুরুষ মানুষের মত তাঁকে সবদিক সামলাতে হয়েছে। তাই একা মেয়েদের প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধা অনুভব করে পুলক ভিতর থেকে।
পুলক আর ইতির সম্পর্কটা শুধু পার্কে সীমাবদ্ধ থাকল না। দেখা গেল মাঝে মাঝে তাঁরা একসাথে রিক্সায় ঘুরছে অফিস এর পর। আবার কোথাও খাচ্ছে। এরকম।
প্রিয়াঙ্কা মাঝে মাঝে ফোন দেয়। কখনো ধরে পুলক। কখনো ধরে না। প্রিয়াঙ্কার কথা ইতিকে বলেছে পুলক। ইতির নিজেরও অনেক ছেলে বন্ধু। বন্ধুই। আর কিছু না। কেউ হয়তো ভার্সিটি এর বন্ধু। কেউ হয়তো অফিস এর কলিগ। এদের সাথে মাঝে মাঝেই ঘোরা হয় তাঁর। একা জীবনটার যে ফাঁকা অংশ তা এভাবেই ভরাট করে নেয় ইতি। আর বিয়ে করবে না সে। বিয়ে তাঁর জন্য না। যদিও পুলককে সে তাঁর বিয়ে না টিকার কোন কেচ্ছা-কাহিনী বলেনি। এসব নিয়ে কথা বলা ইতির রুচিতে বাঁধে। আর পুলকও এমন লোক নয় যে সে এসব নিয়ে প্রশ্ন করবে। প্রত্যেক মানুষেরই নিজের নিজের কথা থাকবে। যা তাঁর নিজের একান্ত কথা। জরুরী নয় যে সব কথা সবাইকে বলতে হবে। পুলক যেমন রীতার কথা কাউকে বলে না। এটা মানুষকে বলার মত কোন কথা বলেও মনে হয় না তাঁর।
প্রাথমিকভাবে এ ধরনের সম্পর্ক নিয়ে কোন পক্ষই দুশ্চিন্তা করে না। মেয়েরা তো সমবয়সী ছেলেদেরকেই বাচ্চা হিসেবে ভাবে। আর ছোটদের তো গোনাতেই ধরে না। আর একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ছেলেরাও এ ধরনের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে নেয়ার চেষ্টা করে। বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
কিন্তু সমস্যা হল, এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো শেষমেশ শুধু বন্ধুত্বে থাকে না। একটা জটিলতার দিকে মোড় নেয়। সবার আগে বন্ধুত্বের সীমানাটা অতিক্রম করতে চায় ছেলেরা। এবং তাঁরা অপর পক্ষকেও বাধ্য করে সীমানা অতিক্রম করার জন্যে। কোন মেয়ে রাজি হয়। কোন মেয়ে হয় না। মেয়েদের জন্য ব্যাপারটা বেশ একটু বিড়ম্বনার। পুরুষ জাতির মত হরদম প্রেমে পড়ার অভ্যাস সাধারণ মেয়েদের থাকে না। এরা বন্ধু থাকতেই ভালোবাসে। কিন্তু পুরুষ জাতি তাঁর চরিত্রের তীব্র অধিকারবোধ থেকে নারীকে নিজের বলে মনে করতে চায়। দেখা যায়!! একটি মেয়ের সাধারণ কথাবার্তাতেই ৫-৬টি পুরুষ হৃদয় অকারণ বিগলিত হয়ে যায়। এতে ঠিক কাউকে দোষারোপ করা যায় না। প্রাকৃতিকভাবেই নারী জাতির নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা বেশি পুরুষের চেয়ে।
এইসব তাত্ত্বিক ব্যাপার পুলক ভালোই জানে। এসব ব্যাপার সে বহুভাবে চিন্তা করে। বিচার বিশ্লেষণ করে। তাই নিজেকে সে আর দশটা পুরুষের মত ভাবে না। এটা তাঁর একটা অহংকারের জায়গা। লুক্কায়িত অহংকার। কিন্তু খুব জলদি-ই তাঁর এই লুক্কায়িত অহংকার লুক্কায়িত ভাবেই ভূলুণ্ঠিত হল। কেউ জানল না সে নিজে ছাড়া।
পর্ব-১ Click This Link পর্ব-২ Click This Link পর্ব-৩ Click This Link পর্ব-৪ Click This Link পর্ব-৫ Click This Link পর্ব-৬ Click This Link পর্ব-৭ Click This Link পর্ব-৮ Click This Link পর্ব-৯ Click This Link পর্ব-১০ Click This Link পর্ব-১১ Click This Link পর্ব-১২ Click This Link পর্ব-১৩ Click This Link পর্ব-১৪ Click This Link পর্ব-১৫ Click This Link পর্ব-১৬ Click This Link পর্ব-১৭ Click This Link পর্ব-১৮ Click This Link পর্ব-১৯ Click This Link পর্ব-২০ Click This Link পর্ব-২১ Click This Link পর্ব-২২ Click This Link পর্ব-২৩ Click This Link পর্ব-২৪ Click This Link