দৈনিক কালের কন্ঠের ফিচার পাতা "শিলালিপি" তে হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।আমিও এখানে ধারাবাহিক ভাবে তারই কপি-পেষ্ট করব।
*পর্ব ১-২
৩.
ছাইঞ্চ মিয়া
স্যার, আমার নাম 'ছাইঞ্চ' মিয়া।
কী নাম বলেছ?
ছাইঞ্চ মিয়া।
গ্রামের মানুষদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রাখার প্রবণতা আছে। তবে সেসব নাম সহজ হয়। উচ্চারণে অসুবিধা হয় না। 'ছাইঞ্চ' যথেষ্ট জটিল। আমি বললাম, এই নামের অর্থ কী?
লেহা-পড়া। এই নামের অর্থ লেহা-পড়া।
আমি বললাম, সায়েন্স থেকে ছাইন্স? বিজ্ঞান?
জায়গামতো ধরছেন স্যার। এইটাও আমার নাম।
ঘটনা যা জানলাম তা হলো ছাইন্স মিয়ার আসল নাম ছাত্তার। সে আট-নয় বছর বয়সে নীলগঞ্জ স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক আজিজ মাস্টারের বাড়িতে কাজের ছেলে হিসেবে যোগ দেয়। আজিজ মাস্টার ছাত্তারের নানান বিষয়ে আগ্রহ ও কৌতূহল দেখে তাকে আদর করে ডাকতেন সায়েন্স। সেখান থেকে ছাইঞ্চ মিয়া।
এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্ত সবল। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ। গ্রামের মানুষদের সহজে টাক পড়ে না। এর মাথায় চুলের বংশও নেই। ছাইঞ্চ মিয়া কাজকর্ম কিছু করে না। স্কুলঘরের বারান্দায় ঘুমায়। ছাত্রদের হোস্টেলে রান্নাবান্নার বিনিময়ে খাবার পায়। মাছ মারায় তার বিশেষ পারদর্শিতা আছে। কৈ জাল দিয়ে কৈ মাছ ধরার ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। সে নাকি কিছুদিন পরপর মাছ মারার নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে।
ছাইঞ্চ মিয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন নিয়া আসছি স্যার। অনেকরে জিজ্ঞাস করেছি কেউ বলতে পারে নাই। আজিজ স্যারে বাঁইচা থাকলে উনি পারতেন। উনার মতো জ্ঞানী মানুষ খোদার আলমে নাই বললেই চলে।
আমি বললাম, অনেকেই যখন পারে নাই তখন আমারও না পারার কথা।
প্রশ্নটা কী?
জগতের সব ফল গোল। বেদানা, আপেল, বরই, আঙুর, আম, কাঁঠাল, ডাব, শরিফা। কিন্তু কলা ফলটা লম্বা। এর কারণ কী?
আমি একটু থতমত খেলাম। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, বুঝতাছি আপনে পারতেছেন না। আমি নিজে নিজে একটা উত্তর বাইর করেছি। স্যার বলব?
বলো।
আল্লাপাক গোল পছন্দ করেন এইজন্যে সব ফল গোল। কলা আল্লাপাক পছন্দ করেন না বিধায় কলা লম্বা। কলা খাওয়া এই কারণে ঠিক না। আমি সব ফল খাই, কলা খাই না।
আমি কিছু বললাম না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, যে ফল যত গোল সেটা তত 'উবগার', আমি হিসাবে এইটা পাই। স্যার ঠিক আছে?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, তুমি লেখাপড়া কতটুকু জানো?
বাংলা লেখতে-পড়তে পারি। নয় ঘর পর্যন্ত নামতা জানি। আজিজ স্যার শিখায়েছেন। ৯ একে ৯, ৯ দুকুনে ১৮, তিন নং ২৭ ...
ছাইঞ্চ মিয়া নয়ের ঘরের নামতা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। মাছ মারতে যাবে। তার কাছে শুনলাম সে কৈ মাছ ধরার একটা পদ্ধতি বের করেছে। এ পদ্ধতিতে শুধু ডিমওয়ালা কৈ মাছ ধরা পড়ে, ডিম ছাড়া কৈ কখনো না।
বিজ্ঞানের শুরুটা কোথায়?
