somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন (১-২)

০৬ ই মে, ২০১০ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৈনিক কালের কন্ঠের ফিচার পাতা "শিলালিপি" তে হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।আমিও এখানে ধারাবাহিক ভাবে তারই কপি-পেষ্ট করব।

১.
কেটেছে একেলা
বিরহের বেলা

এক মাস ধরে বইমেলা চলছে। আমি ঘরে বসে বিরহের বেলা কাটাচ্ছি। মেলায় যেতে না পারার বিরহ। সম্প্রতি ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় আমাকে কিছুটা সময় বারান্দায় বসে থাকতে হয়। বারান্দাটা এমন যে এখান থেকে দালানকোঠা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তবে একটা আমগাছ চোখে পড়ে। আমগাছে মুকুল এসেছে। বসন্তের নমুনা বলতে এটুকুই।
আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলেই পুত্র নিষাদ পাশে এসে বসে। সে এখন 'কেন?'_স্টেজে আছে। এই স্টেজের বাচ্চারা 'কেন?' 'কেন?' করতেই থাকে।
বাবা, বারান্দায় বসে আছ কেন?
আমগাছ দেখছি।
আমগাছ দেখছ কেন?
দেখতে ভালো লাগছে, তাই দেখছি।
ভালো লাগছে কেন?
জানি না।
জানো না কেন?
বাবা! যথেষ্ট বিরক্ত করেছ। এখন তোমাকে ধরে আমি একটা আছাড় দিব।
আছাড় দিবে কেন?
পুত্র কেন কেন করতে থাকুক, আমি মূল রচনায় ফিরে যাই। বইমেলা বিষয়ক রচনা। মেলায় নিজে যেতে না পারলেও টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকার কলামে মেলা দেখা হচ্ছে। ভালোমতোই হচ্ছে। মাঠে না গিয়ে ঘরে বসে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখার মতো। অনেক খুঁটিনাটি চোখে পড়ছে। মেলায় উপস্থিত থাকলে চোখে পড়ত না।
কিছু লেখক এবং প্রকাশককে দেখলাম ঐতিহ্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির। ঐতিহ্য বজায় রাখতেই হবে। মেলা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই হতে হবে। অন্য কোথাও হওয়া যাবে না।
গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ হাঁটছে। বই হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ নেই। বাচ্চারা ভিড়ে অস্থির হয়ে কাঁদছে। কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছে। বখাটে ছেলেরা থাকছে যদি সুযোগ বুঝে কোনো তরুণীর গায়ে হাত রাখা যায়। তসলিমা নাসরিন দেশে নেই। তরুণী লাঞ্ছিত হলেও লেখার কেউ নেই। লাঞ্ছিত হলেও ঐতিহ্য তো বজায় থাকবে।
টিভিতে বইমেলা দেখে আমি মাঝে মাঝেই আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। যদি আগুন লাগে, যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে কি দমকলের গাড়ি পেঁৗছতে পারবে? ছোটাছুটি শুরু হলে বাচ্চারা কোথায় যাবে? কলকাতার অতি প্রশস্ত বইমেলাও একবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। সে সময় আমি কলকাতার বইমেলায়। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল আমার জানা আছে।
ঐতিহ্য-প্রেমিকদের বলছি, ঐতিহ্যও বদলায়। একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা ধুতি পরতেন। ধুতি পরার ঐতিহ্য থেকে আমরা সরে এসেছি। আগের লেখকরা ঝর্না কলমে লিখতেন। এখন অনেকেই কম্পিউটারে লেখেন। ঝর্না কলম নামক ঐতিহ্যের মৃত্যু।
বাংলা একাডেমীর পাশেই বিশাল মাঠ পড়ে আছে। সেই মাঠ কারো চোখে পড়ছে না। আমরা আটকে আছি খুপরিতে। বাংলা একাডেমীর কর্তারা কেন মেলা পরিচালনা করছেন তাও বুঝতে পারছি না। মেলা পরিচালনা করবেন প্রকাশকরা। নীতি তাঁরা নির্ধারণ করবেন।
বইমেলায় হেঁটে বেড়ানো, নতুন প্রকাশিত বই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ থেকে বাংলা একাডেমী পাঠককে বঞ্চিত করছে। মেলা তাঁদের হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েই কাজটা করছে। প্রসঙ্গক্রমে অতীতের এক বইমেলার ঘটনা বলি, আমি একটা স্টলে বসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলা একাডেমীর ডিজি আমার কাছে চলে এলেন। তাঁর নাম, আচ্ছা থাক, নাম বললাম না। ডিজির চোখ-মুখ শক্ত। তিনি বললেন, আপনি মেলায় থাকতে পারবেন না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন পারব না?
তিনি বললেন, আপনার কারণে মেলায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটবে। আপনাকে এক্ষুনি উঠে যেতে হবে।
আমি বললাম, ব্যবস্থা করে দিন যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। লেখক হিসেবে আমার অধিকার আছে মেলায় আসার। বইমেলা শুধু পাঠক-প্রকাশকের মেলা নয়। লেখকদেরও মেলা।
আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আপনাকে মেলা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
আমি বেশ মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। তারপর অবশ্য ঘটনা অনেকদূর গেল। অনেক প্রকাশক ঘোষণা করলেন তাঁরা মেলা করবেন না। সংসদে পর্যন্ত বিষয়টি উঠল। বাংলা একাডেমীর ডিজি আমার ধানমণ্ডির বাসায় উপস্থিত হয়ে বলতে শুরু করলেন, আমার লেখা তাঁর কত পছন্দ ইত্যাদি।
আমি মেলায় যাওয়া এরপর থেকে বন্ধই করে দিলাম। এক দিন কিংবা দুদিন শুধু যাই। আমার অবস্থা চিলের মতো। চিল আকাশে ওড়ে, তার মন পড়ে থাকে মাটিতে। আমি আমার ঘরের বারান্দায় বসে থাকি, আমার মন পড়ে থাকে বইমেলায়।
আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি, তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মাজহারুল ইসলাম, অন্যপ্রকাশের মালিক। তিনি হুমায়ূন আহমেদ টাইপ বাজারি লেখকদের বই ছেপে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার স্টলের সামনে নাকি ভিড় লেগে থাকে। অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীরা মাছির মতো ভিড় করে বাজারি লেখকদের বই কিনতে চায়।
ভালো কথা, বাজারি লেখক বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা দরকার। বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাঁদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাঁদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তাঁরা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশির ভাগের ধারণা, তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমণের নমুনা, 'অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎসাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।...'
কালজয়ী এসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশির ভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা কিছুটা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা_
কালজয়ী : কেমন আছেন?
আমি : জি ভালো।
কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।
কালজয়ী : (গম্ভীর)
আমি : আপনি কি মহান কোন লেখায় হাত দিয়েছেন?
কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।

