হঠাৎই আব্বা ঘোষনা করলেন যে আমরা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি! খবরটায় আমাদের খুশি হওয়া উচিৎ নাকি দুঃখ পাওয়া উচিৎ কিছুই বুঝলাম না। কারণ আমার বয়স যদিও মাত্র ১২; তবে এই ১২ বছরে কোথাও কোনদিন দূরে বেড়াতে গিয়েছি বলে মনে করতে পারলাম না।
বাবার ছোট্ট একটা বইয়ের দোকান; মায়ের সরকারী চাকরী। বাড়িতে বসে আব্বার তত্বাবধানে কতগুলি হুড়িকুড়ি প্রাইভেট পড়তে আসে। প্রায় ২০ হাত লম্বা ঘরের এমাথা ওমাথা পাটি বেছানো থাকে, তাতেই সব ছেলে-মেয়েরা দলে দলে ভাগ হয়ে বসে। ক্লাস ৩ থেকে ক্লাস ৮। সব মিলিয়ে গোটা ৬০ ছাত্র-ছাত্রী। যখন বাচ্চারা পড়ে, তখন বাহির থেকে বেশ ভালোই গুঞ্জন শোনা যায়। গোলপাতার ঘরের মধ্যে অন্য রকম একটা পরিবেশ তৈরী হয় তখন। এতোগুলি বাচ্চার এক সাথে পড়া দেখে অনেক গার্ডিয়ানই ভাবেন যে এখানে তাদের ছেলে মেয়েকে পাঠালে পড়াশুনা হবে না; এই ক্যাওয়াজের মধ্যে কি সম্ভব? কিন্তু বছর শেষে যখন দেখা যায় যে আশেপাশের প্রায় ৪টা প্রতি স্কুলের প্রথম থেকে দশম স্থান অধীকারী ছাত্র-ছাত্রীদের বেশীর ভাগই আমাদের বাসায় পড়তে আসা এই ছেলে মেয়েদের মধ্যে তখন একটু নড়ে চড়ে বসতেই হয়।
যা বলছিলাম, এই পরিবেশের মধ্যে বাসায় মেহমান আসা যেমন আমাদের জন্য বিরক্তিকর; তেমনি ২/৩ দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব বিষয়। তাও আবার এই আষাঢ় (জুনের শেষ দিকে) মাসে তো পুরাই আষাঢ়ে গল্পের মত। এছাড়া আমরা বেড়াতে যাওয়ার অর্থ বুঝি কারও বাসায় এক বেলার জন্য দাওয়াত খেতে যাওয়া; এবং যতসময় না বাসায় ফেরৎ আসি তত সময় অস্বস্তির মধ্যে থাকা। কারণ ছোট হিসাবে বড়দের মধ্যে বসে কথাও শুনতে পারি না; আবার খেলা-ধূলা করবারও পরিস্থিতি থাকে না। সেখানে যখন শুনলাম যে ৬/৭ দিনের জন্য যাওয়া হবে; বিষয়টা আমাদের জন্য আনন্দের নাকি দুঃখের, বুঝতে কষ্ট হবারই কথা।
কোন এক শুক্রবারে আমরা সবাই মিলে হুড়োহুড়ি করে ব্যাগে কাপড়চোপড় থেকে বহু জিনিষ ভরতে লাগলাম। খুব সম্ভবত তখনই আবিস্কার করেছিলাম যে আমার এবং আমার বড় ভাইয়ের নিয়ে যাবার মত কিছুই নাই। মানে ছেলে-পেলেরা যে বিভিন্ন খেলনাপাতি নিয়ে যায়; তার কিচ্ছুই নাই! বাসার সামনে একটি বেবি-ট্যাক্সি দাড়ানো। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম এটায় করেই। আম্মার কোলে ছোট বোন; আমি সিটের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসা, পায়ের কাছে আর পাসের সিটে ব্যাগ। ভাইয়া আর আব্বা সামনে ড্রাইভারের সাথে। রওনা হলাম আমরা।
রূপসা নদীর কাছে এসে থামলাম। সবাই মিলে টানাটানি করে ব্যাগ নিয়ে নৌকায় উঠতেই আমার চোক্ষু চড়ক গাছ! এত্তো বড় নদী? এত্তো বড় বড় ঢেউ? আর নৌকাই বা এত বড় কেন? আর নৌকাতে কেন এত মানুষ? আম্মার সাথে মাঝে মধ্যে তার অফিসে যেতে হতো, ছোট্ট ভৈরব নদী পার হতাম, ছোট্ট নৌকায়, ৮/১০জন উঠলেই ছেড়ে দেওয়া হতো। তার তুলনায় এই নদী তো বিশাল বড়! বহু পরে বুঝেছি যে ভরা বর্ষার কারণে নদী আরও বেশী ফুলে ফেঁপে ছিলো।
নদী পার হয়ে ওপারের ডাইরেক্ট কাম সিটিং সার্ভিস বাসে উঠে বসলাম। আব্বার দেহের আকার, চেহারা এবং গলার কন্ঠ ভারী হওয়ায় আর সাথে আম্মা সরকারী চাকুরীজীবি হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যে রটে গেলো যে এই বাসে সরকারী বড় কর্মকর্তা যাচ্ছেন। তাই বাস প্রায় ফাঁকাই গেলো (তাদের ভাষ্যমতে)। মূলত বাসের প্রতি সিটেই লোক। এমনকি মধ্যেখানের কোরিডোরে মোড়া দিয়ে আরও লোক; এবং এই মোড়ায় বসা লোকের ফাঁকে ফাঁকে আরও লোক দাড়ানো। কোন ভাবেই মাথায় আসলো না যে এটা সিটিং সার্ভিস কি ভাবে হলো! আমার তখনও জানতে বাকি যে ছাদে আরও গোটা ২০ লোক বসা; এবং সামনে এত পরিমানে স্টান্ডে দাড়াবে যে বাসকে ডাইরেক্ট বাস বলা অসম্ভব!
চলবে.... (দ্বিতীয় পর্বের লিংক)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৯ রাত ৩:৪৭