somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন (৯-১০)

০৭ ই মে, ২০১০ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৈনিক কালের কন্ঠের ফিচার পাতা "শিলালিপি" তে হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।আমিও এখানে ধারাবাহিক ভাবে তারই কপি-পেষ্ট করব।
*পর্ব ১-২
*পর্ব ৩-৪
*পর্ব ৫-৬
*পর্ব ৭-৮

৯.
ডায়েরি

পৃথিবীখ্যাত জাপানি পরিচালক কুরাশুয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো, একজন বড় পরিচালক হতে হলে কী লাগে?
কুরাশুয়া জবাব দিলেন, একজন ভালো অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর লাগে।
এডগার এলেন পোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে?
তিনি জবাব দিলেন, একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে, তা ফেলে দেওয়ার জন্যে।
লেখকরা ক্রমাগতই আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না। একজীবনে আমি কী পরিমাণ আবর্জনা তৈরি করেছি, ভেবেই শঙ্কিত বোধ করছি। 'ফাউনটেনপেন' সিরিজের লেখাগুলি কি আবর্জনা না? যখন যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি। চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন বোধ করছি না। লেখকের চিন্তা-ভাবনাহীন লেখা পাঠক যখন পড়েন, তখন তারাও চিন্তা-ভাবনা করেন না। এই জাতীয় লেখার ভালো আশ্রয় ডাস্টবিন; পত্রিকার পাতা না। ঠিক করেছি, কিছুদিন ফাউনটেনপেন বন্ধ থাকবে। ইমদাদুল হক মিলনকে বলব, ফাউনটেনপেনের কালি শেষ হয়ে গেছে।
কলমের কালি প্রসঙ্গে মনে পড়ল ছোটবেলায় ফাউনটেনপেনের কালি আমরা নিজেরা বানাতাম। কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত, এক আনা করে দাম। দোয়াতভর্তি পানি নিয়ে একটা ট্যাবলেট ফেলে দিলেই কালি। বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা এক দোয়াত পানিতে দুটা ট্যাবলেট ফেলে কালি ঘন করত। কালো কালিতে কোনো এক অদ্ভুত আলো প্রতিফলনের সোনালি আভা বের হতো।
শৈশবে পড়াশোনা একেবারেই পছন্দ করতাম না। কিন্তু কালি আগ্রহের সঙ্গে বানাতাম। এই কালি ফাউনটেনপেনে ভরা হতো না। নিবের কলম দিয়ে লেখা হতো। অনেকের মতো আমারও একটা অদ্ভুত দোয়াত ছিল। এই দোয়াত উল্টে গেলেও কালি পড়ত না। এই দোয়াতটাকে মনে হতো বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান। দোয়াত উল্টে গেছে, কালি পড়ছে না_ঘটনা কীভাবে ঘটছে, ভেবে শৈশবে অনেকবার মাথা গরম করেছি।
এখন কালি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প। একবার 'সুলেখা' নামের কালির বিজ্ঞাপন লিখে দেওয়ার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হাত পাতা হলো।
কবি লিখলেন,
'সুলেখা কালি।
এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।'
অদ্ভুত সুন্দর বিজ্ঞাপন না?
পাঠক, বুঝতে পারছেন, আমি কীভাবে যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি? এ ধরনের লেখা আমি ব্যক্তিগত ডায়েরিতে কিছুদিন লিখতাম। ব্যক্তিগত ডায়েরি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত থাকেনি। দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে 'আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত ডায়েরির ব্যাপারটা আমি বুঝি না। এগুলি কেন লেখা হয়? যিনি লিখছেন, তার পড়ার জন্যে? লেখক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে ঠিক আছে। তার ডায়েরি প্রকাশিত হলে সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বোঝা যাবে। জনাব তাজউদ্দীন আহমদের অপ্রকাশিত ডায়েরি আমি সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত পড়ি। ২৩.১১.৫২ ও ২৪.১১.৫২ তারিখে তাঁর ডায়েরিতে কী লেখা?