কালজয়ীরা আবার স্তুতি পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রহ মনে করেন বলেই উপগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। গ্রহদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনোই থাকে না, কিন্তু উপগ্রহের সঙ্গে থাকে। উপগ্রহরা উপযাজক হয়েই টেলিফোন করেন। তাঁদের টেলিফোন পেলে আতঙ্কিত বোধ করি। কেন আতঙ্কিত বোধ করি তা ব্যাখ্যা করছি_
উপগ্রহের টেলিফোন এসেছে, কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ।
হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছে।
কে শুইয়েছেন?
বদরুদ্দীন উমর।
কোথায় শোয়ালেন?
সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়েলে। উনি বলেছেন, আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নাই।
এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক বই হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম_ কোয়ান্টাম রসায়ন । সম্ভবত ওনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
না হুমায়ূন ভাই, আপনি জিনিসটা হালকা দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বাদানুবাদ হওয়া উচিত। আপনি একটা কাউন্টার লেখা দিন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
আমি টেলিফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাতের আড্ডায় আমার সমকাল-এর পাতায় শুয়ে পড়ার ঘটনা বললাম। বন্ধুরা আনন্দ পেল। আমার যেকোনো পতন আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দময়।
এখন শিক্ষা বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটক-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদে প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতেই আমি লিখে দিতাম_ 'এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।'
সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ সমালোচকরাই শুধু যে শিক্ষা খোঁজেন তা নয়, দেশের প্রধানরাও শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। তাঁরাও একে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানান ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড হাতে নেন।
শিক্ষা নিয়ে এত উদ্বেগের পরও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই মূর্খ হচ্ছি কেন কে বলবে?
আচ্ছা শিক্ষা আপাতত থাকুক। মহান কালজয়ীরা বর্তমানের কুসাহিত্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির হতে থাকুন, আমি ফিরে যাই বইমেলায়। আপনারা কি জানেন, মেলায় প্রকাশিত চমৎকার সব প্রচ্ছদের বইগুলোর বেশির ভাগ লেখক প্রবাসী! তাঁরা বছরে একবার ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে দেশে আসেন। প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তি হয়। খরচ তাঁদের। প্রকাশকরা শুধু বই ছেপে দেবেন। প্রবাসী লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন খুব ঘটা করে হয়। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের হাতে কাজকর্ম নেই বলেই হয়তো মোড়ক উন্মোচন নামক অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাকলেই পাওয়া যায়।
দুই বছর আগের কথা। এক প্রবাসী কবির বই বের হয়েছে, তিনি চাচ্ছেন আমি বইটির মোড়ক উন্মোচন করি। আমি বললাম, না। আমি একদিনের জন্য মেলায় যাই। সেদিনটা মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নষ্ট করব না।
ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত মন খারাপ করলেন। তাঁদের মন খারাপ দেখে আমার নিজের মন খারাপ হয়ে গেল। আমি তখন বিকল্প প্রস্তাব দিলাম। আমি বললাম, আপনারা নুহাশ পল্লীতে চলে আসুন। নুহাশ পল্লীর দিঘিতে আমার একটা নৌকা আছে। আপনি নৌকায় বসে নিজের কবিতা আবৃত্তি করবেন। আমরা দিঘির ঘাটে বসে থাকব। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করে আপনাকে একটা কপি দেব। সেই ভিডিও আপনি বন্ধুবান্ধবদের দেখাবেন। এর জন্য আপনাকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। নুহাশ চলচ্চিত্র ভিডিও করে দেবে।