জ্ঞানীরা বলেন, শুরু হলো কৌতূহলে। মানুষ কৌতূহলী হওয়ার কারণেই বিজ্ঞান। গাছের অনুভূতি আছে, কৌতূহল নেই বলেই বিজ্ঞানে গাছের অবদান নেই।
আমি জ্ঞানী না বলেই হয়তো জ্ঞানীদের কথা নিতে পারছি না। আমার মতে, বিজ্ঞানের শুরু খাদ্য অনুসন্ধানে। খাদ্য কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে_এই ব্যাকুলতা থেকেই বিজ্ঞান। আর গাছের কৌতূহল নেই তাইবা আমরা ধরে নেব কেন? আমার মনে হয়, গাছ তার নিজের মতো করেই কৌতূহলী। আমরা তার কৌতূহল ধরতে পারছি না।
নুহাশ পল্লীতে আমার দিন কাটে গাছপালার সঙ্গে। তাদের জগৎ বোঝার সাধ্যও আমার নেই। সেই চেষ্টাও বড় ধরনের বোকামি ছাড়া কিছু না। তারপরও গাছপালার বনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি_গাছদের কি চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? তারা কি ভাবতে পারে? কল্পনা করতে পারে?
বিশাল বৃক্ষকে 'বনসাই' বানানোর প্রবণতা আজকাল দেখতে পাচ্ছি। টবে বটগাছ, ঝুড়ি নেমে গেছে_এইসব। বনসাই বৃক্ষ যতবার দেখি ততবারই মন খারাপ হয়। একটা বিশাল বৃক্ষকে পঙ্গু বানিয়ে রাখার মানে কী? গত বৃক্ষমেলা থেকে অনেক দাম দিয়ে আমি দুটো বনসাই গাছ কিনলাম। একটা বট আরেকটা তেঁতুল। এই দুই বামুন বৃক্ষকে নুহাশ পল্লীতে নিয়ে এসে বললাম, আজ তোদের বনসাই অবস্থা থেকে মুক্তি দেব। তোরা সাধারণ বৃক্ষের মতো বড় হবি এবং অবশ্যই বলবি_একজন মানুষ আমাদের কষ্ট বুঝতে পেরে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। তোরা বলবি_মানুষের জয় হোক।
বনসাই গাছ দুটি পুঁতে দিলাম। এক বছরের আগেই তারা স্বাস্থ্যে, সৌন্দর্যে, প্রাণে ঝলমল করে উঠল। তারা এখন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে। আমার নানাবিধ পাগলামির একটি হচ্ছে, এই দুটি গাছের সঙ্গে কথা বলা। কথা বলার নমুনা (বটগাছের সঙ্গে)_
এই তোর অবস্থা কিরে? ঝুড়ি এর মধ্যেই নামিয়ে ফেলেছিস? ঝুড়ি নামানোর মতো অবস্থা তো হয়নি। ঘটনা কী? মালী তোকে ঠিকঠাক যত্ন করছে?
গাছের সঙ্গে তুই তুই করে কেন কথা বলি? জানি না।
গাছের কথা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকুক। আবার এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব, এখন বিজ্ঞান-কথা। একটা কুকুর দিয়ে শুরু করা যাক। সে ভরপেট খেয়ে উঠোনে শুয়ে আছে। এই মুহূর্তে খাদ্যের সন্ধানে সে যাবে না। এর অর্থ এই না সে তার চারপাশের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। শামুক তা-ই করত। খাওয়া শেষ হলেই খোলসের ভেতর ঢুকে খোলসের মুখ বন্ধ করে দিত। কুকুর তা করছে না। সে বিশ্রাম নিতে নিতেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ কান খাড়া করে দূরের কোনো শব্দ শুনছে। সে তথ্য সংগ্রহ করছে। এই তথ্যের কিছুটা সে তার মস্তিষ্কে জমা করে রাখবে। অনেকটাই ফেলে দেবে। যে প্রাণী যত উন্নত তার তথ্য সংগ্রহ এবং জমা রাখার পদ্ধতিও তত উন্নত। সৌরজগতের সবচেয়ে উন্নত প্রাণী মানুষের তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা বিস্ময়কর। এই তথ্য সংগ্রহের প্রায় সবটাই হলো কৌতূহলের কারণে।
পেনডোরার বাক্সের ঘটনা তো সবার জানা। গল্পটা এ রকম_পেনডোরাকে একটা বাক্স দিয়ে বলা হলো, খবরদার এই বাক্স তুমি খুলবে না। কৌতূহলের কারণে পেনডোরা সেই বাক্স খুলল, বাক্স থেকে বের হলো দুঃখ, কষ্ট, জরা, দুর্ভিক্ষ, ভয়ঙ্কর সব জিনিস। সেই থেকেই এসব পৃথিবীতে আছে। পেনডোরা কৌতূহলী না হলে আজ আমরা সুখে থাকতাম। পেনডোরার গল্পের সঙ্গে আদম-হাওয়ার গল্পের মিল আছে। কৌতূহলের কারণেই হাওয়া গন্ধম ফল খেলেন, নিজের স্বামীকে খাইয়ে পৃথিবীতে নির্বাসিত হলেন। পৃথিবীর গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট, জরা-মৃত্যু তাদের স্পর্শ করল।
মানুষ তথ্য সংগ্রহ করে, তথ্যগুলো সাজায়, তাদের ভেতরের মিল-অমিল বের করে। মিল-অমিলের পেছনে কী তা বের করার চেষ্টা করে এটাই বিজ্ঞান।
উদাহরণ দেই।
তথ্য
লোহা পানিতে ডুবে যায়, কাঠ ভাসে, তুলা ভাসে, পাখির পালক ভাসে, পিতল ডুবে যায়, পাথর ডুবে যায় ...