২৩.১১.৫২
সকাল ৬টায় উঠেছি।
সকাল ৯টা থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত দোকানে।
বিছানায় গেলাম রাত সাড়ে ১০টায়।
আবহাওয়া : আগের মতোই।
২৪.১১.৫২
ভোর ৫টায় উঠেছি।
দোকানে কাটালাম সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১টা
এবং বেলা আড়াইটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
সাত্তার খান কয়েক দিন আগে আমার কাছ থেকে টিআর ফরম নিয়েছিলেন, যা তিনি তার কাছে রেখেছিলেন। তিনি এলেন সকাল দশটার দিকে।
বিছানায় গেলাম রাত সাড়ে দশটায়।
আবহাওয়া : আগের মতোই।
২৭ তারিখে আবহাওয়া আগের মতোই ছিল না। তিনি লিখেছেন_
আবহাওয়া : আগের মতোই, তবে ঠাণ্ডা একটু বেশি।
পাঠক হিসেবে ডায়েরি পড়ে আমি জানলাম, জনাব তাজউদ্দীন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেন। রাত দশটায় ঘুমুতে যান। আবহাওয়া থাকে আগের মতোই। তাঁর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ কেন দিনের পর দিন গুরুত্বহীন বিষয় লিখে গেছেন, কে জানে! তাঁর ডায়েরির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিই পাঠকের কাছে আসা উচিত।
সুররিয়েলিস্টিক পেইন্টিংয়ের গ্র্যান্ডমাস্টার সালভাদর দালিও ডায়েরি রাখতেন। তবে সব দিনের না। যেদিন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটত কিংবা নতুন কিছু ভাবতেন, সেদিনই ডায়েরি লিখতেন। আমার কাছে যে কপি আছে, সেটি ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত। (উরধৎু ড়ভ ধ বেহরঁং). কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) জনাব তাজউদ্দীনও ডায়েরি লিখেছেন।
১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ তিনি লিখেছেন_
সারা জীবন ছবি এঁকে গেলে আমি সুখী হতাম না। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, ড়েবঃযব-র মতো মানসিক পূর্ণতা আমার হয়েছে। ড়েবঃযব প্রথমবার রোমে এসে যে ভঙ্গিতে বলেছেন_অবশেষে আমার জন্ম হচ্ছে। আমারও সেই অবস্থা।
এডগার এলেন পো মাঝেমধ্যে ডায়েরি লিখতেন। তাঁর ডায়েরির ভাষা ছিল দুর্বোধ্য। মাঝে মাঝে সাংকেতিক ভাষাও ব্যবহার করতেন। তাঁর সাংকেতিক লেখার পাঠোদ্ধার হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ডায়েরি লিখতেন? তাঁর লেখা 'রাশিয়ার চিঠি'কে এক ধরনের ডায়েরি বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত গোছানো মানুষ। কাউকে চিঠি লিখলে তার কপি রাখতেন। এসব চিঠিই ডায়েরির কাজ করত।
সতীনাথ ভাদুড়ির ডায়েরি আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তিনি দিনলিপির পাশাপাশি গল্পের খসড়া লিখে গেছেন। গল্পের খসড়া এবং মূল গল্প পাশাপাশি পড়তে অদ্ভুত লাগে।
সতীনাথ ভাদুড়ির অনুকরণে কিছুদিন আমি ডায়েরিতে গল্পের খসড়া লেখার চেষ্টা করেছি এবং একদিন সকালে 'দূর ছাই' বলে ডায়েরি যথাস্থানে অর্থাৎ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।
ডায়েরি না লিখলেও আমি নানান তথ্য কিন্তু লিখে রাখি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একদিন বললেন, মুমূর্ষু বলতে আমরা মৃত্যুপথযাত্রী বুঝাই। অভিধান তা বলে না। অভিধানের অর্থ হচ্ছে_মরিবার ইচ্ছা। যার মরতে ইচ্ছা করে, সে-ই 'মুমূর্ষু'। আমার তথ্যখাতায় এটা লেখা। লেখার নমুনা_
১০ এপ্রিল ২০১০
জাদুকর জুয়েল আইচের জন্মদিনে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মুমূর্ষু শব্দের আভিধানিক অর্থ জানালেন।
উনি বললেন, মুমূর্ষু শব্দের মানে আমরা জানি মরণাপন্ন। আসলে তা না। অভিধান বলছে_মুমূর্ষু হলো মরিবার ইচ্ছা। আমি জানি, উনি ভুল করছেন। মুমূর্ষু অবশ্যই মরণাপন্ন। মুমূর্ষা হলো মরিবার ইচ্ছা। এই ভুল তথ্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার মাধ্যমে দেওয়া ঠিক না। গুরুত্বহীন মানুষের ভুলে তেমন কিছু যায়-আসে না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভুলে যায়-আসে।