ভদ্রলোক আনন্দে অভিভূত হলেন।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান হলো। তিনি নৌকায় দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছেন। আমাদের ব্যবস্থা দেখে তাঁর চোখে একটু পর পর পানি আসছে। তিনি চোখ মুছছেন। তাঁর স্ত্রীও আমার পাশে বসেই কবিতা শুনছিলেন। তিনি একপর্যায়ে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে যা বললেন তার সরল বাংলা হলো, তাঁদের দুজনের জীবনে অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা আজকের অভিজ্ঞতা। তাঁরা সারা জীবন এই সুখস্মৃতি অন্তরে লালন করবেন। তাঁর স্বামীর একটা কবিতার বইও যদি কেউ না কেনে, তাতেও কিছুই আর যায় আসে না।
এই প্রবাসী কবির কথা থাকুক, অন্য আরেকজনের গল্প করি। তিনি কানাডাপ্রবাসী কবি। তাঁর নাম ইকবাল হাসান। প্রতিবছরই বইমেলায় তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই কবি আমাকে একবার ভালো বিপদে ফেলেছিলেন। বিপদের গল্পটি বলা যেতে পারে।
আমি গিয়েছি নিউইয়র্কে। বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছেন। আমি বইমেলার অতিথি। মেলা উপলক্ষে কানাডা থেকে কবি ইকবাল হাসান এসেছেন। তিনি আমাকে ধরে বসলেন, একটা ইন্টারভিউ তাঁকে দিতেই হবে। আমার নিশ্চয়ই তখন শনির দশা চলছিল, কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। ইন্টারভিউ পর্ব শুরু হওয়া মাত্র বুঝলাম_ঘটনা অন্য। ইকবাল হাসানের প্রশ্নের নমুনা শুনলে পাঠকও বলবেন, ঘটনা অন্য। প্রশ্নের নমুনা_
'অনেকেই এখন বলছেন আপনি উপন্যাস হিসেবে যা লেখেন তা আসলে অপন্যাস। আপনি কী বলেন?'
'আপনার হালকা লেখাগুলি কি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে লেখা হয়?'
'জীবনের গভীর বোধ আপনার লেখায় অনুপস্থিত কেন?'
'একই গল্প আপনি একটু এদিক ওদিক করে লেখেন। আপনার এই সীমাবদ্ধতার কারণ কী?
'আপনার বানানো নাটক-সিনেমা আপনার বইগুলির মতোই হালকা এবং অগভীর। এর কারণ কী?'
আমি হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তিনি যে উত্তর শুনতে চাইছেন তা-ই বললাম। বললাম, আমার লেখা সস্তা। টাকার জন্য লেখি_এইসব।
এবারের বইমেলায় (২০১০) ইকবাল হাসান এসেছেন। সমকাল পত্রিকায় কলাম লিখছেন। হঠাৎ সেখানে আমাকে নিয়ে এক লেখা। কি লেখা থাকবে জানি। ভদ্রভাবে গালাগালি। কবিরা সুন্দর কাব্যময় গদ্যে গালাগালি করতে পারেন। ইকবাল হাসানের লেখা পড়ে চমকালাম। ইকবাল হাসান উল্টাগীত ধরেছেন। রচনা পাঠ করে মনে হলো_হুমায়ূন আহমেদ একজন মহান লেখক। যাঁরা তার নিন্দামন্দ করেন, তাঁরাও সুযোগ পেলেই গোপনে তার বই পড়েন ইত্যাদি।
আমার খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু খুশি হওয়া গেল না। মনে হলো কবি নিশ্চয়ই অসুস্থ। সুস্থ ইকবাল হাসান এ ধরনের লেখা অবশ্যই লিখবেন না।
তিনি দুপুরে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, আমি তাঁর লেখা পড়েছি কি না।
আমি বললাম, পড়েছি। উল্টাগীত গাইছেন কেন?
কবি বললেন, আগে যখন আপনার ইন্টারভিউ নিয়েছি, তখন আমি অপরিপক্ব ছিলাম।
আমি বললাম, এখন কি পেকেছেন?
কবি হতাশাগ্রস্ত গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, আমি এ দেশের একমাত্র কবি যে আপনার নুহাশ পল্লী নিয়ে কবিতা লিখেছে। আর কেউ কিন্তু লিখেনি। আপনি কেন এরকম করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন!
আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। তাঁর লেখা কবিতাটি পত্রস্থ করা হলো।

