একটা রেস্টুরেন্টের গোল টেবিলে চারজন বসা। আশিক, পুলক, রহমান এবং রাসেল। তিনজন সিগারেট খাচ্ছে। পুলক খাচ্ছে না। পুলকের খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সে কাউকে কিছু বলছে না। এরা সবাই পুলকের ভার্সিটি এর ক্লাসমেট। বন্ধু বলতে যাকে বোঝায় তা শুধু আশিক। এরা কেউ জানে না যে পুলক সিগারেট খেয়েছে আগে। এমনকি আশিকও না। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে রত্না আর রেবেকা নামে আরো দুই জনের জন্য। সপ্তাহে দুই তিন বার এরা কোথাও না কোথাও বসে আড্ডা দেয়। পুলক ছাড়া বাকিরা নিয়মিত। তাই পুলক চুপচাপ। বাকিরা কথা বলছে। নতুন জায়গায় গেলে এমনিতেই পুলক সহজ হতে পারে না। সময় লাগে। আশিক বন্ধুকে অনেকদিন থেকেই চেনে। বন্ধুকে সহজ করার জন্যে সে কিছু বলে না। জানে এতে পুলক আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। থাকুক ও ওঁর মত। হঠাৎ-ই রাস্তায় পুলকের সাথে আশিকের দেখা। পুলক অন্যমনস্কভাবে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আশিক ডাকে। পুলক শোনে না। এত করে ডাকে তাও পুলক শোনে না। শেষমেশ দেখা গেল জ্যামে আটকে থাকা সবাই পুলককে ডাকা শুরু করেছে। সে এক দৃশ্য বটে। এরপর কথাবার্তায় বোঝা গেল পুলক ঠিক ধাতস্থ নেই। Something is wrong!!! পুলককে আশিক ধরে নিয়ে আসে তার আড্ডায়।
ওইদিন রীতাকে দেখার পর কি এক আশ্চর্য অথচ অপেক্ষা করে থাকা কষ্টের দেখা পুলক পেয়েছে। কিন্তু এর তীব্রতা তার ধারণাকেও ছাড়িয়ে যায়। রাতে ঘুম হয় না। কোথাও এক দণ্ড বসে থাকতে পারে না সে। অফিস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল সে। বাসায় ও থাকত না। রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত। আর মাথায় খালি ঘুরে বেড়াত কে ছেলেটা!!! যার সাথে রীতা এত ঘনিষ্ঠ ছিল!! এত জলদি ভুলে গেল তাঁকে রীতা!! সে কেন পারছে না!! কত চেষ্টা করছে সে। তাও কেন পারছে না!! এতদিন ছিল ভোঁতা যন্ত্রণা। হঠাৎ করে ছুরিটায় যেন ধার এসেছে। সবকিছু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। কাউকে বলতে পারছে না সে। কী অসহায় নিজেকে লাগে পুলকের!! পুরো শরীরে কোথাও কোন আঘাত নেই। কোন দাগ নেই। অথচ কী নিদারুন যন্ত্রণা!!! রাতটাই সবচেয়ে কষ্ট দেয় তাঁকে। এত বড় মনে হয়নি রাতকে আগে কখনো। দিনে তাও মানুষের ব্যস্ততা দেখেও সময় কেটে যায়। কিন্তু রাত তো নীরব। নিস্তব্ধ। যন্ত্রণাগুলো যেন হামলা করে তাঁকে। কতবার তার ইচ্ছা হয় রীতাকে একটা কল দিতে। সে দেয় না। সে জানে এটা একটা অসুখ। এত কষ্টের মধ্যেও তার যুক্তিবাদী মন পুরোপুরি বিদায় নেয় না। থেকে থেকে জানান দেয়। তাঁকে বোঝায় যে এটাই নিয়ম। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এরকম সময়ে মানুষের যুক্তিবাদী মনের পাশাপাশি দরকার একজন বন্ধুর। আমাদের এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ জীবনে ঠিক বেঠিকের সংজ্ঞা তো আমরা তথাকথিত শিক্ষিতরা জানিই। কিন্তু তারপরেও কাউকে না কাউকে এসে আমাদের বলে দিতে হয়। এটা কর। এটা কোরো না। এটা ঠিক। এটা ঠিক না।
মানুষের মন এক বিচিত্র বস্তু। কোন পোশাক আর অলংকার ছাড়া মানুষের মন খুবই স্বার্থপর। ‘পোশাক’ আর ‘অলংকার’ বলতে এখানে ‘শিক্ষা’ আর ‘সামাজিকতা’-কে বোঝানো যায়। এই শিক্ষা আর সামাজিকতা আমাদের শেখায় যে আমাদের মনের সব কথা শুনতে নেই। অথবা মনের স্বার্থপরতাটাকে একটা নতুন মোড়কে এনে হাজির করে। মানুষ অন্য মানুষের দুঃখে খুশি হয়। এই খুশি হওয়াকে সামাজিকতার মোড়কে মুড়িয়ে মানুষ সান্ত্বনা দেয়। দয়া দাক্ষিণ্য দেখাতে মানুষের বরাবরই ভালো লাগে। অপরের দুঃখে চু চু করতে মানুষের অনির্বচনীয় সুখ। যদি না চু চু করা যায়। যদি সেই দুঃখী কোনোভাবে দাঁড়িয়ে যায়। এতে মানুষ আবার খুবই রেগে যায়। চু চু করা গেল না যে!!!