পাদটীকা
পটল সামান্য একটা সবজি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এই সবজির দু'টা ব্যবহার আছে।
'পটলচেরা চোখ'
পটলকে লম্বালম্বিভাবে ফালা করলে টানা টানা চোখের মতো লাগে। সেই থেকে পটলচেরা চোখ।
'পটল তোলা'
পটল তোলা হলো মৃত্যু। তুচ্ছার্থে এর ব্যবহার। যেমন, হাবলু পটল তুলেছে।
পটল তোলার সঙ্গে মৃত্যুর কী সম্পর্ক, আমি অনেকদিন জানতাম না। বাংলা ভাষার পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করেছি, তারাও কিছু জানাতে পারেননি।
সম্প্রতি আমি এই বাগধারার উৎস জেনেছি। পাঠকদেরও জানাচ্ছি_'লিখে রাখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।'
ফলবান পটলগাছের সবগুলি পটল তুলে নিলে গাছটি মারা যায় বলেই পটল তোলা মৃত্যু বুঝায়। [তথ্যের উৎস : সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র সংকলিত, নিউ বেঙ্গল প্রেস।]

কুইজ
পাদটীকার সঙ্গে এখন থেকে কুইজ যুক্ত হচ্ছে। আজকের কুইজ_
কোন প্রাণীর হৃৎপিণ্ড থাকে তার মাথায়?
উত্তর : পিপীলিকা।


১০.

'বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা'

রবীন্দ্রনাথের লেখা এই লাইনটি আমার অতি অতি প্রিয়। কবি ধরতে পেরেছেন বৃষ্টি প্রকৃতিতেও নেশা ধরিয়ে দেয়। মানুষ কোন ছাড়।
বৃষ্টি আমাকে নেশাগ্রস্ত করে। ভালোভাবেই করে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আমার শৈশবে। তখন সিলেটে থাকি। সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। একবার শুরু হলে সাত দিন আট দিন থাকে। ইচ্ছা করে ভিজে চুপচুপা হয়ে স্কুলে যাই। স্যার আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বলেন, এ কী অবস্থা! নিউমোনিয়া বাঁধাবি তো। যা বাড়ি যা। ভেজা কাপড়ে স্কুল করতে হবে না। গাধা কোথাকার! বাসায় ফিরে বই-খাতা রেখে আবার বৃষ্টিতে নেমে যাওয়া। কাঁচা আমের সন্ধানে আমগাছের নিচে নিচে ঘুরে বোড়ানো। তখনকার অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সন্তানরা তাদের কাছে হাঁস-মুরগির মতো। সন্ধ্যা হলে হাঁস-মুরগির মতো তারা ঘরে ফিরলেই চলবে।
আমাদের সময় 'রেইনি ডে' বলে একটা ব্যাপার ছিল। জটিল বৃষ্টি হলে স্কুল ছুটি। হেডস্যার ভাব করতেন ছুটি দিতে গিয়ে তিনি মহাবিরক্ত। কিন্তু তাঁর মুখেও থাকত চাপা আনন্দ। বৃষ্টি তার আনন্দ সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়।
আজকালকার ইংরেজি স্কুলের শহুরে ছেলেমেয়েরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা গাড়ি করে স্কুলে আসে, গাড়ি করে চলে যায়। ঝড়-বৃষ্টি তাদের স্পর্শ করে না।
যে কথা বলছিলাম, বৃষ্টির ব্যাপারে আমি নেশাগ্রস্ত। বৃষ্টি হলে আমি জলধারায় নিজেকে সমর্পণ করব এটা নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নুহাশ পল্লী এবং নুহাশ চলচ্চিত্রের স্টাফরা বিষয়টায় খুবই আনন্দ পায়। অতিথিদের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা_
"বৃষ্টি নামছে আর স্যার ঘরে বসা, এই জিনিস হবে না। তখন স্যারের তালাবদ্ধ করে রাখেন স্যার তালা ভেঙে বের হয়ে যাবে। যতক্ষণ বৃষ্টি থাকবে ততক্ষণ স্যার বৃষ্টিতে ব্যাঙের মতো লাফালাফি করবে।"
সমস্যা হয়েছে ইদানীং বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছা করে না। নিশ্চয়ই 'বয়স ফ্যাক্টর'। তার পরও বাধ্য হয়ে নামি। না নামলে আমার স্টাফদের ইজ্জত থাকে না।
গত বর্ষায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আমি আমার ঘরে বসে আছি। রিডার্স ডাইজেস্টের একটা পুরনো সংখ্যায় চোখ বুলাচ্ছি, দরজা খুলে নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার বুলবুল ঢুকল। উত্তেজিত গলায় বলল, স্যার মনে হয় খেয়াল করেন নাই। বিরাট বৃষ্টি। ভিজবেন না?