নুহাশ পল্লী

নিঃশ্বাস ফেলবে কোথায়? নেবে শ্বাস?
শরীরকে দেবে অক্সিজেন? এখন বাতাসে
শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড_শুষে নেবে তেমন বৃক্ষ কোথায়?
যেদিকে তাকাবে তুমি শুধু দূষিত বাতাস। 'বড় হয়ে
দেখবে, পৃথিবী সুন্দর কতো'_মধ্যবয়সে এসে দেখি,
এসব আশ্বাসবাণী শুধু শূন্যে ঝরে পড়ে। হাওয়া নেই
শহরে ও গ্রামে। সবকিছু গিলে খাচ্ছে বিষাক্ত আকাশ।

যদিও স্বপ্ন দ্যাখায় প্রভাতের রোদ আর রাতের নক্ষত্র
তবু ভাবি : মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো, আর কবে
আমাদের গ্রামগুলো নুহাশ পল্লীর মতো স্বয়ম্ভর হবে?
[আকাশপরী, ইকবাল হাসান, পৃষ্ঠা-১৫, দি রয়েল পাবলিশার্স, ঢাকা]

পাদটীকা

পোকারা আমাদের ওপর রাগ করে কামড়ায় না। তারা বেঁচে থাকতে চায় বলেই কামড়ায়। সমালোচকদের বেলায়ও কথাটা সত্য। তারা আমাদের রক্ত চায়, আমাদের কষ্ট চায় না।
ফ্রেডারিখ নীট্শে।