প্রেমের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই নিয়মনীতি অনুসরণ করে মানুষ। প্রেমিক প্রেমিকা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর দুই পক্ষই শিক্ষা ও সামাজিকতার নির্দেশে নিজেকে এবং আশেপাশের সবাইকে বোঝায় যে আমি চাই সে ভালো থাকুক। কিন্তু আসলে প্রত্যেক পক্ষের অবচেতন মন চায় যে অপর পক্ষ তার বিরহে কষ্ট পাক। এর উল্টা কিছুর নিদর্শন পেলেই মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। নিজেকে বুঝতে পারে না। কারণ অবচেতন মনের কতটুকুই মানুষ বুঝতে পারে!!!
আমাদের গল্পের পুলকও সেই অবচেতন মনের যন্ত্রণার শিকার। রীতাকে ছেড়ে আসা যায়। কিন্তু রীতাকে অন্য কারো সাথে সুখী দেখা যায় না।
আমরা আবার আড্ডার টেবিলে ফিরে যাই। এতক্ষনে রত্না আর রেবেকা চলে আসে। এই টেবিলের সবাই-ই কোথাও না কোথাও চাকরী করে। শুধুমাত্র রাসেল ছাড়া। তার এটা নিয়ে খুব বেশি একটা মাথা ব্যথাও নেই। তাঁকে কিছু বলা হলেই সে মুখটাকে দুখী দুখী করে বলে, “হ ভাই!! আমি বেকার মানুষ।” কিন্তু আসলে তাঁকে তত দুখী দেখায় না। রত্না আর রেবেকা পোশাক আশাকে বিপরীত। রেবেকার শাড়ি পড়া। রত্নার পড়া শার্ট প্যান্ট। কাউকেই সুন্দরী বলা যাবে না। কিন্তু তাঁদের সাবলীলতা তাঁদের মধ্যে আলাদা সৌন্দর্য যোগ করেছে।
‘পচানি’ নামে যে একটা শিল্প বহু আগে থেকেই গড়ে উঠেছে তা এই আড্ডার টেবিলে প্রমাণিত। হাসতে হাসতে মানুষকে ভয়ঙ্কর অপমান করাই হচ্ছে ‘পচানি’। এতে যে অপমান করে সেও হাসে, যাকে অপমান করে সেও হাসে এবং মনে মনে অপমানকারীকে পাল্টা অপমান করার সুযোগ খোঁজে। এই ‘পচানি’ নামক শিল্পর সামনে সবসময়ই পুলক নিজেকে অনিরাপদ বোধ করত। টেবিলের মধ্যেও করতে লাগল। জীবনের যে কোন ক্ষেত্রেই কেউ যদি তাঁকে একটা টিকা টিপ্পনী দিয়েছে, সে তাঁকে উগ্রভাবে আক্রমন করেছে। কথা দিয়েই। তবে তা কখনোই শিল্পের পর্যায়ে থাকত না। টেবিলে এরা একে অপরকে পচাচ্ছে আর হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পুলক শুধু মুছকি মেকি হাসি দিয়ে যাচ্ছে। তার এখানে একটুও ভালো লাগছে না। কিন্তু এরকম একটা সময়ে সে বেরও হয়ে যেতে পারছে না। আশিক তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছে। ওকে বলতেও ইচ্ছা করছে না সে চলে যাবে। পুলক বসে রইল।
সাধারণত ‘পচানি’ নামক শিল্পতে একজনকে টার্গেট করা হয়। সে হয় সবার বিনোদন এর কেন্দ্রবিন্দু। এখানে সেই টার্গেট হল রহমান। সে কথাবার্তায় তত পটু না। সে থাকে তার মামা মামীর সাথে। কিছু হলেই সে বলে ‘মামী এটা বলসে!!! মামী ওইটা বলসে!!’ সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় পচানি।
রত্না ওকে জিজ্ঞেস করে,
- রহমান দোস্ত!!! তোর রাতে বাথরুম লাগলে কী করস!!
