somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাকৃতিক শান্তি! - আমার বেড়াতে যাওয়া (পর্ব ০৪)

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এখানে এলাম যেভাবেঃ পর্ব ০১
এখানে এলাম যেভাবেঃ পর্ব ০২
এখানে এলাম যেভাবেঃ পর্ব ০৩

বেশ বড় সড় একটা কিছু, বাচ্চা কুমির সাইজের, ৪পায়ে হাটে, সড়সড় করে নড়তে নড়তে পানির মধ্যে নেমে গেলো। প্রথমে কয়েক সেকেন্ড মাথা পানির উপরে থাকলেও হারিয়ে গেলো। আমি একপ্রকার চিৎকার করে উঠলাম, 'আব্বু, ঐটা কি কুমির?' প্রচন্ড ভয়ে গা হাত পা কেমন কাঁপতে লাগলো।

আব্বা আস্বস্ত করলেন, বিপদজনক কিছু নয়। ওটাকে এই এলাকায় গোদাড় বলা হয়। সাধারণ বাঙলা ভাষায় সেটাকে গুই সাপ বলা হয়। এখানকার গুইসাপ গুলি বেশ বড় সাইজের হয়। যার কারণেই আমি এটাকে প্রথমে কুমির বা কুমিরের বাচ্চা মনে করেছিলাম। এখানকার গোদাড় গুলি সাধারণত লোকালয়ের কাছে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে থাকে। মাছ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খেয়ে বাঁচে। বৃষ্টিতে এদের শরীর স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যায়, প্রচুর মাছ এবং ব্যাঙ পায় এরা।

আব্বার আস্বস্তি খুব একটা কাজে লাগলো বলে মনে হলো না। কারণ তখনও গা ছম ছম করছে। গত পর্বে খালের একটা বর্ণনা দিয়েছিলাম, সেখানে একটি জিনিষ দেওয়া হয়নি। খালের দুই ধারে বাড়ি এবং বড় বড় গাছের কল্যানে এটাকে একটা বড় সুড়ঙ্গ মনে হয়। বড় বড় গাছ দুই পাশ থেকে ঝুকে এসে উপরের দিকে এক সাথে মিলে গেছে। মনে হবে যেন কেউ ইচ্ছা করে এমনটা তৈরী করে রেখেছে। যদি বিষয়টা দেখতে চান, তাহলে গুগলে ঢুকুন, গুগল ইমেজে গিয়ে 'যশোর রোড' দিয়ে সার্চ দিন। এখানে কিছু ছবি পাবেন, যেখানে পুরো রাস্তাটাকেই সুড়ঙ্গ মনে হবে; গাছের কারণে। আমাদের এখানের খালটিও ঠিক তেমনই। তবে আরও একটু বেশী ঘন, আরও একটু বেশী অন্ধকার। ভর দুপুরেই বেশ অন্ধকার অন্ধকার ভাব।

এই খালের ভিতর দিয়ে প্রচুর নৌকা চলাচল করে। কচুড়িপানার ভেসে যাওয়া, আশেপাশের বাড়ি থেকে হাঁস এসে পানিতে ভাসা, আর মাঝে মধ্যে কিছু মাছের পানিতে বাড়ি দেওয়া....... আর সাথে বৈঠার সাথে নৌকার ও পানির শব্দ। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন জীবনের সুড়ঙ্গ দিয়ে নতুন এক ভূবনে প্রবেশ করছি।

দুপুর ২টা নাগাদ বাড়ি পৌছালাম; এটা হচ্ছে এক্কেবারে আসল বাপের বাড়ি; আমার শিকড় যেখানে। নানান রকম আতিথেয়তা, লোকজন, খাওয়াদাওয়া শেষে বিকালে বাড়ি থেকে বের হলাম। এ অঞ্চলের মানুষ নতুন ব্যবসার সন্ধান পেয়েছে, চিংড়ির ঘের। আর শাইখ সিরাজের টিভি রিপোর্ট শহরে থাকা লোকদের এই ব্যবসায় আকৃষ্ট করেছে আরও বেশী। আমাদেরও একটি ঘের আছে; একটি নয়, দু'টি।

আমাদের ঘেরের থেকে পশ্চিম মুখে দাড়ালে পর পর আরও প্রায় গোটা ৩০-৪০ ঘের। অর্থাৎ প্রায় আধা কিলোমিটারের মত বা তার কিছু বেশী দুরত্ব পর্যন্ত ঘের। ওপারে ছোট একটা গ্রাম। বর্ষার সিজন বলে ঘের গুলি পানি পূর্ণ। অর্থাৎ বেশ অনেকদুর পর্যন্ত শুধু পানিই চোখে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের খেলা, আর সেই আলো পানিতে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরী হলো। আমাদের দুইটি ঘের পাশাপাশি, মধ্যেখানের পাড়ে একটা ঘর তৈরী করা। এই এলাকায় সবচাইতে বড় ঘর, ঘেরের মধ্যের ঘর গুলির মধ্যে। আব্বা শখ করে বড় করে বানিয়েছেন, যাতে আমরা বেড়াতে গেলে ঐ ঘরে থাকতে বসতে পারি।

মাছ ধরা চলছে, জাল দিয়ে, আর আব্বা বসেছেন ছিপ নিয়ে। আমি তাকিয়ে সব দেখছি; আর অভিভূত হচ্ছি। ঢাকার আত্মীয় স্বজন বেড়াতে এসে যখন ঢাকার জঘন্য অবস্থার বর্ণনা দিতেন, তখন নিজের জেলাকে খুব শান্তিময় লাগতো, আর এখন মনে হচ্ছে শান্তির চাইতেও শান্তি আছে এই গ্রামে। আস্তে আস্তে সূর্য ডুবতে বসেছে; আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলাম। সদ্য ধরা মাছ রান্না হবে এখন। সন্ধ্যা হলে এখানে কোন বাতি নাই। ল্যাম্প (আঞ্চলিক ভাষায় ল্যাম্ফো) আর হারিকেনই ভরসা।