২.
ধর্মকর্ম

(বাংলা ভাষার অতি বিচিত্র বিষয় হলো শব্দের দ্বৈততা_গল্পগুজব, ফলমূল, হাসিঠাট্টা, খেলাধুলা। ধর্ম শব্দটি বেশিরভাগ সময়ই কর্মের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সম্ভবত কর্মকে আমরা ধর্মের সমার্থক ভাবি।)
আমি এসেছি অতি কঠিন গোঁড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি 'মৌলবিবাড়ি' নামে এখনো পরিচিত।
ছোটবেলায় দেখেছি দাদার বাড়ির মূল অংশে বড় বড় পর্দা ঝুলছে। পর্দার আড়ালে থাকতেন মহিলারা। তাদের কণ্ঠস্বর পুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় তারা ফিসফিস করে কথা বলতেন। হাতে চুড়ি পরতেন না। চুড়ির রিনঝিন শব্দও পরপুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ। দাদাজান বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন হাততালির মাধ্যমে। এক হাততালির অর্থ-পানি খাবেন। দুই হাততালি-পান তামাক ইত্যাদি।
একবার বড় ঈদ উপলক্ষে দাদার বাড়িতে গিয়েছি। আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। দাদাজান ডেকে পাঠালেন। বললেন, কলেমা তৈয়ব পড়।
আমি বললাম, জানি না তো।
দাদাজানের মুখ গম্ভীর হলো। দাদিজান আবার তাৎক্ষণিক শাস্তির পক্ষে। তিনি বললেন, পুলারে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, কলেমা জানে না।
দাদাজান বিরক্তমুখে বললেন, সে ছোট মানুষ। শাস্তি তার প্রাপ্য না। শাস্তি তার বাবা-মা'র প্রাপ্য।
বাবা-মা'র শাস্তি হয়েছিল কি না আমি জানি না। দাদা-দাদির কাছ থেকে মুক্তি পাচ্ছি এতেই আমি খুশি। ছুটে বের হতে যাচ্ছি, দাদাজান আটকালেন। কঠিন এক নির্দেশ জারি করলেন। এই নির্দেশে আমি সব জায়গায় যেতে পারব, একটা বিশেষ বাড়িতে যেতে পারব না। এই বিশেষ বাড়িটা দাদার বাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মতো দূরে। গাছপালায় ঢাকা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে টলটলা পানির দিঘি। আমি অবাক হয়ে বললাম, ওই বাড়িতে কেন যাব না?
দাদিজান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পুলা বেশি কথা কয়। এরে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, মুখে মুখে কথা।
দাদাজান শাস্তির দিকে গেলেন না। শীতল গলায় বললেন, ওই বাড়িতে ধর্মের নামে বেদাত হয়। ওই বাড়ি মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ। দিনের বেলা যাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পর না।
আমি ছোটচাচাকে ধরলাম যেন ওই বাড়িতে যেতে পারি। ছোটচাচা বললেন নিয়ে যাবেন। ওই বাড়ির বিষয়ে ছোটচাচার কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো_ওই বাড়ি মুসলমান বাড়ি। তবে তারা অন্যরকম মুসলমান। সন্ধ্যার পর পুরুষ মানুষরা নাচে।
ঘটনা কী জানার জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। সারাটা দিন ছটফটানির ভেতর দিয়ে গেল। সন্ধ্যা মিলাবার পর ছোটচাচার সঙ্গে ওই বাড়ির বৈঠকখানায় উপস্থিত হলাম। বাড়ির প্রধান শান্ত সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ আমাকে কোলে নিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ফয়জুরের ছেলে আসছে। ফয়জুরের বড় পুলা আসছে। এরে কিছু খাইতে দাও।
সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় সত্যি সত্যি পুরুষদের নাচ শুরু হলো। ঘুরে ঘুরে নাচ। নাচের সঙ্গে সবাই মিলে একসঙ্গে বলছে 'আল্লাহু আল্লাহু'। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ভেতর মত্ততা দেখা দিল। একজন অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাল না। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চক্রাকারে ঘুরে নাচতেই থাকল। ছোটচাচা গলা নামিয়ে আমাকে কানে কানে বললেন, একটা মাত্র পড়েছে। আরও পড়ব। ধুপধাপ কইরা পড়ব। দেখ মজা।
ছোটচাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুপ করে আরো একজন পড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন কিছুই বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে_এরা কি কোনোভাবে সুফিবাদের সঙ্গে যুক্ত? ড্যান্সিং দরবেশ? এদের পোশাক সে রকম না, লুঙ্গি-গামছা পরা মানুষ। কিন্তু নৃত্যের ভঙ্গি এবং জিগির তো একই রকম। ড্যান্সিং দরবেশদের মধ্যে একসময় আবেশ তৈরি হয়। তারাও মূর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এখানেও তো তাই হচ্ছে।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুফিবাদ আসবেইবা কীভাবে? কে এনেছে? কেন এনেছে? যখন কলেজে পড়ি (১৯৬৬) তখন কিছু খোঁজখবর বের করার চেষ্টা করেছি। এই বিশেষ ধরনের আরাধনা কে প্রথম শুরু করেন? এইসব। উত্তর পাইনি। তাদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তার নমুনা দিচ্ছি।
প্রশ্ন: নাচতে নাচতে আপনি দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখন কী হয়?
উত্তর: ভাবে চইলা যাই।
প্রশ্ন: কী রকম ভাব?
উত্তর: অন্য দুনিয়ার ভাব।
প্রশ্ন: পরিষ্কার করে বলুন।
উত্তর: বলতে পারব না। ভাবের বিষয়।
প্রশ্ন: চোখের সামনে কিছু দেখেন?
উত্তর: ভাব দেখি। উনারে দেখি।
প্রশ্ন: উনারে দেখেন মানে কী? উনি কে?
উত্তর: উনি ভাব।
সুফিবাদের উৎস হিসেবে ধরা হয় নবীজি (দ.)-এর সঙ্গে জিব্রাইল আলায়েস সালামের সরাসরি সাক্ষাতের হাদিস থেকে। একদিন নবীজি (দ.) বসে ছিলেন। মানুষের রূপ ধরে জিব্রাইল আলায়েস সালাম তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বললেন। একটি হলো-নিবেদন (Submission, ইসলাম), আরেকটি হলো বিশ্বাস (Faith, ঈমান), আর তৃতীয়টি হলো সুন্দর কর্মসাধন (Doing the beautiful, Bnmvb)।
প্রথম দুটি ইসলাম এবং ঈমান, ধর্মের পাঁচস্তম্ভের মধ্যে আছে। তৃতীয়টি নেই। এই তৃতীয়টি থেকেই সুফিবাদের শুরু।
সুফিবাদ বিষয়ে আমার জ্ঞান শুধু যে ভাসাভাসা তা নয়, ভাসাভাসার চেয়েও ভাসাভাসা। দোষ আমার না। দোষ সুফিবাদের দুর্বোধ্যতা এবং জটিলতার। সুফি সাধকদের রচনা পাঠ করেছি। তেমন কিছু বুঝিনি। পশ্চিমাদের লেখা সুফিবাদের বইগুলো জটিলতা বৃদ্ধি করেছে, কমাতে পারেনি।
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সুফিবাদ বলছে_'I was a Hidden Treasure, so I loved to be known. Hence I created the creatures that I might be known.' [আমি ছিলাম লুকানো রত্ন। নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা হলো। আমি সৃষ্টি করলাম যাতে প্রকাশিত হই।]
সুফিবাদের একটি ধারণা হলো_সৃষ্টিকর্তা মানুষকে করুণা করেন এবং ভালোবাসেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারবে কিন্তু করুণা করতে পারবে না। ভালোবাসা দু'দিকেই চলাচল করতে সক্ষম, করুণার গতি শুধুই একমুখী।
একইভাবে মানুষ পশুপাখিকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে। পশুপাখি মানুষকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে না।
বাস্তবতা নিয়ে সুফিদের অনেক বিশুদ্ধ চিন্তা আছে। তাদের চিন্তার সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার কিছু মিল আছে। সুফিরা বলেন, আমাদের দৃশ্যমান জগৎ অবাস্তব। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বাস্তব।
সুফিরা বলেন, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে আমরা দেখি, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমেই আমরা শুনি।
সুফিদের আরাধনার মূল বিষয়টি আমার পছন্দের। তাঁরা প্রার্থনা করেন-'Show me the things as they are.' [বস্তুগুলো যে-রকম আমাকে সে-রকম দেখাও।] তাঁদের প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বস্তুগুলো যে-রকম দেখছি আসলে সে-রকম না।
মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে আল্লাহপাকের সাক্ষাতের ঘটনার সুফি ব্যাখ্যা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। পাঠকদের সঙ্গে সুফি ব্যাখ্যা ভাগাভাগি করতে চাচ্ছি।
তুর পর্বতের সামনে এই সাক্ষাতের ঘটনা ঘটে। তুর পর্বত কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে মূসা (আ.) মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুফি ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ বাস্তব আর সবই অবাস্তব। কাজেই বাস্তব আল্লাহর উপস্থিতিতে অবাস্তব পাহাড় মিলিয়ে গেল।
আমি কি ধর্মকর্ম বিষয়টা যথেষ্ট জটিল করার চেষ্টা চালাচ্ছি? মনে হয় তাই। সহজিয়া ধারায় চলে আসা যাক। সুফিদের কথা বাদ। নিজের কথা বলি।
ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। পাঠকদের হজরত শাহ মখদুম সম্পর্কে একটি অন্যরকম তথ্য দিই। তাঁর জীবনী লেখা হয় ফারসি ভাষাতে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের আদেশে এই জীবনী ফারসি থেকে বাংলা তরজমা করা হয়। এই বাংলা তরজমা আদি বাংলা গদ্যের নিদর্শন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রদের পাঠ্য ছিল। বইটি একসময় বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন প্রকাশ করেছিল। আমার কাছে একটি কপি ছিল। বিটিভির নওয়াজেশ আলী খান পড়তে নিয়ে ফেরত দেননি। বইটির দ্বিতীয় কপি জোগাড় করতে পারিনি। (ফাউনটেনপেন লেখায় যাঁরা আমার সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো নিয়ে ফেরত দেননি তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। কাজেই সাবধান। আমার আরেকটি প্রিয় গ্রন্থ মিসরের গভর্নরকে লেখা হজরত আলীর চিঠি কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খান পাঁচ বছর আগে নিয়েছেন। এখনো ফেরত দেননি।)
পূর্বকথায় ফিরে যাই। আমি যে শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মাজারে যাই তা কিন্তু না। যে-কোনো ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ। এই আগ্রহ নিয়েই পাবনা শহরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে একদিন উপস্থিত হলাম। ইনি কথাশিল্পী শীর্ষেন্দুর ঠাকুর। তাঁর প্রতিটি বইতেই থাকবে র:স্থা যা অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত। শীর্ষেন্দুর জবানিতে_একসময় তিনি জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আত্দহননের কথা চিন্তা করছিলেন। তখন অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। অনুকূল ঠাকুর হাত দিয়ে শীর্ষেন্দুকে স্পর্শ করা মাত্র কিছু একটা ঘটে গেল। শীর্ষেন্দু জীবনের প্রতি মমতা ফিরে পেলেন। তাঁর লেখালেখির শুরুও এরপর থেকেই।
অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতরা আমাকে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন। দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। আশ্রমের প্রধান অনুকূল ঠাকুরের বিশাল এক তৈলচিত্রের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুগ্ধ গলায় বললেন, ঠাকুরের রহস্যটা একটু দেখুন স্যার। আপনি যেখানেই দাঁড়ান না কেন মনে হবে ঠাকুর আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তরে দাঁড়ান কিংবা পুবে দাঁড়ান, ঠাকুরের দৃষ্টি আপনার দিকে।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, সরাসরি ক্যামেরা লেন্সের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি একটি ছবি তোলেন সেই ছবিতেও একই ব্যাপার হবে। সবকিছুতে মহিমা আরোপ না করাই ভালো। সেবায়েত আমার কথায় মন খারাপ করলেও বিষয়টি স্বীকার করলেন।
অনেক বছর আগে নেপালে হনুমানজির মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া সেখানে কেউ যেতে পারবে না। মন্দিরের একজন সেবায়েতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো মানুষটা বুদ্ধিমান। আমি তাঁকে কাছে ডেকে বললাম, ভাই, মন্দিরের কাছে কিছু কুকুর দেখতে পাচ্ছি। ওরা মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে পারবে, আর আমি মানুষ হয়ে যেতে পারব না। এটা কি ঠিক?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাইনি। কেন জানি হঠাৎ করে মন উঠে গেল।
আমাদের অতি পবিত্র স্থান মক্কা শরীফে অমুসলমানদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমাদের নবীজি (দ.)-এর জীবদ্দশায় অনেক অমুসলমান সেখানে বাস করতেন। কাবার কাছে যেতেন। তাদের ওপর কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল বলে আমি বইপত্রে পড়িনি। ধর্ম আমাদের উদার করবে। অনুদার করবে কেন?

পাদটীকা:
প্রশ্ন: মুসলমান মাত্রই বেতের নামাজের কথা জানেন। তিন রাকাতের নামাজ। বেতের শব্দের অর্থ বেজোড়। এক একটি বেজোড় সংখ্যা। এক রাকাতের নামাজ কি পড়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ যায়।
(আমি মনগড়া কথা বলছি না। জেনেশুনেই বলছি।
_________________________________________
*পর্ব ৩-৪

*পর্ব ৫-৬

*পর্ব ৭-৮

*পর্ব ৯-১০

*পর্ব ১১
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১০ রাত ৯:৫২
৪১টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×