রহমান বিরক্ত হয়। বলে,
- কী করি মানে কি!! বাথরুমে যাই!!!
- কেন!! মামীর পারমিশন লস না!!!
আবার শুরু হয়ে যায় টেবিল চাপড়ানো হাসাহাসি। পুলক বিরক্ত হয়। রহমান- কে সেরকম কিছু মনে হয় না।
হঠাৎ করেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই আক্রমনের দিক ঘুরে যায় পুলকের দিকে। আক্রমন করে রত্নাই। ‘পচানি’ শিল্পের এই টেবিলের লিডার সে। আশিক যদিও ইশারায় রত্নাকে না করে। রত্না পাত্তা দেয় না। সে মিট মিট করে হেসে সবাইকে তার সাথে যোগ দিতে ইশারা করে-
- আচ্ছা!! আপনার নামটা কি যেন বলেছিলেন!!!
- পুলক
- বাঃ!! খুব পুলকিত হইলাম আপনার নাম শুনে।
পুলক ভদ্রতার হাসি দেয়।
- ছ্যাক খাইসেন নাকি ব্রাদার!!! আপনাকে দেখে কি রকম ছ্যাক খাওয়া লাগে।
টেবিলের সবাই-ই হাসে আশিক ছাড়া। সে অপ্রস্তুত হয়ে থাকে। সে হাসলে যে পুলক তাঁকে ছেড়ে দেবে না এটা সে জানে। ভার্সিটি লাইফ এ এরকম বহুবার হয়েছে যে সে কোন কারণে পুলকের উপর ঠাট্টা করে হেসেছে। আর পুলক রেগে মেগে আগুন হয়ে গিয়েছে।
পুলকের কিন্তু খুব রাগ উঠেছে। কেউ তাঁকে খোঁচা মেরে কথা বললে সে সহ্য করতে পারে না। তার মাথায় কোথায় জানি একটা ‘টং’ করে সাউন্ড হয়। তার ইচ্ছা করছে সে মেয়েটাকে ‘টাস’ করে একটা চড় মারে। কিন্তু তা না করে সে একটা স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করল। সে হাসল আর বলল।
- তাই?
রত্না বলল-
- আবার জিগস।
বলে আরেক দফা হাসি। পুলকও হাসল এবার।
-আপনাকে দেখেও আমার তাই মনে হয়!!
রত্নার মুখের হাসি চলে গেল।
- মানে?
- মানে খুবই সোজা। আপনিও আপনার ভাষায় ‘ছ্যাক’-ই খাওয়া। ওইটা আড়াল করতেই এত হাসাহাসি আর অন্যকে অপমান করা। তাই না?
এখন আর কেউ হাসছে না। পুলক মনে মনে হাসল। এই রত্না মেয়েটাও তার মত। পচাতে পছন্দ করে। পচতে না। এই জন্যই টেবিলের সবাই হাসি চেপে আছে। রত্নার মুখ কালো।
পুলক উঠল। আশিককে বলল, “ দোস্ত!!! আজকে যাই রে!! আবার দেখা হবে। আমি কল দিবনে তোকে।“
পুলক বের হয়ে গেল।
অন্যদিকে রীতার জীবনে অন্য আরেকটি পুরুষের আগমন ঘটল। তার নাম মাসুদ পারভেজ।
পর্ব-১ Click This Link পর্ব-২ Click This Link পর্ব-৩ Click This Link পর্ব-৪ Click This Link পর্ব-৫ Click This Link পর্ব-৬ Click This Link পর্ব-৭ Click This Link পর্ব-৮ Click This Link পর্ব-৯ Click This Link পর্ব-১০ Click This Link পর্ব-১১ Click This Link পর্ব-১২ Click This Link পর্ব-১৩ Click This Link পর্ব-১৪ Click This Link পর্ব-১৫ Click This Link পর্ব-১৬ Click This Link পর্ব-১৭ Click This Link পর্ব-১৮ Click This Link পর্ব-১৯ Click This Link পর্ব-২০ Click This Link পর্ব-২১ Click This Link পর্ব-২২ Click This Link পর্ব-২৩ Click This Link পর্ব-২৪ Click This Link পর্ব-২৫ Click This Link পর্ব-২৬ Click This Link পর্ব-২৭ Click This Link পর্ব-২৮ Click This Link