খাওয়াদাওয়া কথাবার্তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। দাদী-আম্মা আরও অনেকের কাছে নানান গল্প শুনছিলাম। এর মধ্যে আব্বা বাইরে এসে দাড়াতে বললেন। বাইরে বেশ অন্ধকার, আর উঠানে কাঁদা; তার মধ্যে গিয়ে দাড়াতে ইচ্ছা করছিলো না। তবুও সবাই বাইরে গেলাম। দ্বিতীয়বারের মত চোয়াল ঝুলে গেলো। আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে হাজার তারা। আমি নিশ্চিত, এটা আর যাই হোক, আমি যে জগৎএ থাকি, সেই জগৎ নয়। কারণ সেখানে এত তারা নাই।

ঐ বার আর তেমন তারা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বেশীরভাগ দিনই আকাশ মেঘে ঢাকা ছিলো। কিন্তু পরে একবার গিয়েছিলাম বৃষ্টির সিজনের পরে, কুরবানীর ঈদে। সারাদিন অপেক্ষায় থাকতাম কখন সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যা হতেই আকাশে লক্ষ-কোটি তারা। তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট তারার এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি। বিলে আর কয়টা শাপলা ছিলো, এই তারার সংখ্যাতো তার থেকেও হাজার গুনে বেশী। উঠানে পাটি পেতে তার উপর শুয়ে শুধু তারা দেখি। তারার আলোয় পথ চলার কথা কোন একটা গল্প বইতে পড়েছিলাম (ওহ, বলে রাখা ভালো, আমার আব্বার বইয়ের দোকানে বসবার ফলে প্রচুর বই পড়া হতো। প্রচুর গল্প পড়া হতো। কবিতার উপর বিরক্তিও অবশ্য বই পড়ার অভ্যাস থেকেই এসেছে)

আম্মা এই তারার মধ্যে অনেক তারার সাথেই পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক বা মুসলিম জ্যোতির্বজ্ঞানীদের মত করে না হোক, অনেক তারার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনটি তারা ও জিজ্ঞাসা বোধক ৭টি তারা যদিও শহরে থাকতে দেখেছি; কিন্তু এখানে মনে হচ্ছিলো একদম যেন হাতের কাছে। এছাড়া আরও কয়েকটি তারার শেপ বোঝানোর চেষ্টা করলেন আম্মা, কিন্তু বুঝলাম না। তবে তারা দেখে গেলাম। পুরো আকাশটাই যেন জ্বলজ্বল করছে। কোথাও তারার ঘনত্ব বেশী, কোথাও কম। মাঝে মধ্যে একটা দুইটা আলো ছুটে যায়। এই জিনিষের ব্যখ্যা পাই নাই। শহরে তো এর কানাকড়ি পরিমানও ছুটতে দেখি না। গ্রামের সবাই বলে ওগুলি জ্বিন। কেই বললো উল্কা। সে যাই হোক, এটা অন্য একটা জগৎ, অন্য এক রকম মাদকতা।

শাপলার বর্ণনার সময় বলেছিলাম একদিন ভোরে শাপলা তুলতে গিয়েছিলাম, সেদিনের আকাশে এত্তোবড় একটা চাঁদ ছিলো, আমরা ফজরের আজানের পর পর বের হবার পর যখন বিলে এসে পড়েছিলাম, তখনও আকাশের এক পাশে ঐ চাঁদ, মধ্য আকাশে তারা আর পূব দিগন্তে সাদা আলোর আভা। আর পায়ের নিচে পানিতে সেগুলির প্রতিফলন আর তার সাথে মুখ বুজে থাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শাপলা। দূর দুরান্ত থেকে নৌকার মাঝি আর ঘেরের পাহারাদারদের চিৎকার ধ্বনিও যেন মনে হচ্ছিলো অন্য জগতের থেকে আহ্ববান।

এই তারার কথা আমি জীবনেও ভুলবো না। শহরের আলো যতই থাকুক, এই তারার আলো অন্য রকম, অদ্ভুত। যারা এই তারা দেখতে চান; আমার মনে হয় এখানো সময় আছে, যে কোন হাওড় এলাকায় চলে যান। নৌকায় হাওড়ের মধ্যে রাত কাটান। এমন দৃশ্য দেখতে পাবেন, যা সারা জীবন চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারবেন। শুধু আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে আপনি যাবার সময় মোবাইল সাথে নিবেন না।

লক্ষ-কোটি তারা আমি আরও কয়েকবার দেখেছি। দেখেছি পাহাড়, দেখেছি বিল, গহীন বনে শুনেছি শিয়ালের চিৎকার, দেখেছি সমুদ্রের শান্ত রূপ, দেখেছি সমুদ্রের ভয়ঙ্কর রূপ, দেখেছি কনকনে শীতে কুয়াশা কেটে লঞ্চের চলে যাওয়া। খুব ইচ্ছাকরে কাউকে কাছে বসিয়ে সব গল্প বলি। খুব ইচ্ছা করে কারও হাত ধরে সেই জায়গা গুলি আবারও ঘুরে আসি। হয়ত আপনাদের সাথেই যাবো, নতুবা নয়। পরের কোন পর্ব নাও থাকতে পারে, আবার থাকতেও পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৪৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×