আমি বই বন্ধ করতে করতে বললাম, আসছি।
পুকুরে নৌকা রেডি করেছি যদি নৌকায় বসে বৃষ্টি দেখতে চান।
পুকুরপাড়ের দিকে যাব, তোমরা দল বেঁধে পিছে পিছে আসবে না। আমি বৃষ্টিতে ভিজছি এটা হাঁ করে দেখার কিছু নাই।
অবশ্যই নাই। আমরা দিঘির দিকে যাব না।
বৃষ্টিতে নেমেই যৌবনকালের মাহাত্দ্য বুঝলাম। তখন বৃষ্টির আনন্দে অভিভূত হতাম এখন থরথর করে শীতে কাঁপছি। দাঁত কিড়মিড় করা শুরু করেছে। যাচ্ছি পুকুরপাড়ের দিকে। পরিকল্পনা হলো, শ্বেতপাথরের ঘাটে বসে বৃষ্টি দেখব। ঘাটে বসে আছি। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানোর কিছুক্ষণ পর বজ্রপাতের শব্দ। ওই যে আলোর গতি এবং শব্দের গতির পার্থক্য, নাটক-সিনেমায় অবশ্যি বিদ্যুতের ঝলক এবং বজ্রপাতের শব্দ একসঙ্গে দেখানো হয়। বিদ্যুৎ চমকের পরপর বজ্রপাতের শব্দের জন্য অপেক্ষা করার অদ্ভুত টেনশনও উপভোগ করার মতো ব্যাপার। শব্দটা বড় হবে না, ছোট হবে। অল্পক্ষণ হবে, নাকি অনেকক্ষণ।
বজ্রপাতের অপেক্ষা করছি হঠাৎ আমার ভেতরের সিক্সথ সেন্স আমাকে সতর্ক করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার ছয় থেকে সাত হাত দূরে একটা সুপারিগাছের ওপর বজ্রপাত হলো। গাছ সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে কয়লা।
আমি প্রথম এত কাছে বজ্রপাত দেখলাম। বজ্রপাতের আলো দূর থেকে নীল দেখা যায়। খুব কাছ থেকে এই আলো কিন্তু গাঢ় কমলা।
বজ্রপাতে মৃত্যু না হওয়ায় একটি কারণে যথেষ্ট সন্তোষ লাভ করলাম_আমাকে আল্লাহ সরাসরি শাস্তি দিয়েছেন এটা এখন কেউ বলবে না। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, অতি দুষ্টদের আল্লাহপাক বজ্রপাতের মাধ্যমে সরাসরি শাস্তি দেন।
উদাহরণ সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী মিরন। তার ঘটনা এ রকম_
সিরাজউদ্দৌলার আপন খালা ঘসেটি বেগম এবং সিরাজউদ্দৌলার মা আমেনা বেগম বজরায় করে বুড়িগঙ্গা নদী পার হচ্ছেন। ব্যবস্থা করে দিয়েছে মিরন। ঘসেটি বেগম হঠাৎ দেখলেন, মাঝনদীতে বজরা আসামাত্র নৌকার মাঝিমাল্লারা বজরা ফেলে ঝাঁপিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ল এবং প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল তীরের দিকে। বজরার নিচ ফুটো করা হয়েছে। বজরা পানিতে ডুবতে শুরু করেছে। ঘসেটি বেগম মিরনের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারলেন। তিনি বজরার ছাদে উঠে চিৎকার করে বললেন, মিরন! তুই মারা যাবি বজ্রাঘাতে।
ইতিহাস বলে, বজ্রপাতের কারণেই মিরনের মৃত্যু হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে আল্লাহপাক কী সরাসরি শাস্তি দেন? যদি দিতেন তাহলে পৃথিবীর চেহারা অন্য রকম হতো। অতি দুষ্টলোকদের আমি কখনোই শাস্তি পেতে দেখিনি। তারা পরম সুখে জীবন পার করে। একপর্যায়ে মাদ্রাসা-মসজিদ বানায় বলে পরকালেও হয়তো তারা পরম সুখে বাস করবে।
আল্লাহপাক সম্বন্ধে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন বলা হয়, নর-নারীর বিবাহের ব্যাপারটা তিনি দেখেন। ইরনষব-এ এই কথা আছে_গধৎৎরমবং ধৎব সধফব রহ যবধাবহ.