তথ্যের বিচার
লোহা, পিতল, পাথর পানিতে ডুবে যায়।
কাঠ, তুলা, পাখির পালক ভাসে।
বিজ্ঞান
পানির চেয়ে ভারী বস্তু ডুবে যাবে, পানির চেয়ে হালকা বস্তু ভেসে থাকবে।
জ্ঞান কিন্তু এইখানেই থেমে থাকবে না। আরও এগুবে। নতুন তথ্য যুক্ত হবে যেমন_
নতুন তথ্য
লোহা পানিতে ডুবে যায়, কিন্তু লোহার তৈরি নৌকা ভাসে।
কেন?
পিতল নদীতে ডুবে যায়, কিন্তু পিতলের কলসি পানিতে ভাসে। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হলো। একদিন আর্কিমিডিস স্নানঘরের চৌবাচ্চায় নগ্ন হয়ে স্নান করতে নামলেন। নেমেই উত্তর পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ঊঁৎবশধ! কথিত আছে তিনি নগ্ন অবস্থায় রাজপথে নেমে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ঊঁৎবশধ! ঊঁৎবশধ! পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি।
লেখক হিসেবে আমাকে মাঝে মধ্যে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। যেমন, আপনার কি মৃত্যুভীতি আছে?
উত্তরে আমি বলি, আমার মৃত্যুভীতি নেই, তবে মৃত্যুর বিষয়ে প্রবল বিদ্বেষ আছে। আমি মোটামুটি এক হাজার বছর বেঁচে তারপর মরতে চাই।
কেন?
কচ্ছপের মতো তুচ্ছ একটি প্রাণী তিনশ, সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে আর মানুষের মতো এত ক্ষমতাধর প্রাণী সত্তর-আশি বছরেই শেষ। এর কোনো অর্থ আছে?
এক হাজার বছর বাঁচতে চান কেন?
বিজ্ঞানের মহান আবিষ্কারগুলো দেখে মরতে চাই। পেনডোরার বাক্স থেকে যেসব ভয়ঙ্কর জিনিস বের হয়েছিল বিজ্ঞান সব ক'টাকে আবার বাক্সে ঢোকাবে। সেই বাক্স বিজ্ঞান ধ্বংস করে দেবে। এই দৃশ্য দেখার আমার শখ।
বিজ্ঞান কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবে। যেমন আমরা কে? পৃথিবীতে কেন জন্ম নিয়েছি? আমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি?
সৃষ্টির মূল রহস্য বিজ্ঞানই ভেদ করবে। আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ বিজ্ঞান করবে। ফিলসফি না।
বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আমার আস্থা এবং ভরসা সীমাহীন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তার যাত্রা অনংঃৎধপঃ-এর দিকে। কোয়ান্টাম থিওরি, স্ট্রিং থিওরি সবকিছু আমার মতো সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা চলে যাচ্ছে ফিলসফির দিকে। সুফিরা যেমন বলেন, সবই মায়া; বিজ্ঞানও বলা শুরু করেছে, সবই মায়া।
কবি রিল্কে (জধরহবৎ গধৎরধ জরষশব) তার ঞযব ঞবহঃয ঊষবমু-তে বলেছেন_
... যড় িধষরবহ, ধষধং ধৎব ঃযব ংঃৎববঃং
ড়ভ ঃযব পরঃু ড়ভ মৎরবভ.
এখানে মৎরবভ-এর বদলে ংপরবহপব লিখে দিলে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হবে_
... যড় িধষরবহ, ধষধং ধৎব ঃযব ংঃৎববঃং
ড়ভ ঃযব পরঃু ড়ভ ংপরবহপব.