আমার এক বন্ধু চার-পাঁচটা বিয়ে করেছেন (সঠিক সংখ্যা রহস্যাবৃত) এবং ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ কোনো স্ত্রী তাকে সুখ দিতে পারেনি। বর্তমানে সুখের জন্য তিনি স্ত্রীর বিকল্পের সন্ধানে ব্যস্ত। এখন তিনি যদি বলেন, বিয়ে-শাদি তো আল্লাহর হাতে। উনি যা ঠিক করেছেন আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে_তাহলে কি চলবে?
ইসলামের দুটি ধারা। এক ধারা বলছে ঋৎবব রিষষ-এর কথা, অর্থাৎ মানুষকে বিবেচনা-শক্তি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। আরেক দল ফ্রি উইল অস্বীকার করেন। তারা বলেন, সবই পূর্ব নির্ধারিত। এই ক্ষেত্রে তারা সুরা বনি ইসরাইলের একটি আয়াত উল্লেখ করেন_
'আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।'
বলা হয়ে থাকে, পাঁচটা জিনিস আল্লাহপাক সরাসরি নিজের কনট্রোলে রেখেছেন। যেমন_
১. হায়াত
২. মৃত্যু
৩. ধন-দৌলত
৪. রিজিক
৫. বিবাহ
ধর্ম বিষয়ে আমার সীমিত পড়াশোনায় যা জানি তা হচ্ছে_
পাঁচটা বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর হাতে।
১. কেয়ামত কখন হবে।
২. কোথায় কখন বৃষ্টি হবে।
৩. মায়ের গর্ভে কি আছে (ছেলে-মেয়ে তাদের ভাগ্য ইত্যাদি)।
৪. মানুষ আগামীকাল কি উপার্জন করবে।
৫. তার মৃত্যু কোথায় কিভাবে ঘটবে।
(সূত্র: সূরা লোকমান। আয়াত-৩৪)
আমি কোনো ভুল করেছি এ রকম মনে হয় না তারপরও এই বিষয়ে জ্ঞানী আলেমদের বক্তব্য আমি আগ্রহের সঙ্গে শুনব।
পাদটীকা
আমার তিন বছর বয়েসী পুত্র নিষাদকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা! আল্লাহ কোথায় থাকেন?
সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলল, 'আকাশে থাকেন'। তার সঙ্গে আমাদের দেশের ক্রিকেট প্লেয়ারদের চিন্তাতেও মিল দেখলাম। ক্রিকেট প্লেয়াররা কোনোক্রমে একটা হাফ সেঞ্চুরি করলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন। তাঁরাও জানেন আল্লাহ আকাশে থাকেন।
শিশুপুত্র নিষাদ আল্লাহর অবস্থান বলেই ক্ষান্ত হলো না। সে বলল, আল্লাহর কাছে দুটি বড় এসি আসে। একটা এসি দিয়ে তিনি গরম বাতাস দেন, তখন আমাদের গরম লাগে। আরেকটা এসি তিনি ঠাণ্ডা বাতাস দেন তখন আমাদের ঠাণ্ডা লাগে।
কুইজ-১
কোন মোগল সম্রাট টাঁকশাল থেকে স্বর্ণমুদ্রা ছেড়েছিলেন সেখানে লেখা_'আমি আল্লাহ'। কিন্তু সেই সময়কার মাওলানারা তার জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেননি।
উত্তর : সম্রাট আকবর। তিনি স্বর্ণমুদ্রায় লিখলেন আল্লাহু আকবর। এর একটি অর্থ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্য অর্থ আকবর আল্লাহু। সম্রাট আকবর তখন নতুন ধর্মমত প্রচার শুরু করেছেন_'দিন-ই-এলাহি'। মোল্লারা যখন তাকে স্বর্ণমুদ্রায় লেখা নিয়ে প্রশ্ন করল তখন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, যে অর্থ গ্রহণ করলে আপনারা খুশি হন সেই অর্থ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এই অর্থ নিন।

কুইজ-২
প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবী পৃষ্ঠে কতবার বজ্রপাত হয়?
উত্তর : দুইশত বার।
১২টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×