আমি একপর্যায়ে গাছপালার কাছে ফিরে আসব বলেছিলাম, এখন ফিরলাম।
গাছপালা খাদ্যের সন্ধানে যেতে পারে না। তাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সূর্যের আলো তার গায়ে পড়ে। এখান থেকেই সে খাবার তৈরি করে। সে খাদ্যচিন্তা থেকে মুক্ত। মুক্ত বলেই সে তার চিন্তা অন্যদিকে নিতে পারে। তার অনুভূতি আছে। তার সেই অনুভূতির নিয়ন্ত্রকও থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণটা কোথায়?
আমার ভাবতে ভালো লাগে বৃক্ষরাজি অনেক রহস্যই জানে। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে এইসব রহস্য মানুষকে জানাতে পারছে না। মানুষও তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে গাছের কাছ থেকে কিছু জানতে পারছে না। একদিন সীমাবদ্ধতা দূর হবে। বৃক্ষরাজি কথা বলা শুরু করবে। কী অদ্ভুত কাণ্ডই না তখন ঘটবে!
গাছপালা বিষয়ে নবীজী (দ.)-এর একটি চমৎকার হাদিস আছে। তিনি বলছেন, মনে করো তোমার হাতে গাছের একটি চারা আছে। যে-কোনোভাবেই হোক তুমি জেনে ফেলেছ পরদিন রোজ কেয়ামত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরেও গাছের চারাটি তুমি মাটিতে লাগিয়ো।
পাদটীকা
দর্শন হলো একটি অপ্রয়োজনীয় এবং ভুল শাস্ত্র।
_দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি
৪.
পড়াশোনা
বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার_পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।
আমরা যেভাবে পড়ি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। 'বৃদ্ধ বোকা সংঘের' আসরে যে কথা বলে তার কথা শুনতেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে কথা বলে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না।
একটা বয়স পার হলে মানুষ 'কথা বলা রোগ'-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু হয়। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তার পর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো কথাই নেই।
প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন, শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও, স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরত। এই স্নান থেকেই এসেছে 'স্নাতক' শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।
পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালীন স্নান করেনি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষ দিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।
আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।
ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গুরুর কথা শুনত। নবীজি (সা.)-কে আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়_'পড়ো! তোমার প্রভুর নামে...'
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।
আমার আত্দীয়স্বজনরা মাঝেমধ্যে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাঁদের ধারণা, আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলো নাকি 'অতি উত্তম'। তাঁদের কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তাঁরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে 'অতি উত্তম' কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা।
লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন_এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। তাঁরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারো সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহাবিরক্ত হতেন।
উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধু তাঁর মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্র্যান্ডমাস্টার আইজাক এসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।
আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম, সেটা ব্যাখ্যা করি। হঠাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণামূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন_
'হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করে সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।...'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় 'অন্যদিন' পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে)। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?
মাজহার বলল, স্যার, ভয়েস রেকর্ডার।
ভয়েস রেকর্ডার কেন?
এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না।
শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, স্যরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্দজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তার চেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে।
নিজের প্রশংসা নিজে করার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ ইমদাদুল হক মিলন। গত বইমেলা বিষয়ে তার একটা লেখা কালের কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছে। সে লিখেছে...
তখন আমার একটা বই বাংলা একাডেমী বেস্ট সেলার ঘোষণা করেছে। পাঠক-পাঠিকা বইটির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রকাশক চাহিদামতো বই জোগান দিতে পারছে না। বইটির জন্যে বইমেলার অনেক জায়গায় কাটাকাটি মারামারি হচ্ছে...
যখন লেখালেখি করি না, আড্ডা দিতে বসি না, তখন কী করে সময় কাটাই? এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে টেলিফোনে এক সাংবাদিক করলেন। আমি বললাম, তখন আমি একটা কাঁচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটেই সময় কাটাই।
সাংবাদিক আমার কথায় আহত হয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর জানার জন্যে এবং পাঠকদের জানার জন্যে বলি_তখন আমি সিনেমা দেখি এবং পড়ি। আমার কাছে মোটা একটা বই আছে। বইয়ের নাম 'ঙহব ঃযড়ঁংধহফ ড়হব ভরষস ঃযধঃ ুড়ঁ সঁংঃ ংবব নবভড়ৎব ুড়ঁ ফরব.' [এক হাজার একটি ছবি যা মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতেই হবে।] বই দেখে দেখে ভিডিওর দোকান থেকে ফিল্ম আনি। ছবি দেখার পর বই থেকে নামটা কেটে দিই।
বইয়ে নাম নেই এমন ছবিও দেখা হয়। যেমন, সম্প্রতি দেখেছি আধঃবৎ, ঞরসব ঃৎধাবষষবৎ'ং রিভব.
বলতে ভুলে গেছি, আমি নিজে এক হাজার একটি বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করছি। যে বইগুলো মৃত্যুর আগে অবশ্যই পড়া উচিত। একটি বই পড়তে তিন দিন লাগলে ১০০১টি বই পড়তে লাগবে মাত্র দশ বছর।
পৃথিবীর সব লেখকের দোষগুলো আমার মধ্যে আছে। একটা গুণও আছে। আমিও লেখকদের মতো প্রচুর বই পড়ি। একসময় গল্প-উপন্যাস পড়তাম। এখন জানি না কেন গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে না। বই সবচেয়ে বেশি পড়ি যখন দেশের বাইরে যাই।
বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আমার দুটি স্যুটকেস গোছানো হয়। একটায় থাকে কাপড়চোপড়। এটা শাওন গোছায়। আরেকটায় থাকে 'জবধফরহম গধঃবৎরধষ' বাংলায় 'পাঠবস্তু'। দুই মাস আগে মিসরের পিরামিড দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া বাতিল হয়েছে। 'জবধফরহম গধঃবৎরধষ'-এর স্যুটকেস গোছানোই আছে।
সেখানে কী কী বই নেওয়া হয়েছে তার তালিকা দিচ্ছি_
১. একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশন। আগরতলা বইমেলা থেকে একগাদা সায়েন্স ফিকশন কিনেছিলাম। একটাও পড়া হয়নি। যখনই বাইরে যাই একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাই। কেন জানি কখনো পড়া হয় না।
অসনধংংধফড়ৎ ডরঃযড়ঁঃ ঈৎবফবহঃরধষং
ঝবৎমবর ঝহবমড়া (জধফঁমধ চঁনষরংযবৎং)
২. ঞযব ঞৎধাবষং ড়ভ গধৎপড়ঢ়ড়ষড়
এ বইটি আমি আগে একবার পড়েছি। আবারও সঙ্গে নিচ্ছি কারণ মার্কোপোলোর গাঁজাখুরি ভ্রমণকাহিনী পড়তে ভালো লাগে।
সচেতন পাঠক নিশ্চয় ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনীকে আমি গাঁজাখুরি বলছি। কারণ ব্যাখ্যা করি। তিনি ভারতবর্ষে (বর্ণনা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ) এক দল মানুষ দেখেছেন, যাদের মুখ কুকুরের মতো। এরা কুকুরের মতোই ডাকে।
এই বাংলাদেশেই আরেক দল মানুষ দেখেছেন যারা প্রকাশ্যে যৌনসঙ্গম করে। এতে কোনো লজ্জা বোধ করে না।
তিনি চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু গ্রেট চায়নিজ ওয়াল তাঁর চোখে পড়েনি।
৩. ঞযব ঊহফ ড়ভ ঃরসব
এটি বিজ্ঞানের বই। 'সময়' কী তা ব্যাখ্যা করা। সহজপাঠ্য।
৪. ঞযব উবসড়হ ঐধহঁহঃবফ ডড়ৎষফ
ঈধৎষ ঝধমধহ.
কার্ল সেগান আমার অতি পছন্দের লেখকদের একজন। তাঁর লেখা ঈড়ংসড়ং বইটির আমি একসঙ্গে দুটি কপি কিনেছিলাম যাতে একটি হারিয়ে গেলে অন্যটি থাকে। হায় খোদা, দুটিই হারিয়েছে!
৫. বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বাবুরনামা। এই বইটিও আগে ইংরেজিতে পড়া। আবারও পড়ছি, কারণ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার বাসনা আছে। সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস। নাম দেব 'বাদশাহ নামদার'। হুমায়ুন প্রসঙ্গে যেখানে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি।
কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?
আছে। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি_তা জানানো।
আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটেছি একটা বিষয় জানার জন্যে_বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোশাকের কথা আছে, সংগীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।
লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।
অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা।
লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখা_১. পথের পাঁচালী
২. দৃষ্টি প্রদীপ
৩. আরণ্যক
৪. ইছামতী
৫. দেবযান
পাদটীকা
ইড়ড়শং ধৎব ধ ফবষরমযঃভঁষ ংড়পরবঃু. ওভ ুড়ঁ মড় রহঃড় ধ ৎড়ড়স ভরষষবফ রিঃয নড়ড়শং, বাবহ রিঃযড়ঁঃ ঃধশরহম ঃযবস ফড়হি ভৎড়স ঃযবরৎ ংযবষাবং, ঃযবু ংববস ঃড় ংঢ়বধশ ঃড় ুড়ঁ, ঃড় বিষপড়সব ুড়ঁ.
_ডরষষরধস ঊ. ষেধফংঃড়হব